এশিয়ান কাপ বাছাই
Published : 10 Jun 2025, 07:52 AM
অনুশীলনের সময় প্র্যাকটিস স্ট্যান্ড পড়ে গেল। সেটি হাতে তুলে নিলেন হামজা চৌধুরী। বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় সামনের দিকে সূচালো ক্লিপ জোড়া লাগাতে পারলেন। সেটি পুনরায় গাঁথা হলো মাটিতে। ফের শুরু হলো অনুশীলন। এই দৃশ্যটুকুর মধ্যে ম্যাচের সম্ভাব্য প্রতিচ্ছবি এঁকে নেওয়া যায় কী? সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে রক্ষণের সাথে আক্রমণভাগের জোড়াটুকু তিনি লাগিয়ে দেবেন, শোমিত সোম-সোহেলরা বেঁধে দেবেন আক্রমণের সুর, তাতে পূর্ণতা দিতে মরিয়া থাকবেন ফাহামিদুল-রাকিবরা। ব্যাস।
এ মুহূর্তে পূর্ণতা মানে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে জয় পাওয়া। যেটি একমাত্র চাওয়া বাংলাদেশের। ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের তৃতীয় রাউন্ডের ম্যাচে এই চাওয়া পূরণ করতে সিঙ্গাপুরের মুখোমুখি হবে দল। ঘরের মাঠে, চেনা দর্শকের সামনে ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’ নিতে মুখিয়ে আছেন হামজা-জামালরা।
বাংলাদেশের চাওয়া আছে আরও অনেকগুলো। বিশেষ করে, বাছাইয়ের ‘সি’ গ্রুপের টেবিলে শীর্ষে ওঠার সম্ভাবনার হাতছানিতে সাড়া দেওয়া। এ মুহূর্তে ১ করে পয়েন্ট গ্রুপের চার দল বাংলাদেশ, ভারত, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের। একই দিনে হংকংয়ের মাঠে খেলবে ভারত। শীর্ষে ওঠার দুয়ার চার দলের জন্য উন্মুক্ত থাকায় ঢাকায়, হংকংয়ে আবহ একই।
গ্রুপের চার দলের মধ্যে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশই সবচেয়ে পিছিয়ে, ১৮৩তম। সবচেয়ে এগিয়ে ভারত, যাদের সাথে গত মার্চে শিলংয়ে গোলশূন্য ড্র করে আত্মবিশ্বাসে ফুটছে বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে নতুন করে দলে যোগ হওয়া প্রবাসীদের মধ্যে খেলেন হামজা চৌধুরী। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতা তিনি মেলে ধরেছিলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে, সুনিল ছেত্রি, লিস্টন কোলাসোদের অকেজো করে রেখে পয়েন্ট আদায় করে নেয় হাভিয়ের কাবরেরার দল।
বাকি দুই দলের মধ্যে হংকং ১৫৩তম, সিঙ্গাপুর ১৬১তম। সিঙ্গাপুর ম্যাচে হামজা তো আছেনই, কাবরেরা পাচ্ছেন ইতালির সেরি ‘ডি’তে খেলা ফরোয়ার্ড ফাহামিদুল ইসলাম ও কানাডা লিগে খেলা মিডফিল্ডার শোমিত সোমকে। শোমিত আসায় মাঝমাঠ নিয়ে ‘মধুর বিড়ম্বনায়’ পড়ার কথা বলেছেন কাবরেরা নিজেও।
