Published : 19 Jun 2025, 04:58 PM
তেহরানের দক্ষিণে পাহাড়ের চাদরে গোপন রাখা একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা গুঁড়িয়ে দিতে চাওয়া ইসরায়েলিদের কাছেও এই স্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ কম নয়।
তেল আবিব হয়তো ইরানের আকাশে আধিপত্য দেখাতে পারছে, কিন্ত ফরদো পারমাণবিক স্থাপনাটি এখনো তাদের অস্ত্রশস্ত্রের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে, লিখেছে বিবিসি।
ইরানের এই পরমাণু স্থাপনাটি মাটির অনেক গভীরে অবস্থিত। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে যুক্ত করেছে যে ভূগর্ভস্থ টানেল, সেটি মাটির যতটা নিচে, ফরদো তার চেয়েও অনেক নিচে বলে ধারণা করা হয়।
কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই এমন এক বোমা আছে, যা দিয়ে ভূগর্ভস্থ এই ফরদো স্থাপনা ধ্বংস করা যাবে বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু ওই পদক্ষেপের বিপদও আছে। যুক্তরাষ্ট্র এমন হামলা চালালে তাকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় যুদ্ধও বেধে যেতে পারে।
ফোরদো সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র
রাজধানী তেহরানের ৯৬ কিলোমিটার দক্ষিণে ফরদোতে অবস্থিত এ সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রটি কোম শহরের কাছে একটি পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত।
ফোরদো স্থাপনায় মাটির নিচে থাকা সিরিজ টানেলগুলো মূলত ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী ব্যবহার করতো। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরে সেখানে একটি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের উপস্থিতির খবর পায়। পরে ২০০৯ সালে তেহরানও ফরদোর সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়।
ধারণা করা হয়, এই ভূগর্ভস্থ স্থাপনার দুটি প্রধান টানেলে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধে ব্যবহৃত সেন্ট্রিফিউজগুলো রাখা আছে, তাদের সঙ্গ দিচ্ছে ছোট ছোট অসংখ্য টানেলের নেটওয়ার্ক।
এটি ধ্বংস করা অসম্ভব?
ফোরদোর এ স্থাপনাটি মাটির অনেক গভীরে অবস্থিত হওয়ায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পড়েছে বিপাকে।
এ ধরনের স্থাপনার কার্যকর কোনো ক্ষতি সাধন করতে লাগবে ‘বাঙ্কারবিধ্বংসী’ গোলা, যা মাটি ছেদ করে আঘাত হানতে পারে।
ইসরায়েলের কাছে এ ধরনের বোমা আছে বলেই ধারণা করা হয়, কিন্তু সেগুলো ক্ষতি করতে পারে মাটির নিচে ৩৩ ফুট পর্যন্ত থাকা স্থাপনার। এ কারণে তারা আকাশপথে হামলা চালিয়ে কোনোভাবেই স্থাপনাটির তেমন কার্যকর ক্ষতি করতে পারবে না বলেই অনুমান বিশ্লেষকদের।
এক্ষেত্রে তেল আবিবের ত্রাতা হতে পারে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। তাদের কাছেই আছে এমন বোমা যা হয়তো ফোরদোকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে—১৩ হাজার কেজির চেয়েও ভারি জিবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ ওর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি)।
ওজন এবং ভারী খোলসের সাহায্য নিয়ে বোমাটি ৬০ ফুট পর্যন্ত কংক্রিট কিংবা ২০০ ফুট পর্যন্ত মাটির গভীরে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, বলেছেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা কোম্পানি জেনসের এক বিশ্লেষক।
কিন্তু এমওপি-র এমন এক আঘাতেই যে ফোরদো ধ্বংস হবে তার নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ ভূগর্ভস্থ স্থাপনাটি মাটির ২৬২-২৯৫ ফুট নিচে বলে অনেকের অনুমান।
এটি ইরানের অন্য ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা নাতাঞ্জের চেয়েও অনেক গভীরে অবস্থিত। নাতাঞ্জের সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাটি মাটির ৬৫ ফুট নিচে অবস্থিত বলে অনুমান বিশ্লেষকদের।
ইসরায়েল এরই মধ্যে তেহরানের কাছের এই নাতাঞ্জ স্থাপনায় একাধিক হামলা চালিয়েছে, তাদের হামলায় স্থাপনাটি ‘পুরোপুরি ধ্বংস না হলেও এর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি’ হয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু ফোরদো? এমনকী যুক্তরাষ্ট্রের এমওপি’ও এ স্থাপনার ক্ষতি করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান আইরিশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাবেক প্রধান, ভাইস অ্যাডমিরাল মার্ক মেলেট।
