Published : 07 Jan 2025, 01:58 PM
বিশ্বব্যাপী অভিবাসী নাট্যশিল্পীদের মাঝে একটি কার্যকর বোঝাপড়া ও যোগাযোগ স্থাপনের পাশাপাশি বিশ্ব নাট্যপরিমণ্ডলে বাংলা নাটকের পরিচিতি বাড়াতে সামনের বছর ৯ থেকে ১২ অক্টোবর নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চার দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসব। ‘অভিবাসের নাটক ২০২৬’ শিরোনামে ও ‘উৎসবে আনন্দে প্রতিবাদে বাংলা থিয়েটার’ স্লোগানে এ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা ও সৌদি আরব থেকে ১০টি নাট্যদল অংশ নেবে।
এ উৎসবের আয়োজক হচ্ছে সম্মিলিতভাবে নিউ ইয়র্কের নাট্য সংগঠন: বিটিএ, ঢাকা ড্রামা, ড্রামা সার্কেল, থিয়েটার থিয়েটার, ক্রিস্টি, বাংলা থিয়েটার নিউ ইয়র্ক, শিল্পাঙ্গন, থিয়েটার ৭১, এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপ, ব্ল্যাক ফিল্ম ও নাগরিক নাট্যাঙ্গন অ্যানসাম্বল। প্রস্তুতির এই দীর্ঘ সময়ে আরো কিছু নাট্য সংগঠনের সম্পৃক্তি ঘটবে এই উৎসবে- এ আশা আমাদের।
শনিবার সন্ধ্যায় উৎসবের লোগো উন্মোচন করা হয়। উৎসবের লোগো তৈরির দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। এ কাজটি করতে গিয়ে অভিবাসীদের নাট্যচর্চা নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি। অভিবাসের নাটক প্রসঙ্গে বলবার আগে উৎসব লোগোটি নিয়ে নাট্য সতীর্থরা কিছু শুনবার কৌতূহল প্রকাশ করেছেন শুরুতেই। কারই বা জানা না আছে যে, থিয়েটার বোঝাতে বিশ্বজনীন যেসব প্রতীকী অভিব্যক্তিগুলো ব্যবহার করা হয়, তাতে চোখ ও নেত্রের মুদ্রা এবং মুখাবয়বকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।
উৎসবের লোগোর নকশা তৈরি করবার ক্ষেত্রে, আমি সেই শাশ্বত রেওয়াজটাকেই অনুসরণ করেছি মাত্র। তবে একইসঙ্গে এ-ও খেয়াল রেখেছি যে, কতটা ছকমুক্ত করে লোগোটিকে আঁকা যায়। তবে শুরু থেকেই মাথায় ছিল রেখাচিত্রের সরলীকরণে জ্যামিতিক জ্যা-মুক্ত রূপগুলোর কথা। যতটুকু সরল ও নিরাভরণ রাখা যায়, তা-ও খেয়াল রেখেছি বারবার।
বাংলার পটচিত্র আর হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত পটুয়াদের হাতে আঁকা সড়াচিত্রের মোটিভ, বাংলার প্রাচীন যে জনপদ বঙ্গ আর রাঢ়, সেই কিশোরগঞ্জ কিংবা বিষ্ণুপুরের কুম্ভকারদের হাতে তৈরি টেপা পুতুলের গঠন কাঠামো এই নকশাকে প্রভাবিত করেছে। প্রতীচ্যকে প্রাচ্যের সুতোয় গেড়োবন্দি করা যায় কিনা, সে কথাও মনে এসেছে বারংবার।
আর মাঝখানের চৌকন জমিন টুকুতে এঁকেছি ইচ্ছে ঘুড়ির নীল রঙে রাঙিয়ে। নীলের স্বপক্ষে আমার যুক্তি- পৃথিবীময় অসীম অবারিত নীলিমা। স্বপ্ন বাস্তবতা আর রাশি রাশি প্রত্যাশা। এবার আসা যাক এই উৎসবের শিরোনাম ‘অভিবাসের নাটক’ নির্বাচনের নেপথ্যে যে ছায়া-ভাবনাটি কাজ করেছে তা নিয়ে। সেটি হচ্ছে- বাংলা নাটকের এক নতুন পারিভাষিক অভিজ্ঞানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাংলা নাটকের গঠন ও প্রায়োগিক প্রয়াসের মাধ্যমে একটি মান ধারণায় ‘বাংলা ডায়াস্পোরা থিয়েটার’ একদিন নিশ্চিত সেসব উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের বিদ্যমান উপস্থিতিকে নজরে আনতে পারবে এই আকাঙ্ক্ষা থেকে।
