Published : 17 Jun 2025, 09:27 PM
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় ‘জ্ঞানের আলো পাঠাগার’ নামে একটি সামাজিক সংগঠনের কার্যালয় উচ্ছেদ করা হয়েছে।
বই পড়া ও বিতরণের পাশাপাশি দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত অরাজনৈতিক সংগঠনটির উচ্ছেদ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
উপজেলা সদরের তারাশী গ্রামে রোববার বিকালে জেলা প্রশাসনের নির্দেশে এবং যৌথবাহিনীর উপস্থিতিতে জ্ঞানের আলো পাঠাগারের কার্যালয়টি উচ্ছেদ করা হয়।
পাঠাগারটি উচ্ছেদ করায় হতাশা প্রকাশ করে এটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহামান পারভেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি এটি উচ্ছেদ করা হবে।
সোমবার পাঠাগারটির ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টে কী কারণে এটি ভাঙা হয়েছে সেটি জানানো হয়নি অভিযোগ করে বলা হয়, “কোনো প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ ছাড়াই গুড়িয়ে দেওয়া হল জ্ঞানের আলো পাঠাগারটি। ভাঙার আগে কোনো প্রকার নোটিস দেওয়া হয়নি। কী কারণে ভাঙা হচ্ছে তাও জানানো হয়নি।
“গতকাল (রোববার) দিনভর নাটকীয়তার শেষে বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে, সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে ভেঙে ফেলা হয়। এতে আমাদের কোনো দুঃখ নেই। ওখানে নিজেদের কারোও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নাই।”
হতাশা প্রকাশ করে এতে বলা হয়, “আমাদেরকে বলা হয়েছিল ৩০ মিনিট সময় দিচ্ছি মালামালগুলো সরিয়ে ফেলুন। তখন আমরা বলি ওখান থেকে আমাদের সরানোর কিছু নাই। যা কিছু আছে তার মালিক ব্যক্তি নয়। সবকিছু জনগণের। তাই আমরা কিছু সরাতে বা ওখান থেকে নিতে পারব না।”
পাঠাগারের ফেইসুবক পোস্টে বলা হয়, “জেলা পরিষদ থেকে কোনো জায়গার বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠানের নামে হয় না। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তির নামে বন্দোবস্ত নিতে হয়। (তাই) জ্ঞানের আলো পাঠাগারের সভাপতি সুশান্ত মণ্ডলের নামে জায়গাটি বন্দোবস্ত নেওয়া হয়। প্রতিবছর যা নবায়ন করার কথা। নবায়ন ফি স্বল্পমূল্যে হওয়ায় আমরা প্রতি দুই বছর একসাথে করে নবায়ন করি। সর্বশেষ ২২-২৩ ও ২৩-২৪ সাল পর্যন্ত নবায়ন করা আছে।
“গতকাল (রোববার) আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা জানায় সংগঠনটির কোনো অনিয়ম থাকলে তদন্ত করা হোক। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এরকম সামাজিক সংগঠনটি যেন ভাঙা না হয়। তারপরও কেন ভাঙ্গা হলো বিষয়টি আমরা অবগত নই।”
এ ব্যাপারে গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত দেবনাথ বলেন, “পাঠাগারের জন্য সরকারি খাস জায়গা বন্দোবস্ত নিতে পাঠাগার কমিটির মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। সংশ্লিষ্ট দপ্তর তদন্তের পর সব কিছু ঠিক থাকলে পাঠাগারের জন্য জায়গা স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়। জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠানের নামে জায়গা বন্দোবস্ত দিতে পারে না। তাই জ্ঞানের আলো পাঠাগারের জন্য পাঠাগার কমিটির সভাপতি সুশান্ত মণ্ডলের নামে জেলা পরিষদের জায়গা এক সনা অস্থায়ী বন্দোবস্ত নেওয়া হয়। তারপর সেখানে পাঠাগার করা হয়। পাঠাগার করার জন্য এ জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি। বন্দবস্তের শর্ত ভঙ্গ করে পাঠাগার করা হয়েছে।
