Published : 05 Jun 2025, 11:17 PM
গত কয়েক দিনের স্মৃতি এখনও শরীর কাঁপিয়ে দেয় সোনা বানুর।
আসামের বরপেটা জেলার বাসিন্দা ৫৮ বছর বয়সী এই নারী বলেন, ২৫ মে তাকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে ডেকে নেওয়া হয়। এরপর তাকে সীমান্তের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে আরও প্রায় ১৩ জনের সঙ্গে জোর করে ঠেলে দেওয়া হয় বাংলাদেশে।
তার সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে বিবিসি।
সোনা বানু বিবিসিকে বলছেন, কেন এমন করা হল, সে বিষয়ে তাকে কিছুই বলা হয়নি। জীবনের অধিকাংশ সময় আসামেই কেটেছে তার এবং তার পরিবারের। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তাকে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে হয়েছে যে, তিনি ভারতের নাগরিক, ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ নন।
চোখ মুছতে মুছতে এই নারী বলছিলেন, “আমাকে বন্দুক ঠেকিয়ে তারা সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেয়। দুই দিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে হাঁটুপানি ডোবা একটা মাঠে আমাকে কাটাতে হয়েছে। ওই জায়গাটা মশা আর জোঁকে ভর্তি।”
সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ দুই দিন থাকার পর তাকে বাংলাদেশ অংশে একটি পুরনো কারাগারের মতো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাটেন আরো দুই দিন। পরে তাকে এবং আরও কয়েকজনকে সীমান্তে নিয়ে যান বাংলাদেশি কর্মকর্তারা। সেখানে ভারতীয় কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের দেখা হয়। পরে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বিবিসি লিখেছে,ঠিক কী কারণে সোনা বানুকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হল, তা স্পষ্ট নয়। তবে গত কিছুদিনে আসামে এরকম আরো ঘটনা ঘটেছে। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে ‘বিদেশি’ ঘোষিত ব্যক্তিদের ধরে সীমান্তে নিয়ে গিয়ে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি লিখেছে, সোনা বানুর মত অন্তত ছয়জনের সঙ্গে তারা কথা বলেছে, যাদের পরিবার এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে।
কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী, আসাম পুলিশ বা রাজ্য সরকারের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভারতে বৈধ কাগজপত্রহীন বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান নতুন নয়। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে ৪০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক জটিল সীমান্ত, যার বেশ কিছু অংশ খোলা এবং অনিয়ন্ত্রিত। অনেক জায়গা দিয়েই অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার তুলনামূলকভাবে সহজ।
মানবাধিকার আইনজীবীরা বলছেন, কাউকে বাড়ি থেকে ধরে এনে বিচার ছাড়াই অন্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার এমন ঘটনা আগে ‘বিরল’ হলেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে।
এই অভিযানে কতজনকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি ভারত সরকার। তবে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বরাতে বিবিসি লিখেছে, মে মাসেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে অন্তত ১২০০ জনকে ‘অবৈধভাবে ঠেলে পাঠানো হয়েছে’, যাদের মধ্যে ১০০ জনকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে শনাক্ত করে বাংলাদেশ ফেরত পাঠায়।
এক বিবৃতিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ জানিয়েছে, তারা সীমান্তে টহল জোরদার করেছে।
বিবিসি লিখেছে, ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে অনেক রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে ভারত। তবে আসামের পরিস্থিতি আরও জটিল। জাতীয়তা ও অভিবাসনের বিষয়টি বহু বছর ধরেই স্থানীয় রাজনীতিতে আলোচিত একটি বিষয়।
ভারতের এ রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, এবং ঐতিহাসিকভাবেই ওই সীমান্ত অভিবাসনের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
স্থানীয় আসামিদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে এই অভিবাসনের ফলে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি এবং সম্পদের ওপর চাপ পড়ছে।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), যারা এখন আসামসহ কেন্দ্রীয় সরকারেও ক্ষমতায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে ‘অবৈধ অভিবাসন’ ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। এর অংশ হিসেবে আসামে চালু করা হয়েছে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) প্রক্রিয়া।
ওই নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় যারা বাদ পড়েছেন, তাদের ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে আসামে বসবাসের প্রমাণ দিতে বলা হয়। প্রমাণ না থাকলে ট্রাইব্যুনালে শুনানির সুযোগ দেওয়া হয়।
২০১৯ সালে প্রকাশিত চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় বাদ পড়েন প্রায় ২০ লাখ মানুষ, যাদের কেউ কেউ এখনো বন্দি শিবিরে আছেন, আর কেউ কেউ উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।
সোনা বানুর দাবি, তার মামলাও ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। তবু তাকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল।
