Published : 19 Jun 2025, 08:28 AM
তেত্রিশ বছর পর আন্দোলনের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও নির্দিষ্ট তারিখে আসলেই ভোট হবে কি-না তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও নানা শঙ্কা ও সন্দেহ রয়েছে।
সবাই ভোট চাইলেও কোনো সংগঠনই ‘শর্তহীন’ নয়। নিজ নিজ দাবির বিষয়ে তারা অনড়।
ক্রিয়াশীলী ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে যে মতদ্বৈততা রয়েছে, সেগুলোর সমাধান করে বা পাশ কাটিয়ে প্রশাসন আদৌ একটি সুষ্ঠু ভোটের আয়োজন করতে পারবে কিনা, সেই সক্ষমতার ওপরই দশম জাকসুর ভবিষ্যত নির্ভর করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষ করে ৫ অগাস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর ‘আওয়ামী লীগের দোসরদের বিচারের’ প্রসঙ্গটি সামনে আসায় এবং বিষয়টিকে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করায় জটিলতা বেড়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ।
তফসিল ও নির্বাচনের তারিখ দুইবার পেছানোর কারণেও এখন ৩১ জুলাই ভোটগ্রহণের জন্য যে দিন নির্ধারণ করা হয়েছে- তা নিয়ে ‘সন্দেহমুক্ত’ হতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা।
তফসিল ঘোষণার পর প্রায় ছয় সপ্তাহের বেশি সময় পার হলেও ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বাহ্যিকভাবে নির্বাচনের খুব বেশি তোড়জোর চোখে পড়েনি। যদিও ছাত্রনেতারা ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছেন।
জাকসু নির্বাচন নিয়ে এই অশ্চিয়তার বিষয়টি উঠে এসেছে নির্বাচন কমিশন সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মাফরুহি সাত্তারের বক্তব্যেও।
প্রশাসনে, এমনকি হলগুলোতে ‘ফ্যাসিবাদী আমলের সেটআপ’ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “নির্বাচন সঠিক সময়ে করা নিয়ে আমরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।”
কী কী চ্যালেঞ্জ সামনে আছে? এই শিক্ষক বলেন, “যেহেতু দীর্ঘ তিন দশক ধরে নির্বাচন হচ্ছে না, সুতরাং এটা খুব ভালো করে বোঝা যাচ্ছে বর্তমানের সবাই এই ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। এই অনভিজ্ঞতা নিয়ে জাকসু নির্বাচন করা কঠিন। এ ছাড়া আমাদের শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে সহনশীলতা কম।”
তবে নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক রাশিদুল আলম মনে করেন, নির্বাচন ‘সম্ভব’।
তিনি বলেন, “নির্বাচন করার মত পরিবেশ রয়েছে। সবকিছুই আগের চেয়ে উন্নতির দিকে। সবার সহযোগিতা থাকলে নির্দিষ্ট তারিখে খুবই আনন্দমুখর পরিবেশে নির্বাচন করা সম্ভব।”
অবশেষে রোডম্যাপ
৫ অগাস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে জাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অন্তত দুইবার পিছিয়ে আসে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর জাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ জানুয়ারি একটি খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বেরিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান সাংবাদিকদের জানান, রোডম্যাপ অনুযায়ী ১ ফেব্রুয়ারি তফসিল ঘোষণা করা হবে। যদিও নানা কারণে সেদিন কর্তৃপক্ষ তফসিল ঘোষণা করতে পারেনি।
তফসিল ঘোষণা না করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ জানায়, সেই তারিখ অনুযায়ী মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নির্বাচন হওয়ার কথা। আর সম্ভাব্য তফসিল ঘোষণার তারিখ ছিল নির্বাচনের ২১ দিন আগে, অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল।
৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করলেও ভোটের জন্য ২১ মে দিন না রেখে নির্বাচনের তারিখ দেওয়া হয় জুলাইয়ের ৩১ তারিখ।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ, পরিবেশ পরিষদ গঠন করেছে। হলে হলে মতবিনিময় সভা করে অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে গঠনতন্ত্রেও আনা হয়েছে পরিবর্তন-পরিবর্ধন।
জাকসু ও হত্যাকাণ্ড
জাকসুর প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭২ সালে। প্রথম জাকসুর নির্বাচিত ভিপি ছিলেন গোলাম মোর্শেদ। জিএস ছিলেন রোকনউদ্দীন। ভিপি সরাসরি কোনো দল না করলেও জিএস জাসদ ছাত্রলীগ করতেন।
সবশেষ নবম জাকসু নির্বাচন হয় ১৯৯২ সালের ৬ জুলাই। সেই নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মাসুদ হাসান তালুকদার, জিএস হন শামসুল তাবরীজ। তারা দুজনই ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন।
