Published : 07 Jul 2025, 09:19 PM
জ্যেষ্ঠ নেতাদের একাংশের বিদ্রোহের মধ্যে নতুন মহাসচিব বেছে নেওয়ার পর এবার জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং দুই কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মজিবুর রহমান চুন্নুকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
এই তিন জ্যেষ্ঠ ও বিদ্রোহী নেতাকে সব পদ-পদবীসহ দল থেকে সোমবার অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দেন দলের চেয়ারম্যান।
এদিন বিকালে জাতীয় পার্র্টির দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একথা জানানো হয়।
তবে তিন নেতাই জিএম কাদেরের এ সিদ্ধান্ত মানছেন না; তারা বলছেন, এটি ‘অবৈধ ও ’গঠনতন্ত্র’ বিরোধী।
এতে বলা হয়, গত ২৫ জুন দলের মতবিনিময় সভায় সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এবং কো-চেয়ারম্যান ও মহাসচিব মজিবুর রহমান চুন্নুর বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয় এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। এর তিন দিন পর গত ২৮ জুন দলের প্রেসিডিয়াম সভায় এই তিনজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।
”এমতাবস্থা পার্টির চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই তিনজনকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ পার্টির সকল পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।”
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এ আদেশ ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।”
দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সোমবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাউন্সিল ডিক্লেয়ার করার পরে কাউকে সরানো যায় না। এই সিদ্ধান্ত কাউন্সিল থেকেই আসতে হবে। কাউকেই কারণ দর্শানো নোটিস ব্যতিত অব্যাহতি দেওয়া যাবে না। এটা ন্যাচারাল জাস্টিস বিরুদ্ধ। প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্তও যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলেও তাকে কারণ দর্শানো নোটিস দিতে হবে।
‘‘এগুলো সবই অবৈধ। আমরা মুজিবুল হক চুন্নুকে মহাসচিব মানি এবং আমরা আমাদের স্বপদে বহাল আছি।”
এ ব্যাপারে রুহুল আমিন হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্ত গঠনতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
‘‘একজন পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি গঠনতন্ত্রকে ডিঙিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এতে তার স্বৈরাচারী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। আমরা অবশ্যই এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।”
পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর মুজিবুল হক চুন্নু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এটা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। জাতীয় কাউন্সিল ডাকার পরে পদ থেকে বহিষ্কার করার কোনো এখতিয়ার নেই চেয়ারম্যান এর। এটা অগঠনতান্ত্রকি, বেআইনি। উনার সিদ্ধান্ত মানি না, উনার এখতিয়ার নেই। এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই।"
এর আগে বিকালে আলাদা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পার্টির মহাসচিব চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে সেখানে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে বসান জিএম কাদের।
মশিউর রহমান রাঙ্গাকে বাদ দিয়ে ২০২১ সালের ৯ অক্টোবর মজিবুর রহমান চুন্নুকে মহাসচিব করেছিলেন জিএম কাদের।
পূর্বাপর
জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যের ‘পাপ’ থেকে দলকে মুক্ত করতে সম্প্রতি এরশাদের ভাই জিএম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর উদ্যোগ নিলে জাতীয় পার্টি আবার ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে।
২৮ জুন চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় সম্মেলন দিন ঠিক করেছিলেন জিএম কাদেরর নেতৃত্বাধীন দলটি। কিন্তু শেষমেষ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, ওই তারিখে প্রধান উপদেষ্টার কর্মসূচি থাকায় অনুমতি দেওয়া যাবে না।
এরপর জিএম কাদের সম্মেলন স্থগিত করে দেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলা পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। মহাসচিব চুন্নুও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টি থেকে বের হয়ে যেসব দল গঠিত হয়েছে, তাদের শীর্ষ নেতাদেরও এক মঞ্চে এনে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তারা। সেজন্য এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশের নেতাদের সঙ্গেও তারা যোগাযোগ করেন।
