Published : 06 Jun 2025, 03:10 PM
কক্সবাজারের রামুতে মাদক পাচারসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত শাহীনুর রহমান শাহীন ওরফে ‘শাহীন ডাকাতকে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে; যিনি মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ‘অপরাধের সাম্রাজ্য’ গড়ে তোলেন বলে ভাষ্য সেনাবাহিনীর।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে শাহীন সীমান্তজুড়ে ব্যবহার করতেন সিসিটিভি ক্যামেরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে গেলে নিজের সোর্স ও এসব ক্যামেরায় সতর্ক বার্তা পেয়ে সহযোগীদের নিয়ে পালিয়ে যেতেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সকালে রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের জাউচপাড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর শাহীন চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য দিয়েছেন বলে জানান সেনাবাহিনীর রামু ১০ পদাতিক ডিভিশনের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনোয়ার হোসেন।
শক্ত সীমানাপ্রাচীর দিয়ে নির্মিত একটি বাড়ি থেকে ৩৫ বছর বয়সি শাহীনকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনীর একটি দল। শাহীনের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার দুই সহযোগীকে।
শাহীনের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, মাদক ও চোরাকারবারসহ বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ২০টি মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর গর্জনিয়া এলাকার বাসিন্দারাও মুখ খুলছেন। কেউ কেউ তাকে বলতেন সীমান্তের ‘ডন’।
সেনাবাহিনী বলছে, এরই মধ্যে সিসিটিভিসহ যে সব টেকনিক্যাল সরঞ্জাম রয়েছে সেগুলো জব্দ করা হয়েছে এবং ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। আগেও একাধিক অভিযান হয়েছিল; তখনও সিসিটিভি খুলে নেওয়া হয়েছিল। এখনও যেসব ক্যামেরা আছে সেগুলো র্যাব ও বিজিবির সহায়তায় খুলে নেওয়া হবে।
বিকালে সংবাদ সম্মেলনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনোয়ার বলেন, গোপন খবর পেয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. শাকের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে শাহীনকে আটক করা হয়েছে। পরে তার ডেরা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক, জাল টাকা ও ওয়াকি-টকি জব্দ করা হয়। শাহীন ইউপি সদস্য মো. শাকেরের মেয়ে জামাই।
তিনি বলেন, ২৫ মে র্যাব, বিজিবি ও পুলিশের যৌথ টহল দল শাহীনকে ধরতে অভিযানে নামলেও শাহীনের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
“ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে শাহীন ‘ত্রাস’ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। যার ফলে গর্জনিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় গরু ও মাদক চোরাচালান এবং আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতির ঘটনা ঘটে। এতে জনমনে আতঙ্ক ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে।”
শাহীন এতোটাই ভয়ঙ্কর ও দাপুটে ছিল, যে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা দলকে দীর্ঘদিন নজরদারি করতে হয়েছে বলে জানান মনোয়ার।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশনের চারটি টহল দল সমন্বিতভাবে একযোগে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে। এক পর্যায়ে শাহীনকে শাকের মেম্বারের বাড়ি থেকে আটক হয়।
শাহীনকে গ্রেপ্তারের পর গর্জনিয়া ইউনিয়নের শাকের মেম্বারের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ১০টির বেশি দেশি অস্ত্র, তিনটি একনলা বন্দুক, একটি একে ২২, ১০টি গুলি, চারটি কার্তুজ, ২০ হাজার ইয়াবাসহ জাল পাসপোর্ট জব্দ করা হয়।
সীমান্তে শাহীনের একচ্ছত্র আধিপত্য ও ‘ত্রাসের রাজত্ব’
স্থানীয়রা জানান, শাহীন ও তার বাহিনী সীমান্ত দিয়ে আসা গরু এবং চোরাচালান পণ্যের নিয়ন্ত্রণ করত। প্রতিদিন সীমান্ত দিয়ে ৫০০ থেকে এক হাজার গরু আসত; যা থেকে গরু প্রতি তিন হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করত তার লোকজন। শাহীনের অনুমতি ছাড়া কেউ কোনও কাজ করতে পারতেন না।
এ ছাড়া ইয়াবা, আইস, বিদেশি সিগারেটসহ চোরাচালান পণ্যের করিডোরও তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। রামুর গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে শাহীনের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বলে জানান স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, শাহীন বহু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। গরু ও মাদক পাচারে কেউ বাধা দিলে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হত। শাহীনের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ৩ মার্চ ইরফান এবং ২০২৪ সালের ১৬ মার্চ আবু তালেব ও ৮ মে আবুল কাশেমকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
শাহীনকে গ্রেপ্তারের খবর শোনার পর থেকে গর্জনিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার মানুষের মাঝে স্বস্তি বিরাজ করছে।
এর আগে ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি বান্দরবানের মেঘলা এলাকা থেকে শাহীনকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। পরে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
কক্সবাজার পুলিশ জানিয়েছে, শাহীনের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে নয়টি ডাকাতি, চারটি হত্যা, দুটি অস্ত্র, দুটি মাদক এবং বিভিন্ন থানায় আরও কয়েকটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে।
শাহীনের অন্য সহযোগীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে সেনা কর্মকর্তা মনোয়ার বলেন, “যেসব সহযোগী এখনো গ্রেপ্তার হয়নি, ক্লিয়ার ম্যাসেজ টু দেম, সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কফিল উদ্দিন বলেন, সীমান্তে শাহীনের যে চক্র ছিল এবং চক্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল সকলকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলমান থাকবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, শাহীনের যে সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো আছে সেগুলো আগের অভিযানে রেখে দেওয়া হয়েছিলো যাতে আমাদের পরবর্তী অভিযানে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
গ্রেপ্তারের পর এবার প্রশাসনের সহযোগিতায় জব্দ করা সিসিটিভি ক্যামেরাসহ শাহীনের সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিষয়ে কাজ করার কথা বলেছেন বিজিবির এই কর্মকর্তা।
র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান বলেন, “তিন মাস আগে ওই এলাকায় আমাদের অ্যাক্টিভিটি কম ছিল। কিন্তু মার্চের শুরু থেকে রমজান ও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে দিনরাত যৌথ টহলের মাধ্যমে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
“ঠিক একইভাবে কোরবানির ঈদের আগে চোরাই পথে যাতে গরু ও মাদক কিছুই না আসতে পারে সেজন্য র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী অভিযান চালায় এবং তারা সফলও হয়।”
গত বছরের চেয়ে এ বছর গরু চোরাচালান, মাদক পাচার উদ্বেগজনক হারে কমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত সপ্তাহেও বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করা হয়েছে। তিন থেকে চার দিন আগে ৪১টির মত গরু জব্দ করা হয়েছে।