নয়টি জাকসুর নির্বাচিত ভিপি ও জিএসের মধ্যে দুজন নেতৃত্বে থাকা অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ১৯৭২ সালের জাকসুর নির্বাচিত জিএস রোকনউদ্দীন এবং ১৯৭৩ সালের জিএস মোজাম্মেল হককে প্রাণ দিতে হয়।
জাসদ ছাত্রলীগ করা প্রথম জিএসের নামে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে একটি লাইব্রেরি আছে। নাম ‘রোকন স্মৃতি গ্রন্থকেন্দ্র’। এটির নিয়ন্ত্রণ করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের একাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ও একই বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নুরুল হকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “৭২ সালের জাকসুতে নির্বাচিত ভিপি গোলাম মোর্শেদ ভাই সরাসরি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, তবে বাম ঘরানার ছিলেন। রোকনউদ্দীন সরাসরি জাসদ ছাত্রলীগ করতেন।
“রোকনউদ্দীন জিএস থাকা অবস্থায় একবার মোটরসাইকেলে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে যান। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় আততায়ীর গুলিতে রোকন মারা যান। সেখান থেকেই তার লাশ উদ্ধার করা হয়।”
১৯৭৩ সালের জাকসু নির্বাচনে অধ্যাপক নুরুল হক নিজে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে জাকসুর জিএস প্রার্থী ছিলেন।
সেই নির্বাচনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “দ্বিতীয় জাকসুর নির্বাচনে জিএস হন মুজিববাদী ছাত্রলীগের মোজাম্মেল হক। তিনিও জিএস থাকা অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আল বেরুনী হলের তার নিজ কক্ষে জানালা দিয়ে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়।
“গুলি করে হত্যার পর খুনিরা চলে যাওয়ার সময় সর্বহারা পার্টির স্লোগান দিতে শোনা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন।”
ফিরে দেখা: জাকসুর নয়টি নির্বাচন
১৯৭২- ভিপি- গোলাম মোর্শেদ, জিএস- রোকন উদ্দিন
১৯৭৩- ভিপি- রফিক উল্লাহ, জিএস- মোজাম্মেল হক
১৯৭৪- ভিপি- এম এ জলিল, জিএস- দোলোয়ার হোসেন
১৯৮০- ভিপি- আজাদ রহমান, জিএস- আতাউর রহমান
১৯৮১- ভিপি- মোতাহার হোসেন, জিএস- সামসুদ্দিন মাসুদ
১৯৮৯- ভিপি-এ কে এম এনামুল হক শামীম, জিএস- আজিজুল হাসান চৌধুরী
১৯৯০- ভিপি- আশরাফ উদ্দিন খান, জিএস- মো. আজগর হোসেন
১৯৯১- ভিপি- মো. মনিরুজ্জামান মনির, জিএস- কে এম রাশেদুল হাসান
১৯৯২- ভিপি- মাসুদ হাসান তালুকদার, জিএস- শামসুল তাবরীজ
নির্বাচন ও বিচারের দ্বৈরথ
৫ অগাস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ‘হামলাকারী আওয়ামী লীগের দোসরদের’ বিচারের দাবিটি সামনে আসে। প্রায় প্রতিটি সংগঠন প্রশাসনের ভেতরে থাকা ‘স্বৈরাচারের সুবিধাভোগীদের’ বিচারের দাবির সঙ্গে একমত হন। কারণ, তারা মনে করেন, প্রশাসনের ভেতরে ‘আগের সরকারের সেটআপ রেখে’ নির্বাচন করা চ্যালেঞ্জের।
তবে ‘বিচার আগে, নির্বাচন পরে’; ‘বিচার ও নির্বাচন পাশাপাশি চলতে পারে’; ‘ইসলামী ছাত্রশিবির প্রশ্নে আপত্তি’- এমন মতভিন্নতা ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে দেখা দেয়।
তার মধ্যে জাকসু নির্বাচনের আগে বিচারকাজ না হলে সবার অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করে ছাত্রদল।
আবার নির্বাচন চাইলেও তার আগে বিচার কার্যক্রম শেষ দেখতে চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
তবে ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ (অমর্ত্য) বলছে, নির্বাচন ও বিচারকাজ একসঙ্গে চলতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, “ছাত্রদলের প্রাণের দাবি জাকসু নির্বাচন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ছাত্রদলের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা এরই মধ্যে জাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য খসড়া তালিকা সম্পন্ন করেছি।”
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনও জুলাই-অগাস্টে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ এবং হামলার মদদদাতা ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের আওতায় আনেনি। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নেতাকর্মীরা অবস্থান করছে।