তাই এই আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনার পাখায় ভর দিয়ে নীল নীল সবুজের ছোঁয়ায় ফিকে গাঢ় হরেক রকম ভাবনায় শূন্যের মাঝেই গাঙচিলদের মতো আনমনে শামিল হওয়ার প্রত্যাশায় এ উৎসের সন্ধান। আমরা একটু একটু করেই এগোতে থাকবো সেই স্বরূপ অন্বেষণের দিকে। এগিয়ে যাবো সেই ডায়াস্পোরা থিয়েটারের দিকে, হয়তোবা যার প্রারম্ভিক সূচনা হয়েছিল অনেক আগ থেকেই। আপাতত যতটুকু জানা সম্ভব হয়েছে তা হচ্ছে- বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অভিবাসীদের বাংলা নাট্যচর্চার শুরুটা হয়েছিল আনুমানিক প্রায় চার দশক আগে। হয়তো তারও আগে।
আরো আগে অভিবাসী বাঙালি সংস্কৃতির যে ইতিহাস আছে- হয়তো সেই ইতিহাস, ওই ইন্দ্রপুরীর ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে, হিমালয় থেকে বেরিয়ে আসবে একদিন। অভিবাসী কারা ? অভিবাসী সংস্কৃতিটা কী? অভিবাসের নাটকের স্বরূপই-বা কী হবে? এ নিয়ে আগামী সময়গুলোতেও চলতে থাকবে ব্যাপক আলোচনা বিতণ্ডা আর যুক্তির খণ্ডন।
অভিবাসী শব্দটি শুনলে আচমকা মনে পড়ে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘উদ্বাস্তু’ কবিতাটি।
“যেখানে যাচ্ছি সেখানে আছে কী?
সব আছে। অনেক আছে, অঢেল আছে
কত আশা কত বাসা কত হাসি কত গান
কত জন কত জায়গা কত জেল্লা কত জমক,
সেখানকার নদী কি এমনি মধুমতী?
মাটি কি এমনি মমতামাখানো?
ধান কি এমনি বৈকুণ্ঠ বিলাস?
সোনার মত ধান আর রুপোর মত চাল?
বাতাস কি এমনি হিজল ফুলের গন্ধভরা
বুনো বুনো মৃদু মৃদু?”
আমরা সেই অভিবাসী বাঙালি, যারা সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে নতুন এক সাংস্কৃতিক জনভূমি গড়ে তুলছি এই বিভুঁইয়ে। তাদের জন্য এটা এক নতুন স্বদেশ। এখন এটাও আমাদের এক নিজের দেশ, নতুন দেশ। নতুন দেশের নতুন মানুষ। নতুন নাম- অভিবাসী। ভোররাতের স্বপ্নভরা আদুরে ঘুমটুকু নিয়ে পাশে ফিরে তাকালে আমাদের চোখে এখনো ভেসে ওঠে, একটু দূরে ছলাত ছলাত পাগলি নদীর ঢেউ, তার উপর চলেছে ভেসে পালতোলা ডিঙি ময়ূরপঙ্খি।
পোস্ট মর্ডানিজম আর্ট রেভ্যুলেশন ও উত্তর আধুনিকতাবাদী শিল্পতত্ত্ব- সাংস্কৃতিক জনসমাজে অনেক নতুন নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে। জাতিসত্তা নির্ভর শিল্পচর্চার এই প্রেক্ষিতটি এখন অভিবাসীকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক চর্চার একটি নবমাত্রিক ধারণা। যা কিনা জন্ম দেয় বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ধারা। বছর দশক আগে, কানাডার এক নাট্য সম্মেলনের সেমিনারে ‘ডায়াস্পোরা থিয়েটার’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমার একটি গবেষণা প্রবন্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ‘ডায়াস্পোরা থিয়েটার’ চর্চা ও অনুশীলনের তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিলো আমার। এই পর্যবেক্ষণে বেশকিছু প্রবণতাকে বিশেষভাবে শনাক্ত করবার সুযোগ ঘটেছিল তখন।
