Published : 17 May 2025, 11:36 PM
সালভাদর দালি অবচেতন মনস্তত্ত্বের জগত এবং অতিপ্রাকৃত দৃশ্যপটের মাধ্যমে সুররিয়ালিজমকে এক নতুন মাত্রা প্রদান করেছিলেন। চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র—সব ক্ষেত্রেই তাঁর অগাধ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
দালির পুরো নাম সালভাদর দোমিঙ্গো ফেলিপে হাসিন্তো দালি ই দোমেনেক। ১১ মে ১৯০৪ সালে স্পেনের ফিগেরাস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর শিল্পী হওয়ার প্রতি গভীর আকাঙ্ক্ষা ছিল। বাবা ছিলেন একজন কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ। অন্যদিকে মা তাঁকে সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিতেন। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি অসংখ্য চিত্রকর্ম আঁকা শুরু করেন। দ্রুতই তাঁর প্রতিভা প্রকাশ পেতে শুরু করে।
চলুন প্রিয় পাঠক অসামান্য এই প্রতিভার ব্যক্তিজীবন ও কর্ম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও মজাদার কিছু ঘটনা ও তথ্য জেনে নেই।
সালভাদর দালির জীবনের শুরুতেই তার ভাবনার জগত প্রচন্ডভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তার মৃত বড় ভাই। যার নামও ছিল সালভাদর।
বড় ভাই সম্পর্কে তিনি গভীরভাবে ভাবতেন। পরবর্তীতে তাঁর জীবন ও শিল্পে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। দালির জন্মের নয় মাস আগে তাঁর বড় ভাই মাত্র সাত বছর বয়সে মারা যান। দালির বাবা-মা বিশ্বাস করতেন যে তাঁদের মৃত বড় পুত্র পুনর্জন্ম লাভ করছে ছোট পুত্রের মাধ্যমে।
এই বিশ্বাস দালির শৈশবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি নিজেকে তাঁর ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ভাবতেন। কখনো কখনো মনে করতেন তিনি তাঁর ভাইয়ের জীবনকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। এই ধারণা তাঁর শিল্পকর্মেও প্রতিফলিত হয়েছে।
Portrait of My Dead Brother চিত্রকর্মের সামনে দালি
১৯৬৩ সালে দালি Portrait of My Dead Brother নামে একটি চিত্রকর্ম আঁকেন। যেখানে তিনি তাঁর ভাইয়ের স্মৃতি এবং নিজের অস্তিত্বের দ্বৈততা প্রকাশ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে তাঁর ভাই ছিল তাঁর "প্রথম সংস্করণ" এবং তিনি নিজেকে তাঁর ভাইয়ের ছায়া হিসেবে অনুভব করতেন।
এই মানসিক দ্বন্ধ দালির শিল্পশৈলীতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর চিত্রকর্মে মৃত্যুর প্রতীক, অবচেতনের রহস্য এবং পুনর্জন্মের ধারণা বারবার উঠে এসেছে। তাঁর বাবা-মা তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি তাঁর ভাইয়ের পুনর্জন্ম। এই কথা দালিকে একধরনের অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছিল।
দালির এই বিশ্বাস তাঁর সুররিয়ালিস্ট শিল্পের অন্যতম ভিত্তি হয়ে ওঠে। তাঁর চিত্রকর্মে স্বপ্নময়তা, বাস্তবতার বিকৃতি এবং অবচেতনের গভীরতা দেখা যায়।
১৯২২ সালে দালি মাদ্রিদের ‘রেয়াল আকাদেমিয়া দে বেইয়্যাস আর্তেস দে সান ফের্নান্দো’তে চিত্রকলা অধ্যয়ন করতে যান। সেখানে তাঁর চিত্রশৈলী ধীরে ধীরে উন্নত হয় এবং ক্লাসিকাল শিল্পধারার পাশাপাশি নতুন ধারা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন।
তাঁর প্রতিভা দ্রুতই নজর কাড়ে। কিন্তু দালি ছিলেন স্বাধীনচেতা। নিয়মের বাধা মানতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। ক্লাসে অদ্ভুত পোশাক পরে আসতেন—কখনো চিত্রশিল্পীর কোট, কখনো মধ্যযুগীয় পোশাক!
১৯২৬ সালে একাডেমির নিয়মভঙ্গের কারণে বহিষ্কৃত হন। দালি কর্তৃপক্ষের নিয়ম ও নির্দেশ মানতে নারাজ ছিলেন। তার অদ্ভুত আচরণ একাডেমির প্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু ততদিনে তার সৃজনশীলতা সবাইকে মুগ্ধ করেছে।
একা চলার এই সুযোগটিই তাকে আরও স্বাধীনভাবে নিজের শৈলী গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। দালি একাডেমিতে আর ফিরে আসার অনুমতি পাননি। তবে বহিষ্কার হওয়াই তাকে পুরোপুরি মুক্তচিন্তার শিল্পী হয়ে ওঠার পথ তৈরি করে দেয়।
বহিস্কার হওয়ার পর তিনি প্যারিস যান। সেখানে পিকাসো, মিরো এবং অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হন। এই শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের স্বপ্নময়, সুররিয়ালিস্টিক শৈলী গড়ে তুলতে শুরু করেন। তার সৃষ্টিশীলতা আরও তীক্ষ্ণ হয়। এবং শীঘ্রই তিনি সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।
তার বহিষ্কার—একাডেমির দৃষ্টিতে শৃঙ্খলাভঙ্গ হলেও দালির দৃষ্টিতে ছিল সৃজনশীল মুক্তির প্রথম ধাপ!
