Published : 07 Jun 2025, 11:12 PM
সম্প্রতি ইলন মাস্ক যখন রাজনীতি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিলেন, বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন, তিনি হয়ত নিজের প্রযুক্তি ব্যবসায় আরও মনোযোগী হবেন।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার ‘তীব্র বিরোধ’ সামনে আসার পর বিনিয়োগকারীদের মনে হয়েছে, মাস্কের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনটা তাদের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলছে না।
যেখানে তিনি জনসাধারণের দৃষ্টি থেকে খানিকটা আড়ালে গিয়ে টেসলা ও অন্যান্য কোম্পানির ভবিষ্যৎ উন্নয়নে মনোযোগ দেবেন, সেখানে তিনি নিজের প্রধান ক্রেতা অর্থাৎ মার্কিন সরকারের হুমকির মুখে পড়ছেন।
ট্রাম্পের সঙ্গে বিবাদের জেরে শেয়ার দরে ১৪ শতাংশ পতনে টেসলা ১৫ হাজার কোটি ডলার বাজার মূল্য হারায়, যাকে কোম্পানিটির ইতিহাসে একদিনে সবচেয়ে বড় দরপতন বলছে রয়টার্স।
বিরোধ প্রশমনের কিছু লক্ষণ সামনে আসায় পরের দিন অবশ্য শেয়ার দর কিছুটা বাড়ে।
শেয়ারে এ ধাক্কার কয়েক মাস আগে থেকেই বিনিয়োগকারী ও বিশ্লেষকরা চাইছিলেন যে মাস্ক ‘ফোন ফেলে’ কাজে ফিরবেন, তারপরও পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি।
ট্রাম্প প্রশাসনের ফেডারেল ব্যয় কমিয়ে আনতে ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ (ডিওজিই) প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল মাস্ককে। তবে মাস্ক সম্প্রতি ডিওজিই’র প্রধান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। সিনেটের অনুমোদন ছাড়াই বিশেষ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সর্বোচ্চ ১৩০ দিন দায়িত্ব পালন করেন।
এখন বিশ্বের ক্ষমতার রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিশ্বের শীর্ষ ধনী মাস্কের বাদানুবাদ, দ্বন্দ্বের খবর প্রধান শিরোনাম হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। সবশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বন্ধু থাকা দুজনের মধ্যে কয়েক মাসের মধ্যে বৈরিতা তৈরি হওয়া নিয়ে বিনিয়োগকারী ও বিশ্লেষকরা নানা হিসাব কষছেন।
ট্রাম্পের সঙ্গে বিবাদের জেরে মাস্কের লাভ-ক্ষতি কী হতে পারে, সেই পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষকদের বরাতে এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে বিবিসি।
‘টেসলা শেষ হয়ে গেছে’
কেউ কেউ যুক্তি দেন, ট্রাম্পের সঙ্গে চলমান বিবাদ বা দ্বন্দ্বের চেয়ে মাস্কের ব্যবসার সমস্যাগুলো আরও গভীর। ট্রাম্পের প্রশাসনে তার বিতর্কিত ভূমিকারও নাটকীয় ইতি ঘটেছে।
প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা প্রবীণ সাংবাদিক কারা সুইশার বলেন, গভীর সমস্যা, বিশেষ করে টেসলার জন্য।
সান ফ্রান্সিসকোতে মিডিয়া সামিটের সাইডলাইনে বিবিসিকে এ সাংবাদিক বলেন, “টেসলা শেষ হয়ে গেছে। এটি গাড়ির দারুণ একটি কোম্পানি ছিল। চালকবিহীন গাড়ির বাজারে তারা প্রতিযোগিতা করতে পারত; কিন্তু তারা অনেক পেছনে পড়ে গেছে।”
প্রতিযোগিতায় নেমে ‘অ্যালফাবেট ইনক’ এর ওয়াইমো কোম্পানিকে ধরার অনেক চেষ্টা করেছে টেসলা। ওয়াইমোর চালকবিহীন ট্যাক্সি কয়েক বছর ধরে সানফ্রান্সিসকোর রাস্তায় ঘুরছে কয়েক বছর ধরে। এখন আরও কয়েকটি শহরে চলছে।
আর চলতি মাসে টেক্সাসের অস্টিনে চালকবিহীন রোবো ট্যাক্সি চালু করতে যাচ্ছে টেসলা। মাস্ক সেটি তত্ত্বাবধান করবেন বলে মনে হচ্ছে।
গত সপ্তাহে মাস্ক এক্সে এক পোস্টে বলেন, ওয়াই মডেলের রোবো ট্যাক্সি রাস্তায় পরীক্ষামূলকভাবে চালিয়েও দেখেছে টেসলা।
ওয়েডবাশ সিকিউরিটিজের বিশ্লেষক ড্যান আইভস বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন টেসলার ভবিষ্যতের ৯০ শতাংশ গাড়ি হবে চালকবিহীন ও রোবোটিক ধরনের। অস্টিনে টেসলার রোবো ট্যাক্সির যাত্রাকে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত বলে বর্ণনা করেন তিনি।
