Published : 15 Jun 2025, 12:18 PM
নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত ও দাগওয়ালা চিত্রকর্ম ঠিক করা সাধারণত খুব সময়সাপেক্ষ ও যত্নশীল কাজ। যার জন্য কয়েক সপ্তাহ ও বছর এমনকি দশক সময় লাগতে পারে।
তবে এ ঘটনাকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে ‘ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’ বা এমআইটি’র তৈরি নতুন এক পদ্ধতি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ও বিশেষ এক ধরনের প্রিন্ট করা ‘মাস্ক’ ব্যবহার করে গবেষকরা এমন এক উপায় উদ্ভাবন করেছেন, যার মাধ্যমে নষ্ট ছবি ঠিক হবে কেবল কয়েক ঘণ্টায় এবং এতে করে ছবির মূল অবস্থাও বদলে যাবে না বলে দাবি তাদের।
এ কৌশলটি তৈরি করেছেন এমআইটি’র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পিএইচডি শিক্ষার্থী ও একজন শখের চিত্রকর্ম সারাইকারী অ্যালেক্স ক্যাশকিন। তিনি বিজ্ঞানী, আবার ছবি ঠিক করার কাজও ভালোবাসেন।
এ পদ্ধতিতে ডিজিটাল টুল ও ভৌত উপকরণের সংমিশ্রণ ব্যবহার করেছেন ক্যাশকিন। এ পদ্ধতিতে খুব পাতলা ও খুলে ফেলা যায় এমন ফিল্ম ব্যবহার করে আসল ছবির ওপর ডিজিটালভাবে ঠিক করা ছবির অংশ বসাতে পারেন পুরনো ছবির সারাইকর্মী।
শত শত বছর ধরে কোনও ছবি ঠিক করার মানে ছিল এর ছোট ছোট নষ্ট হয়ে যাওয়া অংশ বা দাগ খুঁজে বের করে তা খুব যত্ন সহকারে হাতে রং করে ঠিক করা। এজন্য রং মিশিয়ে আসল ছবির মতো রং বানাতে হত।
কিছু ছবিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া অংশ বা দাগের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। ফলে এসব ছবির প্রতিটা অংশে আলাদা করে যত্ন নিতে হয়। এ কাজ খুবই কঠিন ও শ্রমসাধ্য। এ কাজে বিশেষজ্ঞের ভালো বিচার ও দক্ষ হাতের প্রয়োজন হয় বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল টুল বিশেষজ্ঞদের সাহায্য করেছে ভার্চুয়ালভাবে চিত্রকর্ম ঠিক করতে। কাগে কেবল চিত্রকর্মের ঠিক করা সংস্করণ কম্পিউটার স্ক্রিন ও প্রিন্ট বা ছাপা মুদ্রণেই দেখা যেত। তবে চিত্রকর্মের এসব ডিজিটাল সংস্করণ এখন পর্যন্ত সহজে মূল শিল্পকর্মে ফিরিয়ে আনা যায়নি।
ক্যাশকিনের নতুন পদ্ধতিতে প্রথমে এআই ব্যবহার করে নষ্ট ছবিটি স্ক্যান করা হয়। এ সময় কম্পিউটার ‘ধারণা করে’ ছবিটি প্রথম তৈরি হওয়ার সময় কেমন ছিল। তারপর একটি প্রোগ্রাম ঠিক করে দেয় কোথায় কোথায় ঠিক করার দরকার ও এতে কোন কোন রং ব্যবহার করতে হবে।
এসব তথ্য খুব পাতলা এক ধরনের পলিমার ফিল্মের ওপর দুই স্তরের মাস্ক হিসেবে ছাপা হয়। এক স্তরে রঙিন ছবির সব বিস্তারিত অংশ থাকে ও অন্য স্তরে সাদা একটা বেইস থাকে। যাতে ছবির বিভিন্ন রং স্পষ্ট ও সঠিকভাবে দেখা যায়।
পাতলা এক প্রলেপ ব্যবহার করে মাস্কটি ছাপানোর পর তা খুব যত্ন করে মূল ছবির ওপর বসানো হয়। আর, এ মাস্কটি এমন উপাদান দিয়ে তৈরি যে, সহজেই সরিয়েও ফেলা যায়, যা চিত্রকর্মের কোনও ক্ষতি করবে না। এ মাস্কের ডিজিটাল ফাইলও সংরক্ষণ করা যায়। যাতে ভবিষ্যতের যারা ছবিটা ঠিক করবেন তারা বুঝতে পারেন ঠিক কী পরিবর্তন হয়েছিল এই চিত্রকর্মে।
সম্প্রতি এক প্রদর্শনীতে ১৫শ শতকের প্রাচীন একটি তেলরংয়ে আঁকা চিত্রকর্মে এ নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে সেটিকে দ্রুত ও দক্ষভাবে ঠিক করে দেখিয়েছেন ক্যাশকিন। প্রাচীন এ চিত্রকর্মে হাজার হাজার দাগ ছিল।
এ পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঁচ হাজার ছয়শ ১২টি নষ্ট অংশ খুঁজে বের করে সেগুলো ঠিক করতে ৫৭ হাজারেও বেশি ভিন্ন ভিন্ন রং ব্যবহার করেছেন ক্যাশকিন। এতে সময় লেগেছে কেবল সাড়ে ৩ ঘণ্টা।
ক্যাশকিন বলেছেন, আগে এমন একটি চিত্রকর্ম নিজ হাতে ঠিক করতে খণ্ডকালীনভাবে ৯ মাস কাজ করতে হয়েছিল তার।
তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, নতুন প্রযুক্তি শক্তিশালী হলেও এটিকে দায়িত্বের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। নৈতিক কিছু বিষয়ও বিবেচনা করতে হবে, বিশেষ করে শিল্পীর মূল উদ্দেশ্য রক্ষার বিষয়ে। তার ধারণা, এ পদ্ধতিটি সবসময় প্রশিক্ষিত সংরক্ষণকারী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মিলে ব্যবহার করা উচিত, যারা ছবির ইতিহাস ও তাৎপর্য বোঝেন।
চিত্রকর্ম ঠিক করার জন্য দরকারি সময় কমিয়ে আনতে চাইলে নতুন পদ্ধতি দরকার– ক্যাশকিনের মধ্যে এ ভাবনাটি এসেছে ২০২১ সালে তিনি যখন প্রথম তিনি এমআইটি’তে যান। সে সময় বেশ কিছু আর্ট গ্যালারি দেখার পর তিনি বুঝতে পারেন, অনেক ছবি ভাঙাচোরা বা নষ্ট হওয়ায় সেগুলো সংরক্ষণাগারে ফেলে রাখা হয়। কারণ এসব চিত্রকর্ম ঠিক করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন।
তিনি আশা করছেন, এ নতুন পদ্ধতিতে পুরনো ও হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন চিত্রকর্ম নতুন ‘জীবন’ পাবে এবং আরও বেশি মানুষ এসব শিল্পকর্ম দেখতে পারবেন।