Published : 19 Jun 2025, 05:14 PM
পাহাড়-সবুজ আর জলজে মোড়ানো অপার সৌন্দর্যের জেলা রাঙামাটিতে গোলাপি রংয়ের নতুন হাতির শাবক দেখা গেছে।
দুর্গম পাহাড়ি এলাকা বরকল উপজেলায় কাপ্তাই লেকে ১৩ জুন এ হাতির একটি ভিডিও ধারণ করেন স্থানীয় বাসিন্দা ও ইআরটি সদস্য (এলিফ্যান্ড রেসপন্স টিম) মো. জাহাঙ্গীর। পরে ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ভিডিওতে সেখানে একদল হাতি পানিতে সাঁতরাতে দেখা যায়। হাতির ওই দলে গোলাপি রংয়ের শাবকটির দেখা মেলে। এরপর থেকে ব্যতিক্রম রংয়ের এ হাতি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
ওই দলে মোট আটটি হাতি আছে। এর মধ্যে পাঁচটি পূর্ণ বয়সী, একটি কিশোর, দুটি শাবক। সবচেয়ে ছোট শাবকটি ‘গোলাপি রংয়ের’।
বন্যপ্রাণী গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলছেন, সম্প্রতি রাঙামাটি এলাকায় একটি হাতির বাচ্চা দেখা গেছে। হয়তো এই বছরেই জন্ম নিয়েছে। হাতির বাচ্চাটির রং স্বাভাবিক নয়; কিছুটা গোলাপি।
তিনি বলেন, “চামড়ায় যে রঞ্জক পদার্থ থাকা দরকার যদি সেটি স্বভাবিক না হয়, সেক্ষেত্রে অনেক সময় ফ্যাকাশে বা গোলাপি রংয়ের হয়। এই বাচ্চাটিও সেরকম। আমার জানা মতে, বাংলাদেশে এই রংয়ের হাতি দেখা যায়নি।
“আমাদের পাশের মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডে কিছু পোষা হাতি আছে যেগুলো এই ধরনের। বন্য এমনকি পোষা- কোনো অবস্থায়ই বাংলাদেশে এই রংয়ের হাতি দেখা যায়নি।”
উত্তেজনাপূর্ণ আর মুগ্ধতায় ভরা
দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় একদল হাতির পানিতে সাঁতরানোর ছবি-ভিডিওতে গোলাপি রংয়ের শাবকটিকে দেখা ছিল চমকে উঠার মত! এমন হাতির দেখা বাংলাদেশে আগে কখনো মেলেনি।
হাতির সাঁতরানোর ভিডিওটি দেখার পরই গোলাপি রংয়ের শাবক ও পুরো হাতি-দলের ছবি তোলার উদ্দেশ্যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম গিয়েছিল বরকলে।
তখন সবে আষাঢ় শুরু। কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি আর মাঝারি বৃষ্টি। তার মধ্যে চারপাশের সবুজ পাহাড়, মাঝ দিয়ে সরু পথ বা পাদদেশ ধরে চলা আর জলের ফোঁটা- এমনিতেই মুগ্ধ হওয়ার মত। তার উপর যেন নতুন প্রাণের দেখা পেতে মরিয়া আর উদগ্রীব; এক চরম উত্তেজনা।
বৃষ্টির ছাঁট পেরিয়ে হাতি বিচরণের নিকটবর্তী এলাকায় পৌঁছানোর বিষয়টি ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। কিছু সময় খোঁজার পর পাহাড়ের চূড়ায় হাতির দলটির সন্ধান পাওয়া যায়। হাতি যাতে উপস্থিতি টের না পায় সেজন্য বেশ দূর থেকে ছবি তোলার চেষ্টা করা হয়।
সেখানে আট সদস্যের হাতির মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় তিনটিকে ঘুমন্ত অবস্থায় আর অদূরে বটগাছের নিচে শাবকসহ আরও পাঁচটি হাতিকে বিশ্রাম করতে দেখা যায়। প্রায় এক ঘণ্টার বিশ্রাম শেষে হাতির দল একসঙ্গে বিচরণ করতে বের হয়। তখন পুরো দলটির ছবি তোলা হয়।
সবচেয়ে ছোট সদস্য গোলাপি হাতি শাবক। বয়স দেড় থেকে দুই মাস। মা হাতির সঙ্গেই হাঁটছিল সে। মা হাতি যেখানে দাঁড়াচ্ছিল, শাবকটি সঙ্গে সঙ্গে মায়ের পেটের নিচে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল। মা হাতিটি ছায়ার মতো করে গোলাপি হাতি শাবকটিকে আগলে রেখে চলছে। কখনও সাঁতরে লেক পার হচ্ছে, কখনও বা পাহাড় উঠানামা করছে।
২০২৩ সালে রাঙামাটির লংগদুতে হাতির বাচ্চার দেখা মিলেছিল। তবে সেটি ছিল অন্য বাচ্চাদের মতো কালচে এবং সারা শরীর লোমে আবৃত। এটি একেবারেই ভিন্ন। সাঁতরে লেক পার হওয়ার সময় শাবকটির শরীর ভিজে আরও গোলাপি হয়ে ওঠেছিল।
‘প্রথম তো বুঝতে পারিনি’
দীর্ঘদিন ধরে রাঙামাটির বরকল ও লংগদুতে হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করছে ইআরটি বা এলিফ্যান্ড রেসপন্স টিম। বর্তমানে তিনটি টিমে মোট সদস্য সংখ্যা ৪৬ জন।
ইআরটি সদস্য মো. জাহাঙ্গীরই প্রথম এই গোলাপি রঙের হাতিটি দেখতে পান। তিনি সেটি তার মোবাইল ফোনে ধারণ করেন।