“ফ্যাসিবাদের দোসর শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আসীন রয়েছে। এই অবস্থায় আমরা মনে করি, সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব না।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক আবদুর রশীদ জিতু বলেন, “নির্বাচনের তফসিল নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়। তবে আমরা মনে করি, নির্বাচনের আগে জুলাই হামলার ঘটনায় জড়িত সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিচারের আওতায় আনা খুবই জরুরি। এইসব বিচার প্রক্রিয়ার অধিকতর তদন্ত চলমান রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, জুনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে।”
তিনি বলেন “আমরা বিশ্বাস করি, নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী তদন্ত কমিটি তাদের কার্যক্রম সম্পন্ন করবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে জাকসু নির্বাচন আয়োজনের জন্য বাকি কাজগুলোও অগ্রাধিকারভিত্তিতে সম্পন্ন করবে। আমরা জাকসু নির্বাচন চাই। তবে এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে অবশ্যই বিচার কার্যক্রম শেষ দেখতে চাই।”
বিচারকাজ ও নির্বাচন নিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের জাবি শাখার সেক্রেটারি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “জাকসু ও বিচারিক প্রক্রিয়া পাশাপাশি চলতে পারে; দুটিই জরুরি। প্রশাসনের এখতিয়ারভুক্ত শাস্তিগুলো দ্রুত কার্যকর করা উচিৎ। অন্যথায় তা নির্বাচন বাতিলের পরিকল্পনা বলে প্রতীয়মান হবে।”
ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের (একাংশ) সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, “জাকসু এবং বিচার কোনোটিকেই মুখোমুখি করতে চাই না। কারণ জুলাই হামলার বিচার যদি ধীরগতিতে হয় তাহলে জাকসুটা কার্যকর হবে না। আমরা চাই, ৩৩ বছর পর যেহেতু জাকসু হচ্ছে সেক্ষেত্রে জাকসুকে প্রাধান্য দিয়ে দুটি কাজই একসঙ্গে চলতে পারে। একটা আরেকটার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে পারে না। তফসিল অনুযায়ী জাকসু নির্বাচন হওয়ার যে তারিখ তা যেন ওই সময়েই হয়।”
ছাত্রফ্রন্ট জাবি শাখার সংগঠক সজিব আহমেদ বলেন, “জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। আমরা জাকসুর আয়োজন ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন একসঙ্গে করার আহ্বান জানিয়েছি প্রশাসনকে।
“যেহেতু জুলাইয়ের ৩১ তারিখ নির্বাচন, নির্বাচনের আগে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার করার জন্য প্রশাসন ঢের সময় পাবে। সুতরাং, আমাদের প্রত্যাশা থাকবে যাতে নির্বাচনের আগেই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। জাকসু নির্বাচন আয়োজন সুষ্ঠু হওয়া, বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে। ফলে দুটো কাজ একই সঙ্গে করা সম্ভব বলে মনে করি।”
বিচারকাজ জাকসু নির্বাচনের আগে সম্ভব কি-না জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বিচার প্রক্রিয়ার স্ট্রাকচারাল কমিটির প্রধান অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, “আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা আছে জাকসু নির্বাচনের আগেই যেন বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে জুন মাসের কথা বলেছি। এও বলেছি যে আরও কিছু বেশি সময় হলে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সুন্দর হত। তারপরও আমরা আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাব।”
জুনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ না করতে পারলে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রয়োজনে আবার সব অংশীজনের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেব।”
শিবির নিয়ে আপত্তি
জাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার শুরু থেকেই ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে মতবিরোধ ছিল। নির্বাচন এগিয়ে এলেও সেই মতবিরোধ খুব একটা কাটেনি।
যেমন- ২৯ এপ্রিলের পরিবেশ পরিষদের সভায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি থাকায় সভা ওয়াক আউট করেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রির সংগঠক সোমা ডুমরি এবং ছাত্রফ্রন্টের একাংশের সংগঠক সোহাগী সামিয়া। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশের সভাপতি ফাইজা মাহজাবিন ওই দিনের সভায় বলেন, “নির্বাচনে যদি শিবিরের উপস্থিতি থাকে তাহলে সেই নির্বাচনে তাদের আপত্তি থাকবে।”