তার কথায়, এখন হাতের প্রথম কাজ হল চালকবিহীন গাড়ির ভবিষ্যতের অনন্য সূচনা করা।
কিন্তু মাস্কের মনোযোগে বিভাজনের কথা তুলে ধরে বিবিসি লিখেছে, এর ফলে প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের সম্ভাবনা আরও দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছে।
এখানে আরও একটি বিষয় রয়েছে, আর তা হল মাস্কের নিজস্ব ভাবনা। তিনি কোনো জিনিসকে বদলে দিতে পারেন কিনা, সে নিয়ে আলোচনার চেয়ে বেশি কথা হচ্ছে তিনি আদৌ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন কিনা।
গারবার কাওয়াসাকি ওয়েলথ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্টের প্রেসিডেন্ট ও সিইও রস গারবার বলেন, তিনি একজন দারুণ সক্ষম মানুষ, যখন কোনও কিছুর উপর মনোযোগ দেন। তিনি বৈদ্যুতিক যানবাহন তৈরি করে দেখিয়েছেন, যা অন্য কেউ করেনি। তিনি রকেট বানিয়েছেন। আরও অনেক কিছুর প্রমাণ তিনি দিয়েছেন।
টেসলায় দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগ করছেন গারবার। কিন্তু মাস্কের ডানপন্থি রাজনীতিতে প্রবেশের পর তার শেয়ারের ওপর এখন তিক্ততা অনুভব করছেন এবং মালিকানা ফিরিয়ে আনছেন। শেয়ার দরপতনের দিন বৃহস্পতিবারকে তিনি ‘অত্যন্ত বেদনাদায়ক দিন’ বলে বর্ণনা করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মাস্কের কথাই লড়াইয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব ভাবা সবচেয়ে বোকামির কাজ।”
বিষয়গুলো নিয়ে মাস্কের বক্তব্য জানতে এক্স, টেসলা ও স্পেসএক্সের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া না পাওয়ার কথা বলেছে বিবিসি।
‘টেসলা টেকডাউন’
আপাতদৃষ্টিতে ডনাল্ড ট্রাম্পের মত শত্রু তৈরির আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাস্কের আরেকটি শত্রু তৈরি হয়েছে। বিষয়টি হল, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রাম্পের সঙ্গে মাস্কের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। আর ট্রাম্প ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকে প্রত্যেক সপ্তাহান্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘টেসলা টেকডাউন’ ক্যাম্পেইন চলেছে।
এপ্রিলে টেসলা হিসাব কষে দেখেছে, বছরের প্রথম তিন মাসে তাদের গাড়ি বিক্রি ২০ শতাংশ কমেছে। ৭০ শতাংশের বেশি লাভ কমেছে। এর সঙ্গে অবনমন ঘটেছে শেয়ার দরের।
গত ফেব্রুয়ারিতে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে টেসলার এক ডিলারের দোকানের বাইরে বিক্ষোভ হয়েছিল। সেখানে লিন্ডা কোইস্টিনেন নামে এক বিক্ষোভকারী বলছিলেন, “আমাদের সরকারকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে আমাদের গণতন্ত্রের ভাগ্য তার (মাস্ক) নির্ধারণ করা উচিত নয়। এটা ঠিক না।”
‘হ্যাশট্যাগ টেসলা টেকডাউন’ ক্যাম্পেইনের সহ-আয়োজক জোয়ান ডোনোভান বলেন, প্রকৃতপক্ষে এই ক্যাম্পেইন প্রযুক্তি বা টেসলাকে নিয়ে নয়। টেসলার শেয়ার কীভাবে জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং কোনো স্বচ্ছতা ছাড়াই কীভাবে অবিশ্বাস্য পরিমাণে ক্ষমতা তৈরি হয়েছে মাস্কের, সেটি দেখানো উদ্দেশ্য।
এ ছাড়া টুইটার কিনে নেওয়ার পর মাস্কের কর্মকাণ্ডেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ডোনোভান বলেন, তিনি টুইটার কিনে নেন যাতে তিনি লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেন এবং প্রভাব তৈরি করতে পারেন।
‘ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে যারা মাস্কের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, এখন সেই ট্রাম্পের সঙ্গে বিবাদের জেরে মাস্ক কি তাদের দৃষ্টিতে আগের অবস্থায় ফিরতে পারেন?