জাহাঙ্গীর বলছিলেন “আমরা প্রায়ই এখানে হাতি দেখি। ১৩ জুন দেখি, আটটি হাতির দল একসঙ্গে সাঁতরে লেক পার হচ্ছে। ভিডিও স্বাভাবিকভাবে ধারণ করি। পরে ভিডিওটি কাছালংমুখ বনশুল্ক পরীক্ষণ ফাঁড়ি স্টেশন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম স্যারকে পাঠাই। মূলত নতুন হাতির শাবক জন্ম নিয়েছে সেটি ধারণ করতেই ভিডিও করি।
“প্রথম কিন্তু আমি সব স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিলাম। কিন্ত পরে গোলাপি রঙের হাতির বিশেষত্ব বুঝতে পারি। এই বাচ্চাটি অন্য বাচ্চা থেকে আলাদা তা জানতে পারি।”
কাছালংমুখ বনশুল্ক পরীক্ষণ ফাঁড়ি স্টেশন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, “বরকলের এসব এলাকায় হাতি সুরক্ষায় ইআরটি টিম গঠনের সুফল আমরা পাচ্ছি। কয়েক বছর পর নতুন শাবক জন্ম নিচ্ছে। গোলাপি শাবকটি বয়স দুই মাস হবে। ওইটার কাছাকাছি বয়সে আরও একটি শাবক রয়েছে। একটি কিশোর হাতি আছে এবং পাঁচটি বয়স্ক হাতিসহ শুধু এই টিমের সদস্য সংখ্যা আট। এর বাইরে লংগদুতে হাতি রয়েছে।”
শেরপুর আর রাঙামাটি- দুই বাস্তবতা
বাংলাদেশে হাতি বিচরণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য জায়গা হচ্ছে মেঘালয়-লাগোয়া শেরপুর সীমান্ত। টিলা সমৃদ্ধ এই এলাকা তুলনামূলক ঘনবসতিপূর্ণ। ফলে এখানকার হাতির বিচরণ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে।
সেই আতঙ্ক থেকে মানুষ জানমাল রক্ষায় নিরাপত্তা বেষ্টনির নামে যে ‘ফাঁদ’ তৈরি করে তা অনেকসময় হাতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। পাশাপাশি খাবারের চাহিদা ও ভূ-অবস্থানগত কারণে তা অনেক সময় মানুষের মৃত্যু ও ব্যাপক ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়ায়। যদি হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা দুই জায়গাতেই আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের আওতাধীন রাঙামাটির বরকল ও লংগদু এলাকায় হাতির সংখ্যা দিন দিন হাতির সংখ্যা বাড়ছে বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের সদ্য সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম জানান।
তিনি বলেন, “নতুন গোলাপি রংয়ের শাবকসহ এই অঞ্চলের হাতির সংখ্যা এখন প্রায় ১৪। এটি খবুই ইতিবাচক একটা দিক। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে মানুষের দ্বারা হাতি আক্রান্ত হলেও এসব এলাকায় তেমনটি ঘটে না। হাতি মানুষের ক্ষতি করলে বনবিভাগ ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। ফলে মানুষ হাতিকে আক্রমণ করছে না।”
বন্যপ্রাণী গবেষক অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, “হাতি একটি বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রাণী। আমরা সৌভাগ্যবান, বিপন্ন প্রাণীটি বাংলাদেশেও আছে। তবে খুব ভালো অবস্থায় নেই। হাতি যে জায়গায় রয়েছে সেখানে মানুষের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব বিদ্যামান। কারণ যেহেতু হাতি অনেক বড় প্রাণী। তার খাবারের প্রয়োজন পড়ে। সে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের বসতবাড়ি, ফসলের ক্ষেত ও বাগান ক্ষতিগ্রস্ত করে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি শেরপুর বা অন্য অঞ্চলের সঙ্গে রাঙামাটির তুলনা করি এখানে জনবসতি অনেকটা কম। পাহাড়ে পর্যাপ্ত খাবার আছে। কাপ্তাই লেক যেহেতু সব জায়গায় ঢুকে গেছে পানিও পাওয়া যায়।
“হাতির জন্য আর্দশ জায়গা রাঙামাটি। তবে আবাসস্থলের তুলনায় এখানে হাতির সংখ্যা কম। আমরা যদি স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনতে পারি তাহলে এখানে দীর্ঘ মেয়াদে হাতি টিকিয়ে রাখা যাবে।”
তিনি বলেন, “হাতি ঘুরে বেড়ায়, সে ছোট একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না। তার বিচরণ ক্ষেত্রগুলোতে যদি বন জঙ্গল জন্মানোর সুযোগ করে দেই, স্থানীয় উদ্ভিদ প্র্রজাতি যদি রোপণ করা হয় সেক্ষেত্রে হাতি সহজেই খাবার পাবে।”