Published : 08 Jun 2025, 04:54 PM
বাংলায় পুরোনো একটি প্রবাদ বলছে, শিল-পাটার ঘষায় প্রাণ যায় মরিচের। এই শিল-পাটা হচ্ছে ডনাল্ড ট্রাম্প আর ইলন মাস্ক। আর এখানে মরিচ হচ্ছে নাসা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের বাগযুদ্ধ চরমে। একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল গড়ে রাজনীতির মাঠে নামার জল্পনাও উস্কে দিয়েছেন মার্কিন ধনকুবের মাস্ক।
ট্রাম্পও পাল্টা বলেছেন, মাস্কের সঙ্গে তার সম্পর্ক এখন শেষ হয়ে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ডেমোক্র্যাটদের মাস্ক তহবিল দিলে এর পরিণতি গুরুতর হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
এমন অবস্থায় ট্রাম্প ও মাস্কের মধ্যে বড় খরচের একটি বিল নিয়ে বিরোধ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র বাজেট নিয়ে অনিশ্চয়তা। এ বিল নিয়ে বিরোধের জেরে নাসার বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট হতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
নাসা তাদের বাজেটের একটা খসড়া মার্কিন কংগ্রেসে জমা দিয়েছে, যেখানে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য যেসব প্রকল্প আছে, সেগুলোর বাজেট প্রায় অর্ধেকে কমিয়ে দেওয়া হতে পারে।
এতে মোট ৪০টি মহাকাশ মিশন রয়েছে, যেগুলোর এখন প্রস্তুতি চলছে বা এরইমধ্যে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
প্রেসিডেন্ট হুমকি দিয়েছেন, মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্স-এর সঙ্গে করা বিভিন্ন সরকারি চুক্তি বাতিল করে দেবেন তিনি। অথচ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মানুষ ও মালপত্র পাঠাতে নাসার একমাত্র ভরসা স্পেসএক্স-এর ফ্যালকন ৯ রকেট।
নাসা বলেছে, ভবিষ্যতে চাঁদ ও মঙ্গলে নভোচারী পাঠানোর পরিকল্পনাতেও স্পেসএক্সের রকেটের ওপরই নির্ভর করছে তারা।
‘ওপেন ইউনিভার্সিটি’র মহাকাশবিজ্ঞানী ড. সিমিয়ন বারবার বলছেন, নাসার বাজেট ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যেসব অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তা নভোচারী পাঠানোর মতো বিভিন্ন মহাকাশ মিশন কর্মসূচির ওপর “ভীতিকর প্রভাব” ফেলছে। এতে ধীর বা স্থগিত হয়ে যেতে পারে এই কার্যক্রম।
“গত এক সপ্তাহে ট্রাম্প-মাস্কের মধ্যে আমরা যেসব অবাক করা কথাবার্তা, হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্ত ও আগের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসা দেখেছি সেগুলো আমাদের স্বপ্ন ও লক্ষ্য গড়ার মূল ভিত্তিকেই নষ্ট করছে।
“মহাকাশ নিয়ে কাজের বেলায় সময় নিয়ে পরিকল্পনা করা দরকার এবং এসব কাজ সফল করতে হলে সরকার, কোম্পানি ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে মিলে কাজ করতে হয়।”
বিবিসি লিখেছে, এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ও মাস্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছাড়াও, নাসার বাজেট থেকে বড় ধরনের অর্থ কমানোর জন্য হোয়াইট হাউসের অনুরোধ নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞান, গবেষণা ও অন্যান্য সব খাতে অর্থ কমানোর লক্ষ্যে পরিকল্পনা হলেও কেবল মঙ্গলে নভোচারী পাঠানোর পরিকল্পনার জন্য আলাদা করে ১০ কোটি ডলার বরাদ্দ বাড়িয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসাডিনায় অবস্থিত ‘প্ল্যানেটারি সোসাইটি’র মহাকাশ নীতির প্রধান ক্যাসি ড্রেইয়ার বলছেন, নাসার বাজেটে কাটছাঁট হলো “যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ কর্মসূচির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংকট।”
‘প্ল্যানেটারি সোসাইটি’র মতো সংগঠন মূলত মহাকাশ গবেষণাকে উৎসাহ দিয়ে থাকে।
নাসা বলেছে, তাদের বাজেট কমানোর পরিকল্পনাকে তারা এমনভাবে সাজিয়েছে, যাতে চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহ গবেষণায় দরকারি বিভিন্ন কাজই বরাদ্দ পায়। অর্থাৎ, বাজেট কমলেও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মিশন যাতে থেমে না যায়।
‘ক্র্যানফিল্ড ইউনিভার্সিটি’র মহাকাশ বিশ্লেষক ড. অ্যাডাম বেকার বলেছেন, বাজেট কমানোর এসব পরিকল্পনা যদি কংগ্রেস অনুমোদন করে তবে এটা নাসার মূল লক্ষ্য ও কাজের ধরণ পুরোপুরি বদলে দেবে।