“এ ছাড়া সুশান্ত মণ্ডলের নামে নেওয়া এক সনা বন্দোবস্ত নবায়ন করা হয়নি। নবায়ন হালনাগাদ নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং জেলা পরিষদ সমন্বিতভাবে কোটালীপাড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করবে। এ কারণে গত রোববার কোটালীপাড়া উপজেলার ঘাঘর বাজার, মহুয়ার মোড় ও বাপার্ড এলাকা থেকে ১৯৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে। এর মধ্যে জ্ঞানের আলো পাঠাগারও রয়েছে।”
উচ্ছেদের সময় জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রবীর বিশ্বাস উপস্থিত ছিলেন। তার বক্তব্য জানার জন্য মঙ্গলবার রাতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি।
রোববার এ পাঠাগার উচ্ছেদের পর থেকেই এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে সমালোচনা করেন।
উচ্ছেদের বিষয়টি পাঠাগারের ফেইসবুক পেইজে পোস্টের পর মো. মেহেদী হাসান মুন নামে একজন মন্তব্য করেছেন, “এটা খুব খারাপ হয়েছে। এটা একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান। আমি মনে করি, ভাবা উচিত ছিল অনেক।”
সুশান্ত বণিক মন্তব্য করেছেন, “খুব কষ্ট লাগছে পাঠাগারটির জন্য।”
মহানাজ পারভীন, কামাল শেখ, মাধুরী শিকদারসহ অনেকে দুঃখপ্রকাশ করে ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এ বিষয়ে জ্ঞানের আলো পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহামান পারভেজ বলেন, “২০১৪ সালের ৮ মার্চ জ্ঞানের আলো পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে বিভিন্ন বয়সের মানুষ এখানে বসে বই পড়তেন। পাঠকরা এখান থেকে বই নিয়ে বাড়িতে পড়তেন।
পাশাপাশি পাঠাগারের সদস্যদের উদ্যোগে বিভিন্ন স্চ্ছোসেবামূলক, মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হত জানিয়ে তিনি বলেন, “শিক্ষা উপকরণ, বৃত্তি, কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে। ফেইসবুকের মাধ্যমে ফান্ড গঠন করে জটিলরোগে আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা শেষে বেঁচে যাওয়া টাকা রোগীর পরিবারকে দেওয়া হয়েছে।
“এ ছাড়া, ২০২২ সালের বন্যার সময় সুনামগঞ্জের তাহেরপুরে লাইব্রেরির পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তা করা হয়েছে। গত বছরের বন্যায় কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে লাইব্রেরির পক্ষ থেকে সহায়তাসহ বন্যাদুর্গতদের পাশে আমরা ছিলাম।”
তিনি বলেন, “কোভিড মহামারীর সময় আমরা কোটালীপাড়া উপজেলার প্রায় ৩০০ রোগীকে বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিল্ডার দিয়েছি। এক লাখ মাস্ক বিতরণ করেছি। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সচেতনামূলক প্রচার চালিয়েছি।”
পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক বলেন, “জ্ঞানের আলো পাঠাগার শুধু পাঠকের সঙ্গে বইয়ের মেলবন্ধ ঘটিয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা কাজ করে গেছি। এভাবে পাঠাগার উচ্ছেদ করা হবে, তা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।”
সোমবার জ্ঞানের আলো পাঠাগারের ফেইসবুক পেইজে আরও একটি পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে পাঠাগারের ইজারার চুক্তিপত্র, নবায়ন ফি’র রশিদের ছবিসহ ও পাঠাগার উচ্ছেদের ভিডিও যুক্ত করা হয়।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কে এম বাবর বলেন, “প্রশাসন বিধি মেনেই জ্ঞানের আলো পাঠাগারের কার্যালয় উচ্ছেদ করেছে । উচ্ছেদের সময় আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম।”