Published : 19 Jun 2025, 01:36 AM
ইসরায়েল এবারের হামলার শুরু থেকেই ইরানের সরকার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে আসছে।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়তুল্লাহ খামেনিকে উৎখাতের ইচ্ছার কথা একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
নেতানিয়াহু এও বলেছেন, খামেনিকে হত্যা করলেই চলমান সংঘাত থেমে যাবে। ট্রাম্প অবশ্য এখনো তাকে হত্যার ব্যাপারে ‘সায়’ দেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে নিজেদের সরকার পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অবশ্য ইরানিদের রয়েছে।
১৯৫৩ সালের ওই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা শাহ সরকার টিকেছিল ২৭ বছরের মত। ১৯৭৯ সালের অভ্যুত্থানে তাদের পতন ঘটে, সূচনা হয় ইসলামী শাসনের।
তখনকার ঘটনাক্রমের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
তেলক্ষেত্র
ইরানে ১৯৫৩ সালে যে অভ্যুত্থান হয়, তাতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র।
মোসাদ্দেগ ইরানিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। ওই সময় তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কয়েকটি নীতি বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
দেশের তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোসাদ্দেগ, যা ছিল তৎকালীন মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারের জন্য বড় ধরনের আঘাত। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর ওই সময় তারা ব্যাপকমাত্রায় নির্ভরশীল ছিল।
স্নায়ুযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়
তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের পদক্ষেপটি ইরানে জনপ্রিয় হিসেবে দেখা হয়। এটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় হিসেবেও বিবেচিত হয় কারো কারো কাছে।
শাহের শাসন জোরদার করা
১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল, ইরানের রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলবিকে শাহ শাসক হিসেবে ক্ষমতায় বসানো এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জেনারেল ফজলুল্লাহ জাহেদিকে নিয়োগ দেওয়া।
অভ্যুত্থান
অভ্যুত্থানের আগে মার্কিন তদন্ত সংস্থা—সিআইএ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা—এসআইএস মিলে নানা অপপ্রচার ছড়িয়ে মোসাদ্দেগবিরোধী জনমত উসকে দেয়।
১৯৫৩ সালে সিআইএ ও এসআইএস শাহপন্থি বাহিনীকে সংগঠিত করে এবং মোসাদ্দেগবিরোধী বড় ধরনের বিক্ষোভ আয়োজন করে, যেখানে পরে সেনাবাহিনীও যোগ দেয়।
মার্কিন অর্থ
অভ্যুত্থানের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন জাহেদি। তার সরকার যেন স্থিতিশীলতা অর্জন করে, সেজন্য গোপনে দুই দিনের মধ্যে ৫০ লাখ ডলার সরবরাহ করে সিআইএ, যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন নথিতে প্রমাণিত হয়েছে।
সিআইএর ওই কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কারমিট রুজভেল্ট জুনিয়র, যিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নাতি।
মার্কিন স্বীকারোক্তি
২০১৩ সালে সিআইএর কিছু নথি প্রকাশ পায়, যেখানে প্রথমবারের মতো অভ্যুত্থানে সংস্থাটির ভূমিকার প্রমাণ প্রকাশ্যে আসে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূমিকা ছিল, সেটা সবারই জানা।
এর আগে ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ওই অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে নেন।
ফল হয় উল্টো
মোসাদ্দেগকে উৎখাতের পর যুক্তরাষ্ট্র শাহ পাহলবির প্রতি সমর্থন আরও জোরালো করে। কিন্তু বাইরের হস্তক্ষেপে ইরানিরা ক্রমে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং দশকের পর দশক ধরে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব দানা বাঁধতে থাকে।
ইসলামি বিপ্লব
শাহ যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ওঠেন। কিন্তু গত শতাব্দির সত্তরের দশকের শেষ দিকে লাখ লাখ ইরানি তার শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসেন। তাদের চোখে, শাহ সরকার ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবৈধ।