সোনা বানুর মত আসামের আরো ছয়জনের ঘটনা উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে, তারা সবাই মুসলমান, তাদের মধ্যে অন্তত চারজন আবার আসামে পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছেন।
এই পরিবারগুলোর ভাষ্য, সব বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও এবং বহু বছর ধরে আসামে থাকার পরও তাদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। কেন তাদের সঙ্গে এমন করা হল, তা তারা জানেন না।
আসামের ৩ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মুসলমান। তাদের অনেকের পূর্বপুরুষ সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আসামে বসবাস করে আসছেন।
যাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন ৬৭ বছর বয়সী মালেকা খাতুন। আসামের বারপেটায় তার বাড়ি।
ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে মামলা হারার পর হাই কোর্টে গিয়েছিলেন মালেকা, তাতে লাভ হয়নি। এরপর আর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেননি তিনি।
বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার পর আপাতত স্থানীয় এক পরিবারে আশ্রয় পেয়েছেন মালেকা। বিবিসিকে তিনি বলেন, “এখানে আমার কেউ নেই।”
পরিবারের সদস্যরা আসাম থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হলেও তারা জানেন না, মালেকা আবার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন কি না।
এভাবে দলে দলে মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া শুরুর পর আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা গত ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশনার কথা তোলেন।
তিনি বলেন, যারা ‘ভারতের বৈধ নাগরিক নয়’ বলে প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু এখনো যাদের বন্দিশালায় রাখা হয়েছে, তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠাতে বলেছে আদালত।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, “যারা ভিনদেশি ঘোষিত হয়েছে, এখনো আপিল করেনি, তাদের আমরা ফেরত পাঠাচ্ছি। যাদের আপিল নিষ্পত্তি হয়েনি, তাদের কোনো সমস্যা হবে না।”
তবে এ ধরনের অনেক মামলায় আইনি সহায়তা দেওয়া আব্দুর রাজ্জাক ভূইয়া বিবিসিকে বলেছেন, আদালতের ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গেলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কথা, তা করা হচ্ছে না।
তার ভাষায়, এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতে আদেশের ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে সীমান্ত দিয়ে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে।
এই ‘অবৈধ পুশ ব্যাক নীতি’ বন্ধে আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়ে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছিলেন রাজ্জাক। কিন্তু তাদের প্রথমে আসাম হাই কোর্টে আবেদন করতে বলা হয়েছে।
বারপেটা থেকে প্রায় ১৬৭ কিলোমিটার দূরে মোরিগাঁওয়ের এক বাসায় কাগজপত্রের স্তূপ ভর্তি একটি টেবিলের পাশে বসে ছিলেন রীতা খানম।
তার স্বামী খাইরুল ইসলাম একজন স্কুলশিক্ষক, বয়স ৫১ বছর। সোনা বানুর সঙ্গে যাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, সেই দলে খাইরুলও ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল ২০১৬ সালে তাকে বিদেশি ঘোষণা করে, যার পর তিনি দুই বছর একটি বন্দিশিবিরে ছিলেন, পরে মুক্তি পান। সোনা বানুর মত তার মামলাও এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।
খাইরুল ইসলামের মাধ্যমিক পরীক্ষার সনদ এবং কিছু জমির দলিল দেখিয়ে রীতা খানম বলেন,
“প্রত্যেকটা কাগজই প্রমাণ করে যে আমার স্বামী ভারতীয়। জাতীয়তা প্রমাণের জন্য এত কিছু দেখানোর পরও তা কর্তৃপক্ষের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি।”
রীতা বলেন, তার স্বামী, শ্বশুর ও শ্বশুরের বাবা—তিনজনই ভারতে জন্মেছেন। তারপরও গত ২৩ মে পুলিশ তাদের বাড়িতে এসে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই খাইরুলকে তুলে নিয়ে যায় বলে তার স্ত্রীর অভিযোগ।
কয়েক দিন পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও থেকে রীতা তার স্বামীর খোঁজ পান। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, এক বাংলাদেশি সাংবাদিক ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ খাইরুল ইসলামের সাক্ষাৎ নিচ্ছেন।
সোনা বানুর মত খাইরুল ইসলামকেও পরে ফেরত পাঠানো হয় ভারতে। তবে স্থানীয় পুলিশ বিবিসিকে বলেছে, খাইরুলের ফেরার কোনো তথ্য তাদের কাছে ‘নেই’।
খাইরুলকে যেদিন বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছিল পুলিশ, সেই একই রাতে আবদুল লতিফকেও তুলে নেওয়া হয়েছিল। তার মেয়ে সাঞ্জিমা বেগমের দৃঢ় বিশ্বাস, তারকে ‘ভুল করে’ বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছে।
“আমার বাবার নাম আবদুল লতিফ, আমার দাদার নাম আবদুল সুবহান। কিন্তু [বছর কয়েক আগে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে আসা] নোটিসে লেখা ছিল আবদুল লতিফ, পিতা শুকুর আলি। উনি আমার দাদা নন, আমি তাকে চিনিই না,”
সাঞ্জিমা বিবিসিকে বলেন, তার কাছে তার বাবার নাগরিকত্ব প্রমাণের সব কাগজপত্রই আছে।
তাদের পরিবার খবর পেয়েছে, আবদুল লতিফ আবার আসামে ফিরে এসেছেন, তবে এখনো বাড়ি ফেরেননি।
যারা পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছেন, তাদের মনেও আশঙ্কা রয়েই গেছে—আবারও যদি তুলে নেওয়া হয়?
সাঞ্জিমা বেগম বলেন, “আমরা তো মানুষ, খেলনা নই যে এভাবে ইচ্ছামত এদিক-ওদিক ছুঁড়ে ফেলা যাবে।”