এই প্রশ্নে ‘মুর ইনসাইটস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’ এর প্রধান বিশ্লেষক প্যাট্রিক মুরহেড বলেন, সেটাও হতে পারে।
“আমরা অত্যন্ত ক্ষমাশীল দেশের মানুষ। সেরকম ঘটনা ঘটতে সময় লাগে; তবে এটি অভূতপূর্ব বা আগে কখনও ঘটেনি এমন নয়,” বলেন মুরহেড।
মাস্ককে মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের সঙ্গে তুলনা করেন সুইশার।
তিনি বলেন, বিল গেটসকে একসময় সিলিকন ভ্যালির প্রতাপশালী মনে করা হত তার ‘উদ্ধত ও রূঢ়’ ব্যক্তিত্বের কারণে। কিন্তু নিজের সেই ভাবমূর্তি অনেকাংশে তিনি পুনরুদ্ধার করেছেন।
“তিনি শিখেছেন। বড় হয়েছেন। “ মানুষ পরিবর্তিত হতে পারে;” যদিও মাস্ক স্পষ্টতই সমস্যার মধ্যে আছেন,” বলেন সুইশার।
কে কার ওপর নির্ভরশীল
মাস্ক ও তার কোম্পানির ভবিষ্যৎ কেবল তার কর্মকাণ্ডের ওপরই নির্ভর করছে না, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ওপরও নির্ভর করছে।
আগে বিশেষ কর নির্বাচনের তহবিলের জন্য মাস্ককে প্রয়োজন ছিল ট্রাম্পের। কিন্তু ট্রাম্প এখন কী করছেন, সেটি স্পষ্ট নয়।
যদিও ট্রাম্পের অতীতে মাস্কের প্রয়োজন ছিল, বিশেষ করে তার রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী নির্বাচনের তহবিলের জন্য, এখন এটা স্পষ্ট নয় যে তাকে এখন কতটা দরকার।
‘নোয়াপিনিয়ন সাবস্ট্যাক’ এর লেখক নোয়া স্মিথ বলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ট্রাম্পের অত্যন্ত লাভজনক প্রবেশ হয়ত তাকে মাস্কের উপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি দিয়েছে।
“আমার ধারণা এমনটিই হয়েছে, যাতে তিনি (ট্রাম্প) মাস্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন।”
ট্রাম্পের সবথেকে বড় হুমকির বার্তা হল তিনি মাস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের চুক্তি বাতিল করার কথা বলেছেন।
সরকারের সঙ্গে মাস্কের আনুমানিক ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার মূল্যের চুক্তি রয়েছে। এর বড় অংশ যুক্ত মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানির সঙ্গে। ফলে চুক্তি বাতিল হলে আপাতদৃষ্টিতে স্পেসএক্সের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়তে পারে। যদিও এটি ট্রাম্পের ফাঁকা হুমকিও হতে পারে।
এর কারণ, স্পেসএক্সের ড্রাগন স্পেসক্রাফট আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মানুষ ও মালামাল পরিবহন করছে। সেখানে নাসার তিনজনকে সম্প্রতি পাঠানো হয়েছে।
এটি প্রমাণ করে, স্পেসএক্স মার্কিন মহাকাশ ও জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এতটাই ঢুকে গেছে যে ট্রাম্পের হুমকি কেবল হুমকিই থেকে যাবে। বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হতে পারে।
মাস্কের স্যাটেলাইট কোম্পানি স্টারলিংকের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি হতে পারে। এটার বিকল্প খুঁজে পাওয়ার কথা বলা যতটা সহজ, করা ততটা সহজ নয়।
আবার ট্রাম্পের যদি কিছু করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকে, তবে সে সীমাবদ্ধতা মাস্কেরও আছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে বিবাদের মাঝখানে মাস্ক তার ড্রাগন মহাকাশযান প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছিলেন। যদিও পরে সে চিন্তা থেকে সরে আসার বার্তা দেন।
এক এক্স ব্যবহারকারীদের পরামর্শে তিনি লেখেন, “ভালো পরামর্শ। ঠিক আছে, আমরা ড্রাগনকে প্রত্যাহার করব না।”
মাস্ক ও ট্রাম্পের বন্ধুত্ব শেষ, এটা আপাতত স্পষ্ট। একে অপরের ওপর তাদের যে নির্ভরশীলতা, সেটার ভবিষৎ স্পষ্ট নয়।
আর মাস্কের ব্যবসার ভবিষ্যৎ যাই হোক না কেন, ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের পদক্ষেপ তার সব কিছুতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতেই থাকবে।
আরও পড়ুন-
ট্রাম্পকে অভিশংসিত করা উচিত: মাস্ক
ট্রাম্প-মাস্ক বিবাদ নিয়ে রাশিয়ার মস্করা, কাজের প্রস্তাব
ট্রাম্প-মাস্ক প্রকাশ্য বিবাদের পর শুক্রবার ফোনালাপের সম্ভাবনা