ওই আন্দোলনে ধর্মনিরপেক্ষদের পাশাপাশি ইসলামপন্থিরাও যোগ দেন। ধর্মনিরপেক্ষ বিক্ষোভকারীরা রাজপথে নামেন তার স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করে। আর ইসলামপন্থিরা শাহের ‘আধুনিকায়ন নীতির’ বিরুদ্ধে ছিলেন।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ সরকারের পতন ঘটে। এই বিপ্লব ইরানের পশ্চিমা-সমর্থিত রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়; সূচনা ঘটে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ও ধর্মীয় শাসনের।
এবার কী ঘটতে পারে
শুক্রবার ভোরে ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্ব ও প্রধান পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যার মাধ্যমে ‘আচমকা’ অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। এরপর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে আকাশপথে হামলা পাল্টা হামলা অব্যাহত আছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আঘাত হানার মাধ্যমে এ যুদ্ধে জড়ানোর পরিকল্পনা করছেন বলে খবর দিয়েছে রয়টার্সসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
ইরান বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যোগ দিলে তারাও চুপ থাকবে না; তারা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালাবে।
তেহরানের দুই কর্মকর্তার বরাতে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ইরান প্রথমে ইরাকে থাকা মার্কিন বাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা চালাবে। এরপর আঘাত করবে অন্যান্য আরব দেশে থাকা মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প এই যুদ্ধে জড়ালে তা ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খুলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
ইউরোপীয় কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো এলি গেরানমায়েহ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন।
তিনি বলছেন, হয় তাকে কূটনৈতিক সমাধানের পথ বেছে নিতে হবে, নয়ত যুদ্ধে জড়াতে হবে।
"এই ধরনের মুহূর্তে নেতাদের সবসময়ই একটি বিকল্প থাকে। ট্রাম্প এর আগেও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে সরে এসেছেন। চাইলে আবারও তিনি একই পথে হাঁটতে পারেন।"
গেরানমায়েহ মনে করেন, "ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার সিদ্ধান্ত নিলে তেহরান সেটাকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করবে।
"আর একবার এই প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেলে কী ঘটবে, তা কিন্তু কেউ জানে না। এই সংঘাত ট্রাম্পের পুরো মেয়াদকেই গ্রাস করে ফেরতে পারে।"
‘আত্মসমর্পণ কোনো বিকল্প নয়’
মঙ্গলবার ইরানকে ‘শর্তহীন আত্মসমর্পণ’ করতে বলেন ট্রাম্প। তবে সেই ‘প্রস্তাব’ প্রত্যাখ্যান করেছেন খামেনি।
গেরানমায়েহ বলেন, ইরানের জন্য আত্মসমর্পণ কোনো বিকল্প নয়। ইরান জানে, তারা সামরিকভাবে জয়ী হতে পারবে না। কিন্তু তারা এটা নিশ্চিত করতে চায়, এই যুদ্ধে কেউ যেন বিজয়ী হতে না পারে।
তার মত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ‘ইরান প্রজেক্টের’ পরিচালক আলি ভায়েজও মনে করেন, খামেনিকে আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা সফল হবে না।
সিএনএনকে তিনি বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলের আগ্রাসনে ভর করে ইরানের নেতৃত্বকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার চেষ্টা করবেন, ততক্ষণ তা সফল হবে না।”
ট্রাম্প যুদ্ধে জড়ালে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও তাদের মিত্ররা নতুন বৈরিতার মুখে পড়বে বলে মনে করেন মার্কিন সেনেটর ক্রিস মারফি।
সিএনএনকে তিনি বলেন, "যারা যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে উৎসাহ দিচ্ছেন, তারা হয়ত ইরাক যুদ্ধ ও আফগানিস্তান যুদ্ধের বিপর্যয়ের কথা ভুলে গেছেন।”
কানেটিকাট অঙ্গরাজ্যের এ ডেমোক্র্যাট সেনেটর বলছেন, “ওই দুই যুদ্ধের পরিণতি হিসেবে হাজার হাজার মার্কিন নাগরিকের প্রাণ যায়। ওই অঞ্চলে নতুন করে বিদ্রোহের মুখে পড়ে মার্কিন স্বার্থ ও তাদের মিত্ররা।”
আরও পড়ুন
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান
ট্রাম্পের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ডাক প্রত্যাখ্যান করলেন ইরানের খামেনি
ইসরায়েলের সঙ্গে হামলায় যুক্তরাষ্ট্র যোগ দিলে ইরান 'সমুচিত জবাব দেবে'
যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা ট্রাম্পের বিবেচনায়, তেহরান ছাড়ছে মানুষ