Published : 12 Jun 2025, 11:56 PM
ভারতের গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদ থেকে ২৪২ আরোহী নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করার পরপরই লোকালয়ে বিধ্বস্ত হয় এয়ার ইন্ডিয়ার একটি উড়োজাহাজ।
বৃহস্পতিবারের এই দুর্ঘটনায় অন্তত ২০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। উড়োজাহাজে ছিলেন মোট ২৪২ জন যাত্রী ও ক্রু, যাদের মধ্যে ৫৩ জন ব্রিটিশ নাগরিক।
এখন পর্যন্ত উড়োজাহাজের মাত্র একজন বেঁচে ফেরার খবর পাওয়া গেছে। কী কারণে উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পরই এই দুর্ঘটনা তা এখনও স্পষ্ট নয়।
সরকারিভাবেও দুর্ঘটনার কোনও কারণ এখনও জানানো হয়নি। তবে বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা দুর্ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন।
দুটি বিষয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, একাধিক পাখির ধাক্কায় উড়োজাহাজ ওড়ার পর নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছতে পারেনি। ফলে ঘটে দুর্ঘটনা। দ্বিতীয়ত, যান্ত্রিক ত্রুটি।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ৩৯ মিনিটে আহমেদাবাদের সর্দার বল্লভভাই পটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটটি যাত্রা শুরু করে। কিন্তু রানওয়ে ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লাইটটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের।
উড্ডয়নের কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা নীচে নেমে আসতে শুরু করে এবং জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভেঙে পড়ে। ফ্লাইটটি রানওয়ে ছাড়ার পরেই বিপদসঙ্কেত পাঠিয়েছিল। ফলে কী ঘটেছিল আকাশে সে প্রশ্ন সামনে আসছে।
উড়োজাহাজটি সম্পর্কে কী জানা গেছে?
দুর্ঘটনাকবলিত উড়োজাহাজটি ছিল বোয়িং এর তৈরি ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলের। ভারতে এই মডেলের উড়োজাহাজ এবারই প্রথম বড় দুর্ঘটনার শিকার হল। যদিও অতীতে এই মডেলটির প্রযুক্তিগত ত্রুটি একাধিক বার আলোচনায় এসেছে।
ভারতীয় পত্রিকাগুলোতে বলা হয়েছে, এই মডেলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮ বছর আগে। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ড্রিমলাইনারটিও প্রায় ১২ বছর পুরনো।
বাজারে আনার সময় বোয়িং এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ বলে দাবি করেছিল। তাছাড়া, মাত্র ৬ সপ্তাহ আগেই বোয়িং গর্ব করে জানিয়েছিল, ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলটি এ পর্যন্ত ১০০ কোটিরও বেশি যাত্রী পরিবহণ করেছে।
তারপরও শতাধিক বার বিভিন্ন যান্ত্রিক বিভ্রাটের শিকার হয়েছে এই মডেলের উড়োজাহাজ। প্রায় এক যুগ আগে ওই বিমানে ব্যবহৃত ব্যাটারির সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছিল।
সে সময় দ্রুত নতুন নকশা ও সুরক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার কথা জানিয়েছিল বোয়িং। কিন্তু আহমেদাবাদের এই দুর্ঘটনার পর সেই সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়েছিল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা?
এক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে দ্য‘হিন্দুস্থান টাইমস’ জানায়, সম্প্রতি উড়োজাহাজটি সংস্কারের কাজ হয়েছিল।
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে, ফ্লাইটটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল। তবে সরকার বা ফ্লাইট সংস্থা থেকে এ বিষয়ে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পাখির ধাক্কা, নাকি ফ্ল্যাপের সমস্যা?
উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের কারণ এখনও নিশ্চিত হওয়া না গেলেও বিশেষজ্ঞরা বিবিসি-কে বলেছেন, উড্ডয়নের সময় উড়োজাহাজের ডানার ফ্ল্যাপ ঠিকমত না থাকার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
বিবিসি'র যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, উড়োজাহাজটি উড়ার পরই নিচের দিকে নামতে থাকে এবং তারপর মাটিতে পড়ে এক বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে।
বিমান চলাচল বিশ্লেষক জিওফ্রি থমাস বলেন, “আমি ভিডিওতে যেটা দেখছি, ল্যান্ডিং গিয়ার তখনও নিচে ছিল, কিন্তু ফ্ল্যাপগুলো গুটিয়ে নেওয়া হয়েছিল।” উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পরপরই ফ্ল্যাপ গুটিয়ে নেওয়ার এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না বলে জানান তিনি।
অন্য এক বিশেষজ্ঞ টেরি টোজার বলেন, “ভিডিও দেখে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কঠিন, তবে দেখে মনে হচ্ছে ফ্ল্যাপ খোলা ছিল না। এতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, বিমানটি ঠিকমতো উড্ডয়ন সম্পন্ন করতে পারেনি।”
বাকিংহ্যামশায়ার নিউ ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন পাইলট ও অধ্যাপক মার্কো চ্যান বলেন, “ফ্ল্যাপ সঠিকভাবে সেট করা না হয়ে থাকলে তা মানুষের ভুলের দিকেই ইঙ্গিত করে। তবে ভিডিওর রেজুলেশন এতটাই খারাপ যে এই বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।”
উড়োজাহাজ ওড়ার সময় আকাশে পাখিদের ধাক্কায় বিপত্তি থেকে যে গুরুতর বিপদ ঘটতে পারে তেমন শঙ্কার কথা বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই বলে এসেছেন।
পাখির ধাক্কায় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনাও অতীতে অনেকবারই দেখা গেছে। ভারতে গুজরাটের আহমেদাবাদের বিমানবন্দর শহুরে এলাকাতে হওয়ার সেখানে পাখির ধাক্কায় দুর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
২০১৮ সালের একটি গবেষণাতেও দেখা গেছে, আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে পাখির সঙ্গে উড়োজাহাজের ধাক্কা লাগার ঝুঁকি অনেক বোশি।
তাহলে আহমেদাবাদের এই দুর্ঘটনার পেছনে কী পাখিদের দল? সাবেক ঊর্ধ্বতন এক ভারতীয় পাইলট সংবাদ মাধ্যমে বলেন, “প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, একাধিক পাখির ধাক্কায় দুটি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে গিয়েছিল।
“ফ্লাইটটি ঠিক ভাবেই উড্ডয়ন করেছিল। কিন্তু পাখিদের সঙ্গে ধাক্কায় তা নীচে আসতে শুরু করে। তবে তদন্ত হলে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ সামনে আসবে।”
একই কথা বলেছেন আরেক বিমান বিশেষজ্ঞও। তিনি বলেন, “হয়ত ফ্লাইটটির ওড়ার ক্ষমতা ছিল না। একাধিক পাখি ফ্লাইটটিতে ধাক্কা দিয়ে থাকলে হয়ত সেটি ৬ থেকে ৭ মিনিটের বেশি উড়তে পারেনি এবং পড়ে যায়। এই উড়োজাহাজ অপেক্ষাকৃত নতুন হওয়ায় যান্ত্রিক সমস্যা থাকার সম্ভাবনা কম।”
সব মিলিয়ে উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের প্রকৃত কারণ নিয়ে এখনও রয়ে গেছে ধোঁয়াশা। ঘটনার তদন্তেই প্রকৃত কারণ সামনে আসবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।