‘অভিবাসের নাটক’, শিল্পচিন্তার জগতে এ অভিধাটি সাম্প্রতিক নয়। সমসাময়িক সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রয়োগ চর্চায় এই লক্ষণগুলোর উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। নিজ নিজ জন্মভূমি থেকে দেশান্তরিত হওয়া, ভিন্ন অন্য কোনো রাষ্ট্র-সমাজে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকা পৃথিবীর অন্যসব ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর মতোই বাঙালি অভিবাসীরা তাদের দিনমান জীবন-প্রবাহের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। স্বদেশ-বিচ্ছিন্নতা এসব অভিবাসী শিল্পী-লেখকদের সৃষ্টিশীলতায় শুধু ছায়াই ফেলেনি, তাদের নিজ নিজ জাতিসত্তা সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিবোধের মৌলিক অনুষঙ্গ হয়ে ধরা দিচ্ছে। যা কিনা শিল্পসাহিত্যের শৈলীতে নতুন এক সাংস্কৃতিক কাঠামো তৈরি করে দিচ্ছে।
ডায়াস্পোরা মূলত জন্মভূমির বাইরে থেকেও এক স্বদেশী সাংস্কৃতিক চর্চাকে নতুন এক বাঁকে নিয়ে যায়। সেখানে যুক্ত হয় বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, ফিউশনিজম, একাধিকরণ, একাঙ্গীকরণ আর শিল্পের আত্তীকরণ প্রক্রিয়া। আগামীতে আমাদের পর্যবেক্ষণে হয়তো আরও বেশি করে ধরা দেবে, এসব আঙ্গিকের বাহ্যিক ও আত্মিক রূপটি। আমাদের নস্টালজিয়ায় ছায়াঢাকা ডোবার ধারে হিজল গাছের বুনো গন্ধ নাকে নিয়ে হাডসন-ভেনিস-টেমসের ধারে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে হয়তো নদীকে প্রশ্ন করবো, আমরা কি তোমার গত জন্মের বন্ধু?
একদিন নিশ্চিত জানি, অভিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে আমরা একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা এবং এর একটি একাডেমিক সংজ্ঞায় পৌঁছতে পারবো। আপাতত আবারো না হয় ফিরে আসি আমাদের নাট্যোৎসবের শিরোনাম ‘অভিবাসের নাটক’ বিষয়ে। বাংলাদেশের বাইরে যেসব দেশে বাংলা নাটক চর্চা করা হয় এবং দেশের বাইরে যারা নাটকের সঙ্গে যুক্ত অভিবাসের নাটকের এই উৎসব সম্মিলনীতে তারা সবাই একীভূত। বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য নাটক কিংবা বাঙালিদের প্রযোজিত মঞ্চনাট্য চর্চা, আপাতত ‘অভিবাসের নাটক’ নাট্যোৎসবে তারাই শামিল হয়েছেন।
আমাদের এই উৎসব আন্তর্জাতিক মণ্ডলের যতটুকু সম্ভব প্রায় সব অভিবাসী নাট্যকর্মী এবং তাদের নাট্যকর্মকে যূথবদ্ধ করতে আগ্রহী। তাই এই উৎসব বাঙালি জাতিসত্তার ক্রমবিকাশমান উন্মেষ ও সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততার বিশ্বজনীন পরিমণ্ডলের একটি রূপরেখা জানান দেয়। ‘অভিবাসের নাটক’ শিরোনামে এই উৎসবকে বাঙালির অগ্রসমান অভিযাত্রাই সাক্ষ্য দেবে একদিন। সেই ঐক্যবোধ চেতনা আর সাংস্কৃতিক অঙ্গীকারকে ধারণ করে আমরা তাই নাটক নিয়ে শামিল হয়েছি দেশে দেশে বন্দরে শত মরু কন্দরে গৌরী শিখায়।