পার্টির কর্মীদের একটি অংশের মধ্যে একটি চালু ধারণা হল, বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনাতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জিএম কাদেরের ভূমিকা নিয়ে যেহেতু নানা প্রশ্ন রয়েছে, সেজন্য পার্টির ভেতরে যৌথ নেতৃত্ব সৃষ্টি করে পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে। সেজন্য পুরনো ও নিষ্ক্রিয় নেতাদেরকে যুক্ত করতে হবে।
মূলত ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমা থেকে জাতীয় পার্টিকে বের করে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজনে জোর দিচ্ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন তালুকদাররা
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সে সময় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, জিএম কাদের ‘একাই সবকিছু’ করতে চান। এর পরিবর্তন চান তারা।
“মেইন জিনিস হচ্ছে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র। আমরা পার্টি থেকে সেটা সরাতে চাই। পার্টিতে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের কথা বলে তো লাভ নাই,” বলেছিলেন তিনি।
জিএম কাদেরকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টির নতুন নেতৃত্ব গঠনের একটি প্রক্রিয়া যে শুরু হয়েছে, সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন।
গত ২০ জুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, “জাতীয় পার্টিকে বাদ দিতে পারছে না। কাজেই জিএম কাদের মাইনাস হয়ে জাতীয় পার্টি– সেটা হল সরকারের পলিসি টু কাম কামিং ইলেকশন। বিএনপি-জামায়াত ওরা আওয়ামী লীগকে থাকতে দেবে না। আর জাতীয় পার্টিকেও বাদ দিতে চাচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু পারছে না, সেহেতু জিএম কাদের মাইনাস, সেটা তারা চায়। কাউন্সিল করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিলে লাঙ্গলও পাবে, এটা তারা বলে বেড়াচ্ছে।”
এর মধ্যে বিরোধীদের সম্মেলনের পাল্টায় নিজের শক্তির জানান দিতে ২৮ জুন দলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মহা সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে বসেন জি এম কাদের।
কিন্তু আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বে জ্যেষ্ঠ নেতাদের ওই অংশটি সম্মেলনের নতুন তারিখের ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন।
এক বিবৃতিতে তারা বলেন, “আমরা দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানাই, চেয়ারম্যান যেন অবিলম্বে একগুঁয়েমি ও স্বেচ্ছাচারিতার পথ থেকে সরে এসে দলের প্রতিষ্ঠাতা পল্লিবন্ধুর (এইচ এম এরশাদ) প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অবিলম্বে সম্মেলনের নতুন তারিখ ঘোষণা করেন।”
জাতীয় পার্টির ওই অংশের একজন নেতা সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পার্টি অফিসে সম্মেলন করার জন্যও তারা প্রশাসনের অনুমতি পাননি। মূলত সে কারণেই তারা অবস্থান বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তারা জি এম কাদেরকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছেন। দল ভাঙার দায় না নিয়ে তারা নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে চান।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ২৭ জুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চীন মৈত্রীর বরাদ্দ বাতিলের পর কাকরাইলে কাউন্সিল করার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে তো চেয়ারম্যান মহাসমাবেশ আহ্বান করেছে। সব মিলিয়ে আপাতত সম্মেলন করছি না।”
আর জিএম কাদেরের পক্ষে শামীম হায়দার পাটোয়ারী সেদিন বলেন, “আমরা তো সম্মেলন স্থগিত করেছি। পরে আপনাদের সম্মেলনের তারিখ জানিয়ে দিব। আপাতত কোনো প্রোগ্রামও আমরা করছি না।”
দুই পক্ষ এক পা করে পিছু হটায় সে সময় দলের কর্মীদের উত্তেজনা কিছুটা কমলেও এক সপ্তাহের মাথায় নতুন পদক্ষেপ নিলেন জিএম কাদের।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মত ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে, ১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফা ভাঙন হয়।
কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে, ২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে চতুর্থ দফা এবং ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে জাপায় পঞ্চমবারের মত ভাঙ জাতীয় পার্টি।
এরশাদ মারা যাওয়ার পর সবশেষ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভাগ হয়ে যায়।