সিঙ্গাপুর ম্যাচে পোস্টের নিচে মিতুল মারমার জায়গা নিশ্চিত। সেন্টার ব্যাকে অভিজ্ঞ তপু বর্মন ও কাজী তারিক রায়হায়ের জায়গা বলতে গেলে পাকা। রাইট ব্যাক ও লেফট ব্যাক হিসেবে ভুটানের বিপক্ষে ২-০ গোলে জেতা প্রীতি ম্যাচে দুই ভাই সাদ উদ্দিন ও তাজ উদ্দিনকে খেলিয়েছেন। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে হামজার সঙ্গে সোহেল রানা, অ্যটাকিং মিডফিল্ডে খেলান জামালকে। শোমিত আসায় মাঝমাঠে পরিবর্তন নিশ্চিত। ভুটান ম্যাচে গোলদাতা সোহেল, নাকি ভারত ম্যাচের মতো সিঙ্গাপুর ম্যাচেও জামালকে বেঞ্চে ঠাঁই নিতে হবে, তা খোলাসা করেননি কাবরেরা।
কোচ স্পষ্ট করে শুধু বলেছেন, সিঙ্গাপুর ম্যাচের লক্ষ্য। পুরো ৩ পয়েন্ট চাই তার। চাওয়া পূরণে সোমবার সন্ধ্যায় শেষ মুহূর্তের অনুশীলন সেরেছেন কোচ। সেখানে খেলোয়াড়দের দেখা গেছে প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি। গা গরমের ১৫ মিনিট বাদে সিঙ্গাপুরের অনুশীলন দেখার সুযোগ অবশ্য মেলেনি। আগের দিনও তারা প্রস্তুতি নিয়েছে ক্লোজ-ডোরে।
সংবাদ সম্মেলনে এসে দলটির জাপানি কোচ সুতোমু ওগুরাও ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে লক্ষ্য নিয়ে বেশি কিছু বলেননি। তার সাথে আসা মালদ্বীপের বিপক্ষে ৩-১ গোলে জেতা প্রীতি ম্যাচে জালের দেখা পাওয়া আমিরুল আদলিও রেখেছিলেন মুখে ছিপি দিয়ে! এর মধ্যেও দলটির কোচ ঠিকই দিয়েছেন বার্তা, তারা ‘ট্যুরিস্ট নন।’ আদলি বলেছেন, ম্যাচটা কেবল ‘হাজমার বিপক্ষে নয়, বাংলাদেশের বিপক্ষে।’ উপভোগের মন্ত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ খেলার কথা অবশ্য বলেছেন দুজনে।
পরিসংখ্যানের পাতায় অবশ্য দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেশ নেই তেমন একটা। স্বীকৃতি ম্যাচে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে কোনো জয়ের গল্প নেই। ১৯৭৩ সালে মারদেকা কাপে ১-১ ড্র, ২০১৫ সালের দেখায় ২-১ গোলে হেরেছিল দল।
ছয় ম্যাচের জয় খরাও সিঙ্গাপুর সম্প্রতি কাটিয়ে উঠেছে মালদ্বীপকে হারিয়ে। ওই ম্যাচে জালের দেখা পেয়েছিলেন আদলি, যিনি মূলত ডিফেন্ডার। জোড়া গোলের আলো ছড়িয়েছিলেন ইখসান ফান্দি; ২৬ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের কাঁধে বাংলাদেশ ম্যাচেও সওয়ার হতে চাইবেন ওগুরা। দলের নেতৃত্বে হারিস হারুন, ৩৪ বছর বয়সী এই অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার দশ বছর আগের ম্যাচে খেলেছিলেন বাংলাদেশের বিপক্ষে, জিতেছিলেনও।
এক দশক পরের ম্যাচে ‘প্রতিশোধের’ ডঙ্কা বাজানো কঠিন। কাবরেরাও সেটা চাইছেন না। তার চাই ৩ পয়েন্ট, এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এছাড়া চাওয়া স্থানীয়দের সাথে প্রবাসীদের মিথস্ক্রিয়া কতটুকু হলো, তার যাচাই করে নেওয়া। ইংল্যান্ডের আলো, বাতাসে বেড়ে ওঠা, সবশেষ মৌসুমে শেফিল্ড ইউনাইটেডে ধারে খেলা হামজা এরই মধ্যে মানিয়ে নিয়েছেন দলের সাথে।
