Published : 04 Apr 2025, 12:38 PM
ঈদ মানেই মুসলিম বিশ্বজুড়ে প্রস্তুতির জোয়ার। কেউ কিনে নতুন পোশাক, কেউ মেহেদির রঙে আঁকে হাতের পাতায় স্বপ্ন। আর কুয়েত? কুয়েত তখন সুগন্ধে ভরে ওঠে। সুগন্ধির এক রাজ্য যেন রূপ নেয় পুরনো শহরের বুকে।
সেই রাজ্যের নাম সুক আল-মোবারকিয়া। প্রাচীনতম এই বাজারটি কুয়েতের কেন্দ্রস্থলে, কুয়েত সিটির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। শতাব্দীর প্রাচীন ইতিহাস বয়ে চলা এই সুক, কুয়েতের ঐতিহ্যের এক অনন্য প্রতীক। তেল আবিষ্কারের আগেই যেখানে লেনদেন হতো মুক্তা, খেজুর আর সুগন্ধির, সেই পুরনো বাতাস এখনও ঘুরে বেড়ায় মোবারকিয়ার অলিগলিতে।
ঈদের ঠিক আগের দিনগুলোয় এই বাজার রূপ নেয় এক সুবাসিত মেলায়। ওমানি, সৌদি, ভারতীয়, এমনকি পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসা সুগন্ধির কাঁচামাল দিয়ে তৈরি হয় উদ, মাখলাত, আতর আর নানা ধরনের বাহারি পারফিউম। শুধু পুরুষের জন্যই নয়, নারীদের জন্য তৈরি হয় ফুলেল অথচ স্থায়ী ঘ্রাণের এক নিপুণ জগৎ।
সুক মোবারকিয়াতে ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ‘উদ’। এটি এক ধরনের বিশেষ কাঠ যা আগুনে দিলে ধোঁয়ার মাধ্যমে এক গভীর সুবাস ছড়ায়। এক গ্রাম ভালো মানের উদের দাম কুয়েতি দিনারে দাঁড়ায় প্রায় ৩-৪ দিনার, অর্থাৎ ১০-১৩ ডলার। কিছু বিরল উদের দাম পৌঁছায় ১০০ ডলার পর্যন্ত!
সুক মোবারকিয়াতে রয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও দোকান। তেমনই এক সুগন্ধি ব্যবসায়ী আব্দুল হাই মামুন। এবার ঈদুল ফিতর ঘিরে সুগন্ধি পণ্য বিক্রিতে সন্তুষ্টির কথা জানান তিনি।
মামুন জানান, সুক আল-মোবারকিয়াতে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি সুগন্ধি দোকান, এখানে অধিকাংশ দোকানই বাংলাদেশি মালিকানাধীন।
প্রবাসী এ ব্যবসায়ী বলেন, “রমজান মাসের শুরুর দিকে মোটামুটি ব্যবসা হলেও, শেষের ১০ রমজান থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত সুগন্ধি পণ্য বেশি বিক্রি হয়ে থাকে।”
ঈদের আগে আতরের দোকানগুলোতে ভিড় পড়ে কুয়েতি নারীদেরও। তারা বেছে নেন কাচের শিশিতে বন্দি আতরের নরম, কোমল গন্ধ। গোলাপ, জুঁই, চন্দন আর কস্তুরির ঘ্রাণ মিশে তৈরি হয় একেকটি ব্যক্তিত্বভিত্তিক সুগন্ধি— যা কখনো কাব্যের মতো কোমল, কখনো আগুনের মতো দৃপ্ত।
মোবারকিয়ার বাজার কেবল কেনাবেচার স্থান নয়, এটি এক সামাজিক মিলনমেলা। ঈদের আগে এখানে ছোটোদের জন্য মিষ্টি, খেলনা আর বড়দের জন্য রোজা ভাঙার খেজুর বিক্রি হয়। কিন্তু বাজারের প্রাণ থাকে সুগন্ধিতে। অনেকেই পরিবার নিয়ে আসেন এখানকার পুরনো কাফেতে—কুয়েতি কফি আর খালিজি মিষ্টির সাথে ভাগাভাগি করেন স্মৃতি।
ঈদের আগে সুক মোবারকিয়া হয়ে ওঠে বিদেশি পর্যটকদের জন্য এক অনন্য গন্তব্য। আতর আর উদ কিনতে অনেকে বিশেষভাবে এই সময়টায় কুয়েত ভ্রমণ করেন। কুয়েতি সংস্কৃতির ঘ্রাণ বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় যেন হয়ে উঠেছে এই বাজার।
সুক আল-মোবারকিয়া হলো কুয়েতের হৃদয়ের ঘ্রাণ। ঈদ এলে সেই হৃদয় যেন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে আকাশে-বাতাসে, ছুঁয়ে যায় মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। আতরের শিশির ভেতর বন্দি থাকে শুধু সুবাস নয়, স্মৃতি, সংস্কৃতি আর এক অলিখিত কবিতা।