“নাসাকে দুটি কাজের লক্ষ্যে নতুন করে সাজাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। একটি হচ্ছে, চীনের আগে চাঁদে নভোচারী পাঠানো ও মঙ্গলে মার্কিন পতাকা বসানো। এ দুটি কাজই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধারণা তার। আর বাকি যে কোনও কাজ এর থেকে কম জরুরি ট্রাম্পের কাছে।”
যারা এসব প্রস্তাবের পক্ষে রয়েছেন তাদের ভাষ্য, হোয়াইট হাউসের বাজেট নাসাকে স্পষ্ট একটি লক্ষ্য দিয়েছে, যা ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকের অ্যাপোলো চাঁদে নামার সময়ের পর এটিই প্রথম। ওই সময় নাসার লক্ষ্য ছিল চাঁদে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারানো।
অন্যদিকে, নাসার সমালোচকরা বলেছেন, এখন বড় সংস্থা হিসেবে নাসা অনেক অগোছালো হয়ে গিয়েছে, যেখানে নিয়মিতভাবে অতিরিক্ত খরচের পাশাপাশি করদাতাদের অর্থও অপচয় করছে তারা।
নাসার অন্যতম বড় সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে, তাদের নতুন রকেট ‘স্পেস লঞ্চ সিস্টেম’ বা এসএলএস, যা আমেরিকান নভোচারীদের আবারও চাঁদে পাঠানোর পরিকল্পনার লক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে। এ রকেট উন্নয়নের জন্য অনেক সময় লেগেছে ও খরচও বেড়েছে। ফলে প্রতিটি রকেট উৎক্ষেপণে খরচ হচ্ছে চারশ ১০ কোটি ডলার।
সে তুলনায় মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানির স্টারশিপ রকেট প্রতি উৎক্ষেপণে কেবল খরচ হয় ১০ কোটি ডলার। কারণ এটাকে বারবার বা পুনরায় ব্যবহার করা যাবে এমনভাবেই তৈরি করেছে কোম্পানিটি।
নিজেদের নিউ গ্লেন রকেটের জন্য একই ধরনের খরচ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন ই কমার্স সাইট অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন কোম্পানিও।
বিবিসি লিখেছে, হোয়াইট হাউসের প্রস্তাব অনুসারে ধীরে ধীরে এসএলএস রকেটের ব্যবহার বন্ধ হবে এবং এদের জায়গা নেবে স্টারশিপ ও নিউ গ্লেন রকেট। তবে স্টারশিপের শেষ তিনটি পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ সফল হয়নি ও সম্প্রতি নিজেদের রকেট চাঁদে পাঠানো নিয়ে পরীক্ষার কাজ শুরু করেছে ব্লু অরিজিন।
ড. বারবার বলেছেন, “চিন্তার বিষয় হচ্ছে, নাসা হয়তো এক সমস্যার হাত থেকে বেরিয়ে এসে আরও বড় সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে।
“এসএলএস-এর বিকল্প হিসেবে যেসব রকেট তৈরি হচ্ছে, তাদের উন্নয়নের খরচ দিচ্ছেন ইলন মাস্ক ও জেফ বেজোস।
“তারা যদি এই কাজ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেন এবং স্পেসএক্স বা ব্লু অরিজিন নিজেদের রকেট উন্নয়নের জন্য আরও বেশি অর্থ চায় তাহলে মার্কিন কংগ্রেসকে তাদের সেই অর্থ দিতে হবে।”
ড. বারবার আরও বলেছেন, আরও বড় চিন্তার বিষয় হচ্ছে, বাজেট কাটার কারণে যেসব মিশন বাতিল হতে পারে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা। যেমন– জলবায়ু পরিবর্তন দেখা বা অন্য গ্রহে গবেষণা করা। এসব মিশনে অনেক দেশের সঙ্গে মিলে কাজ করা হচ্ছে, তাই এর প্রভাব আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পড়বে।
“যা তৈরি করতে অনেক সময়, পরিশ্রম ও সম্পদ লেগেছে তা হঠাৎ করে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে, অথচ পরে সেটা আবার কীভাবে গড়া হবে– সেই পরিকল্পনাটুকুও নেই। এটা ভীষণ দুঃখজনক ও চিন্তার বিষয়।”
বাজেট কাটছাঁটের ফলে যেসব প্রকল্প বাতিলের ঝুঁকিতে রয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলো গ্রহ অনুসন্ধান মিশন এরইমধ্যে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে এবং এসব মিশনের উন্নয়ন ও উৎক্ষেপণের খরচ আগেই দিয়েছে। এখন কেবল সেগুলো চালানোর খরচ কিছুটা কমানোর প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি, যেটা খুব বেশি সাশ্রয়ীও হবে না।
এ ছাড়াও হুমকির মুখে রয়েছে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা বা ইএসএ-এর সঙ্গে নাসার দুটি গুরুত্বপূর্ণ যৌথ মিশনও। যার একটি হচ্ছে, মঙ্গল গ্রহ থেকে নাসার পার্সিভ্যারেন্স রোভার যে পাথরের নমুনা সংগ্রহ করেছে সেগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা।
আরেকটি হচ্ছে, ইউরোপের রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন রোভারকে মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে সেখানে অতীতে কোনো প্রাণের চিহ্ন ছিল কি না, তা খুঁজে বের করার মিশন।