‘সন্দেহ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্বের শিক্ষার্থী ঐন্দ্রিলা মজুমদার অর্না বলেন, “এর আগে প্রশাসন ৩০ ডিসেম্বর জাকসুর রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিল। সেই রোডম্যাপ অনুযায়ী মে মাসে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে পিছিয়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে ৩১ জুলাই। যখন এই তারিখ আসবে তখন যে নির্বাচন আবার পিছাবে না সেটার নিশ্চয়তা কী? প্রশাসনকে জাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে সন্দেহের চোখে দেখি।”
১৯৯৩ সালের অষ্টম তথা সর্বশেষ জাকসু থেকে সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন রুনু।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাকসু নিয়ে আলাপ হলে তিনি বলেন, “প্রত্যেকটা নির্বাচনই সুষ্ঠু হোক এটা আমরা চাই। কিন্তু ফ্যাসিস্ট রেজিমের রেখে যাওয়া সেটআপ দিয়ে নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান।
“রাষ্ট্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় কেউই এখনও বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি। সুতরাং বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন ও সেটআপ নতুন করে সাজিয়ে নির্বাচনের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। তাহলেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।”
১৯৯২ সালের জাকসু নির্বাচনে শহীদ সালাম-বরকত হল সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা নাজমুল মানছুর।
তিনি বলেন, “বিগত সময়ে রাজনীতিটা অনেকটা আবদ্ধ ছিল। আমাদের সময় যা প্রত্যাশিত ছিল এখন তা নেই। আমাদের সময় কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচন করতাম কে ভিপি-জিএস প্রার্থী হবেন, পুরো প্যানেলই কাউন্সিলের মাধ্যমে আসত। বর্তমান বাস্তবতায় সেটা সম্ভব?
“দেশে এবং ক্যাম্পাসগুলোতে নির্বাচনের প্র্যাকটিস নাই বহু বছর। এই প্র্যাকটিস না থাকাটা আমার ভয়ের কারণ। নির্বাচনের প্র্যাকটিস না থাকায় আনাড়ি লোক দিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন হলে সেটা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। জাকসু নির্বাচনের জন্য প্রশাসনের আরও কিছুদিন সময় নেওয়া উচিত।”
হলে হলে মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় নোটিস দিয়ে চলে যেতে বললেও তারা হল ছাড়ছেন না। এসব শিক্ষার্থীদের হলে রেখে শুধুমাত্র নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগে যে কোনো অঘটন ঘটতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, সহস্রাধিক শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে হলে আছেন। ৫ অগাস্টের আগে তারা ছাত্রলীগের নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সেখানে থাকতেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ জুলাই-অগাস্টের ছাত্র আন্দোলনেরও অংশ নেন। এখন আন্দোলনকারী ছাত্র সংগঠনের নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে হলের আসন নিয়ন্ত্রণে রাখছেন বলেও অভিযোগ আসছে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তৌহিদ সিয়া বলছিলেন, “মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার বিষয়ে সেই ফ্যাসিবাদী আমল থেকে আমরা আন্দোলন চালিয়ে আসছি। মাঝখানে একটা অভ্যুত্থান হয়ে গেল তারপরও মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। এটি নির্বাচনের পরিবেশকে খারাপ করতে পারে। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
“বিশেষ করে হল সংসদ নির্বাচনের জন্য এটি আরো খারাপ অবস্থার তৈরি করতে পারে। তাই ব্যাচভিত্তিক পর্যায়ক্রমে অতিদ্রুত মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে জাবি প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”
ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইমন কণ্ঠে ক্ষোভ তুলে বলেন, “এই প্রশাসন আর আগের প্রশাসনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আগের প্রশাসনও মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের হওয়ার জন্য একটা নোটিস ধরায়ে দিয়েছিল। এই প্রশাসনও ঠিক একই কাজ করছে। এই প্রশাসন যে জাকসু নির্বাচন চায় না, মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী হল থেকে বের না হওয়ায় সেটা প্রতীয়মান হয়।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি ও পরিবেশ পরিষদের সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলামের কণ্ঠে ফোটে অসহায়ত্ব।