গত মার্চের সেই ‘কাণ্ড’ পেছনে ফেলে ফাহামিদুল ফিরে এসেছেন। ভারত ম্যাচ সামনে রেখে সৌদি আরবে চলা ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলেন এই ১৮ বছর বয়সী তরুণ। কিন্তু সেখান থেকেই তিনি ফিরে যান ইতালিতে। বিতর্কের ঢেউ উঠেছিল, দলের অন্দরে চলা ‘সিন্ডিকেট’ নামের স্রোতে ভেসে যেতে হয়েছে ফাহামিদুলকে। এবার একটু আগেভাগে ঢাকায় ফিরে ক্যাম্পে তিনি কাটিয়েছেন পুরোটা সময়। ভুটান ম্যাচে গোল না পেলেও ড্রিবলিং, গতি, আর ফাঁকা জায়গা কাজে লাগানোর পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। আস্থাভাজন হয়ে উঠছেন কোচের।
শোমিত অবশ্য নতুন সতীর্থ, বাংলাদেশের কন্ডিশনের সাথে পুরোটা মানিয়ে নেওয়ার সময় পাননি খুব একটা। কানাডার চেয়ে ঢাকায় ‘গরম বেশি’, কথাটি তিনি ঘুরেফিরে বলেছেন অনেকবার। তবে, এই ২৭ বছর বয়সী খেলোয়াড় কাবরেরার মাঝমাঠের ছকে আছেন খুব ভালোভাবে। শোমিত দলের সাথে ‘মানিয়ে নিচ্ছে’, ‘টেকটিক্যাল, টেকনিক্যাল দিকে এবং টেকনিকে ভালো’, ‘সে গতিময়, বিনয়ী এবং প্রস্তুত’-কথাগুলো কোচ বলেছেন সংবাদ সম্মেলনেও।
এই প্রবাসীদের ঘিরে নতুন স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছে দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। হারানো সোনালি দিন ফিরে পেতে উন্মুখ তারা। সিঙ্গাপুর ম্যাচকে জামালও বলছেন দেশের ফুটবলের জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট।’ কাবরেরার কথায় ‘বাংলাদেশের মাঝমাঠ দক্ষিণ এশিয়ার দলগুলোর মধ্যে শক্তিশালী’, ভুটান এবং সিঙ্গাপুর কোচও অকপটে বলেছেন, শক্তি বাড়ছে বাংলাদেশের। সব মিলিয়ে এতদিন বদ্ধ থাকা সম্ভাবনার দুয়ারটি খোলার অপেক্ষায় সাফল্যবুভূক্ষ ফুটবলপ্রেমীরা।
কিন্তু যদি সিঙ্গাপুর ম্যাচে বদ্ধ দুয়ারটি না খোলে, তাহলে? সব কি শেষ? আবার উল্টোরথে ছোটা? শঙ্কামিশ্রিত এসব প্রশ্নের উঁকিঝুঁকিও কম নয়। স্প্যানিশ কোচ কাবরেরা অবশ্য বাস্তববাদী। সংবাদ সম্মেলনে জেতার লক্ষ্য প্রত্যয়ী কণ্ঠে বললেন, এক ফাঁকে ঠিকই বললেন উন্নতির ধারাবাহিকতায় থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
“সবসময় সবশেষ ম্যাচের চেয়ে আরও উন্নতির চেষ্টা করা প্রয়োজন। ভারতের বিপক্ষে আমরা খুবই ভালো করেছি। বিশেষ করে প্রাণশক্তি, নিবেদন দেখানোর ক্ষেত্রে এবং ভয়ডরহীন, খুবই সাহসী দল ছিলাম। কিন্তু এর বাইরে আরও অনেক দিকে উন্নতি করা প্রয়োজন, যদি আমরা বাছাইয়ে চার দলের মধ্যে সেরা হতে চাই। তো আমরা সেই দিকগুলো নিয়ে কাজগুলো করছি। আশা করি, তিন পয়েন্ট পাওয়ার জন্য কাজগুলো অতীতের চেয়ে আরও ভালোভাবে করতে পারব আমরা।”
বাংলাদেশের জন্য নিজেদের অতীত ম্যাচের পারফরম্যান্সকে ছাপিয়ে যাওয়ার ‘প্রথম’ পরীক্ষাও তাই সিঙ্গাপুর ম্যাচ। প্রস্তুতিতে হামজা যেভাবে ধরা দিলেন প্র্যাকটিস স্ট্যান্ড হাতে, হয়ত সময় নষ্ট হবে ভেবে নিজেই জোড়া দিতে লাগলেন, মাঠের লড়াইয়ে স্থানীয়-প্রবাসীদের মধ্যে সেই জোড়াটুকু লাগলেই তো বাংলাদেশ ফুটবল পেয়ে যায় সম্মুখপানে ছোটার সাহস।