Published : 31 May 2025, 12:51 PM
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় ধামর বেলতলি বাজারের মুদি দোকানদার সোলাইমান হোসেন সেলিম; সরকারি দপ্তরে ঘুরে ঘুরেও নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
তার এই বিপত্তির শুরু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক হত্যা মামলার কারণে।
আন্দোলনের সময় তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন, এমন অভিযোগে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
সেলিমের বড় ভাই গোলাম মোস্তুফা ওরফে মস্তু ডাকাতের (৫২) করা ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে- গত বছরের ৩ অগাস্ট যাত্রাবাড়ীর কাজলা পেট্রোল পাম্পের সামনে গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন সেলিম (৫০)।
মামলাটিতে সাক্ষী করা হয় তাদের দুই সহোদর হেলাল উদ্দিন (৫৫) এবং আবুল হোসেনকে (৫৪)। তারা সবাই ময়মনসিংহের ফুলাবাড়িয়া উপজেলার ধামর গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে।
জীবিত ব্যক্তিকে জুলাই আন্দোলনে নিহত দেখিয়ে এমন মামলায় হইচই পড়েছে ময়মনসিংহে।
অভিযোগ উঠেছে, প্রায় ২০ বছর আগে তাদের বাবা আব্দুল হাকিম মারা গেলে ভাইদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে দুই মেয়ের জনক সেলিমের কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় তার সহায়-সম্পত্তির প্রতি নজর পড়ে বাকি তিন ভাইয়ের।
তাই সম্পত্তি আত্মসাৎ করতেই জীবিত সোলাইমান হোসেন সেলিমকে মৃত দেখিয়ে উদ্দেশ্যসিদ্ধির ফন্দি আঁটেন মস্তু। সেজন্য অন্য ভাইদের সহায়তায় এমন মামলা করেন তিনি।
ভুক্তভোগী সোলাইমান হোসেন সেলিম বলেন, “মস্তু এলাকার চিহ্নিত ডাকাত। সে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে এর মধ্যে নিঃস্ব হয়েছে। শুনেছি ঢাকা শহরে বাস চালায়।
“প্রায় ১৫ বছর ধরে সে বাড়িতে আসে না। কিন্তু বাড়িতে না আসলেও বাকি দুই ভাইকে দিয়ে আমার সম্পত্তি গ্রাস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে মস্তু।”
তিনি বলেন, “আমার ছেলে সন্তান নেই বলে সবকিছু তাদেরকে লিখে দিতে বলে। তাদের অত্যাচারে ধামর বেলতলি বাজারে আড়াই শতক জমি কিনে বাড়ি ও দোকান করে চলছি। বাপের ভিটায় গেলেই ঝগড়া বাধে, তাই যাওয়া হয় না।”
তিনি আরও বলেন, “আমাকে মামলায় তারা মৃত দেখিয়েছে, সুযোগ পেলেই মেরে ফেলত। বিষয়টি বুঝতে পেরে একটু সতর্ক হয়েছি। কিন্তু পুলিশ কেন কিভাবে একটি ভুয়া মামলা নিল?”
মামলার কারণে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “পাঁচবার যাত্রাবাড়ী থানা এবং ডিবি অফিসে গেছি, আমি যে মরি নাই এটা প্রমাণ করতেই বেগ পাইতে হচ্ছে।”
সেলিমের স্ত্রী হাজেরা খাতুন বলেন, তার স্বামীকে হত্যা করতেই এই নাটক সাজিয়েছে তারই তিন ভাই। এর আগেও তারা সেলিমের ওপর হামলা চালিয়েছে। তখন এলাকাবাসীর সহায়তায় প্রাণ বাঁচে তার।
এ নিয়ে সেলিম ২০২২ সালে হেলাল এবং আবুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলাও করেন।
মস্তুর করা মামলার সাক্ষী হেলাল উদ্দিনের মেয়ে ঝুমি আক্তার বলেন, “শুনেছি মামলা হয়েছে কিন্তু বাবাকে কেন সাক্ষী করা হলো জানি না। আমরা এই ঘটনায় দায়ী না। মস্তু কাকা এসব করলে করতেও পারে।”
স্থানীয় রুহুল আমিন বলেন, “চার ভাইয়ের মধ্যে সেলিম নির্ভেজাল মানুষ। দোকান করে আর খায়। ঝামেলা এড়াতেই বাড়ি ছেড়ে বাজারে জায়গা কিনে দোকান এবং বাসা করেছে। কিন্তু তার ছেলে সন্তান না থাকায় ভায়েরা অগ্রিম জমি-জমা নিতে চায় যার জন্যই মূলত বিরোধ।
“এনিয়ে এতোবড় ষড়যন্ত্র হবে তা ভাবতেও পারিনি। একজন জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে মামলা করে ফায়দা লোটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যারা এটি করেছে তাদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।”
ময়মনসিংহ সমাজ রুপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘের সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “মামলা নথিভুক্ত করার আগে পুলিশের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। কারণ এতে একটি মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। অনেকে বিষয়টিকে হাস্যকর হিসেবে নিয়েছে। আমরা চাই ভুয়া মামলায় যেন কেউ হয়রানির শিকার না হয়।”
এদিকে স্থানীয় পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছেন। সেখানে পারিবারিক বিরোধের কারণেই জীবিত সেলিমকে মৃত দেখিয়ে তার ভাই মামলা করেছেন বলে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ফুলবাড়িয়া থানার ওসি মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান বলেন, “মস্তু এলাকায় একজন স্বীকৃত ডাকাত। তার নামে দুইটি হত্যা, একটি চাঁদাবাজি এবং একটি মারামারির মামলা রয়েছে।
“সে কম করে হলেও ১৫ বছর ধরে এলাকায় আসে না। কিন্তু সেলিমের জমি-জমা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা পেতেই হয়ত ভুয়া মামলাটি করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে লিখিত প্রতিবেদন দিয়েছি। এ বিষয়ে তারাই ব্যবস্থা নেবে।”
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে মামলার বাদী গোলাম মোস্তফা নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ডিবি ওয়ারীর এসআই আমিনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “সেলিম মৃত নন, সেজন্য আদালতে দুই ভাইকে সামনাসামনি ও তাদের ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে অন্য মামলা থাকায় সে পলাতক রয়েছে। তার মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাচ্ছি।”
মামলায় এখন পর্যন্ত একজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে জানিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, মামলাটির তদন্ত দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।