তিনি বলেন, “হলগুলোতে প্রায় এক হাজারেরও বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী সিট নিয়ে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ এক বছর, কেউ কেউ দুই বছর এমনকি কেউ কেউ তিন বছর ধরে অবস্থান করছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কয়েকবার নোটিস করে সিট ছেড়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। হল প্রশাসনও বার বার নোটিস করেছে। কিন্তু কোনোভাবেই তারা হল ছাড়ছে না।
“বিভিন্ন সময় এই মেয়াদোত্তীর্ণরা জুনিয়রদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নানা রকম ইস্যু তৈরি করছে। হল প্রশাসনকে তাদের ইস্যুগুলো ফেইস করতে গিয়ে বৈরি পরিস্থিতির সন্মুখীন হতে হয়েছে। সামনে জাকসু নির্বাচন, জাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ বিধি অনুযায়ী হলগুলোতেই হয়ে থাকে। নির্বাচনকালীন এবং বর্তমানে হলগুলোতে মেয়াদোত্তীর্ণ সিনিয়র শিক্ষার্থীদের অবস্থান নির্বাচনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে বলে হল প্রশাসনগুলো শঙ্কা প্রকাশ করে আসছে।”
অধ্যাপক নজরুল বলেন, “এ অবস্থায় ৩০ জুনের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ নিশ্চিত না করতে পারলে হল প্রশাসনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”
সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর ভোট নেই
জাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার করা হলেও তাতে এমফিল, জিআইএস অ্যান্ড আইআরএস মাস্টার্স ও আইবিএ-জেইউ মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার রাখা হয়নি। ২৬ এপ্রিল বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় জাকসুর সংশোধিত গঠনতন্ত্র পাস হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সদস্যসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল গবেষক ওয়াসিম আহমেদ অনিক বলেন, “সর্বশেষ উপাচার্য আনোয়ার স্যারের সময় যখন জাকসুর তফসিল হয়েছিল তখন এমফিলের শিক্ষার্থীরা ভোটাধিকার পেয়েছিল। এই প্রশাসন আমাদের ভোটাধিকার রাখেনি।
“এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছি। বিগত ৩৩ বছর ধরে নির্বাচন হয়নি; এত বছর পরের একটি নির্বাচনে আমরা ভোটাধিকার প্রয়োগের আশা করতেই পারি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আশা করছি এটি সুনজরে দেখবেন।”
ভোটাধিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে জাকসুর গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংস্কার কমিটির প্রধান উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান বলেন, “এমফিল কিংবা অন্যান্য বিষয়ে যারা মাস্টার্স করছেন তাদের ভোটাধিকারে রাখা হয়নি। তাদের পক্ষ থেকেও কোনো আবেদন ছিল না।”
অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াসিম অনিক বলেন, “জাকসুর অংশীজনদের সভায় যদি অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের ডাকা হয় আর এমফিলের শিক্ষার্থীদের ডাকা না হয় তাহলে তো আমরা মতামত কিংবা কোনো ধরনের আবেদন করতে পারি না। আমাদের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য যদি আদালতে যাওয়া লাগে আমরা তা-ই করব।”
ভবনের ভগ্নদশা
৩৩ বছর ধরে বন্ধ থাকা জাকসু ভবন এখন অনেকটাই ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এখানে নিয়মিতই মাদকের আসর বসে। মেডিকেল সেন্টারের পাশের অন্ধকারাচ্ছন্ন, নোংরা এই ভবনটি তাদের জন্য অনিরাপদ।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ভবনটির প্রতিষ্ঠা ১৯৭২ সালে। সবশেষ ১৯৯২ সালে নবম জাকসু নির্বাচনের পর পর্যন্ত ভবনটি চালু ছিল।
সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের বাইরের নামফলকটি অস্পষ্ট, ভেতরে নেই কোনো আসবাবপত্র, নেই বৈদ্যুতিক সংযোগও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নাজিরুল ইসলাম বলেন, “জাকসু ভবনটি যেন এক কলঙ্কিত স্মারক। পাশের লেক থেকে আসা দুর্গন্ধ, জলাবদ্ধতায় ভবনের আশপাশের পরিবেশ রীতিমতো নরকে পরিণত হয়েছে।”
ভবনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে উপাচার্য ও জাকসু সভাপতি অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, “ভবনটি পরিদর্শন করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”