তার ভাষ্য, ভূগর্ভস্থ টানেলগুলো কতটা শক্তিশালীভাবে বানানো হয়েছে, তার ওপরই যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘বাঙ্কারবিধ্বংসী’ বোমার সফলতা নির্ভর করছে।
“ইরান এই ধরনের গোলা বা বোমার কথা জেনে থাকতে পারে। তাদের এটাও জানা থাকতে পারে যে এ ধরনের বোমার আঘাতের বাইরে থাকতে কি করা লাগবে। সে কারণেই ফোরদোর স্থাপনাটি এই (জিবিইউ-৫৭) গোলারও নাগালের বাইরে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে,” বলেছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই ‘বাঙ্কারবিধ্বংসী’ এমওপি ব্যবহার করবে কিনা, তার লক্ষণ বোঝা যাবে তাদের বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমানকে কাছাকাছি দেখা গেলে।
কেবল বি-২ বোমারু বিমানই এই বোমাগুলো বহন করতে পারে।
কিছুদিন আগে ইরান থেকে তিন হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরে দিয়েগো গার্সিয়ার মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে ওয়াশিংটন কয়েকটি বি-২ বিমান মোতায়েন রেখেছিল। এই দূরত্ব থেকে বিমানগুলো সহজেই ফোরদো স্থাপনায় প্রায় ২১ ফুট লম্বা এমওপি বোমা ফেলতে পারবে।
উপগ্রহের ছবিতে এপ্রিলের শুরুতেও দিয়েগো গার্সিয়ার ঘাঁটিতে ছয়টি বি-২ বোমারু বিমান দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ছবিতে সেগুলোর উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে না থাকলেও এই বোমারু বিমানগুলো ইরানের কাছাকাছি অন্যান্য ঘাঁটিতেও থাকতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সৈন্য উপস্থিতি জোরদার করেছে। বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে অনেক যুদ্ধবিমান মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে এসেছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের পথে রয়েছে বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিট্জ নেতৃত্বাধীন ‘আক্রমণকারী নৌযানের’ দলও।
যুক্তরাজ্যের রাজকীয় বিমানবাহিনীর সাবেক ডেপুটি অপারেশন চিফ এয়ার মার্শাল গ্রেগ ব্যাগওয়েল মনে করছেন, দিয়েগো গার্সিয়া থেকে অভিযান চালালেই বি-২ বিমানগুলোর সফলতা লাভের সম্ভাবনা বেশি।
“আমরা বাঙ্কারগুলোর জন্য টানা অভিযানের কথা বলছি না। আপনি যে ফাটল চাইছেন, তার জন্য হয়তো একটি বা দুটি বিশেষায়িত অস্ত্রই লাগবে,” বলেছেন তিনি।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কি এ যুদ্ধে জড়াবে?
সবার চোখ এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের দিকে।
যুক্তরাষ্ট্র যে এই ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে একেবারেই নেই, এমনটা নয়। ইসরায়েল তাদের কাছ থেকে নানান অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য তো নিচ্ছেই। সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল অভিমুখী ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
তবে এখন পর্যন্ত তারা নিজেরা ইরানে হামলা চালায়নি।
কিন্তু আসছে দিনগুলোতে তারা সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েকদিনে তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে ৩০টির মতো ট্যাংকার বিমান নিয়ে এসেছে, যেগুলো আকাশেই যুদ্ধবিমান ও বোমারু বিমানে পুনরায় জ্বালানি ভরে দিতে সক্ষম।
থিংকট্যাঙ্ক রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যে আসছে সপ্তাহগুলোতে অঞ্চলটিতে বিস্তৃত যুদ্ধ অভিযান পরিচালনার নানান পূর্বপ্রস্তুতি শেষ করে আনছে তা এই ট্যাংকার বিমানের মোতায়েনেই ‘আভাস’ পাওয়া যাচ্ছে।
তবে ট্রাম্প রহস্য রেখেই দিচ্ছেন।
বুধবার হোয়াইট হাউজে মার্কিন এ প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইরানে হামলায় ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জড়াবে কিনা তা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি তিনি।
তবে তেহরানের ব্যাপারে তার ‘ধৈর্য এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে’, বলেছেন তিনি।
“(হামলা) করতে পারি, নাও করতে পারি। কেউ জানে না, আমি কি করতে যাচ্ছি,” বলেছেন কয়েক মাস আগেও নির্বাচনী প্রচারণায় ইরাক, লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করা ট্রাম্প।