১৯২০-এর দশকের শেষ দিকে দালি প্যারিসে আঁদ্রে ব্রেতোঁর নেতৃত্বাধীন সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে যোগ দেন। তখন থেকেই তাঁর চিত্রশৈলীতে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, স্বপ্নময়তা এবং অবচেতনের প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম The Persistence of Memory (১৯৩১), যা বিগলিত ঘড়ির মাধ্যমে সময়ের প্রকৃতি নিয়ে দর্শকদের ভাবতে বাধ্য করে। চিত্রকর্মটি তাঁকে শিল্পজগতের অন্যতম প্রধান সুররিয়ালিস্ট চিত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
The Presistance of Memory
সালভাদর দালি ও আঁদ্রে ব্রেতোঁর সম্পর্ক ছিল জটিল। ব্রেতোঁ ছিলেন সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের নেতা। কিন্তু দালির রাজনৈতিক অবস্থান ও ব্যক্তিগত আচরণ তাকে সুররিয়ালিস্ট গোষ্ঠী থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ব্রেতোঁ একসময় দালিকে "আভিজাত্যপন্থী সুররিয়ালিস্ট" বলে বিদ্রূপ করেছিলেন।
অন্যদিকে, হিটলারের প্রতি দালির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরও বিতর্কিত। তিনি "এনিগমা অফ হিটলার" নামে একটি চিত্রকর্ম তৈরি করেন। যা তার হিটলার-সংক্রান্ত ভাবনার প্রতিফলন। দালি একবার বলেছিলেন যে, তিনি হিটলারকে "মহান মেজোখিস্ট" হিসেবে দেখতেন, যিনি বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিলেন শুধুমাত্র পরাজয়ের আনন্দ উপভোগ করার জন্য।
The Enigma of Hitler চিত্রকর্ম
এই ধরনের মন্তব্য ও তাঁর নিরপেক্ষ রাজনৈতিক অবস্থান তাকে অনেক সহশিল্পীর বিরাগভাজন করেছিল।
দালির চিত্রকর্মে চমকপ্রদ, অদ্ভুত এবং বাস্তবতাকে বিকৃত করার যে বৈশিষ্ট্য, তার পেছনে ছিল ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের গভীর প্রভাব। চিত্রকলার মাধ্যমে মানব মনের রহস্যময় জগতকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি।
দালির জীবনে আরো এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম এলেনা ইভানোভনা দিয়াকোনোভা। মূলত গালা নামেই পরিচিত ছিলেন সবার কাছে। গালার প্রতি প্রচণ্ড আসক্ত ছিলেন এই শিল্পী। গালাকে তাঁর সৃষ্টিশীলতার অন্যতম উৎস হিসেবে দেখতেন। গালা ছিলেন তাঁর স্ত্রী, সংগঠক এবং শিল্পের পথপ্রদর্শক। তাঁদের সম্পর্ক জটিল হলেও দালি তাঁর শিল্পে গালাকে বহুবার ফুটিয়ে তুলেছেন। সালভাদর দালি ও গালা—এ যেন শিল্পের দুনিয়ার এক রহস্যময় জুটি!
যৌবনে দালি ও গালা
দালি যখন গালার প্রেমে পড়লেন, তখন তিনি ছিলেন এক তরুণ শিল্পী। আর গালা ছিলেন ফরাসি কবি পল এলুয়ারের স্ত্রী। কিন্তু ভালোবাসা কি আর শাস্ত্র মানে! দালি প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারেন—গালা তার অনুপ্রেরণা, তার সৃষ্টির চাবিকাঠি।
গালা ছিলেন সাহসী, বুদ্ধিমতী এবং দুর্দান্ত ক্যারিশমার অধিকারী। তিনি দালির জীবনে শুধু একজন প্রেমিকা ছিলেন না, বরং ছিলেন তার শিল্পীসত্তার মিউজ ও ম্যানেজার। দালি প্রায়ই বলতেন, "আমি নিজেকে শিল্পী মনে করি না, আমি গালাকে ভালোবাসি!"
তাদের প্রেমের শুরু থেকেই দালি ছিলেন খানিকটা রঙিন নাটকীয়তায় ভরপুর। একবার তিনি গালাকে তার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে নিজের পায়ের উপর আগুন ধরিয়ে দেন—যেন গালা বুঝতে পারেন তার আবেগ কত গভীর!
১৯৩৪ সালে তারা অবশেষে বিয়ে করেন। যদিও দালি ছিলেন গালার তুলনায় ১০ বছরের ছোট! কৌতূহলোদ্দীপকভাবে, গালার প্রতি দালির ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে, তিনি প্রায়ই তার আঁকা শিল্পকর্মে গালার মুখ প্রতিফলিত করতেন।
এই জুটি আজও শিল্পের ইতিহাসে অন্যতম অদ্ভুত, কিন্তু চিরস্মরণীয় এক প্রেমের গল্প হয়ে রয়ে গেছে।
Un Chien Andalou সিনেমার পোস্টার
দালি কেবল চিত্রশিল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি চলচ্চিত্র, ভাস্কর্য এবং সাহিত্যেও সক্রিয় ছিলেন। তিনি লুইস বুনুয়েলের সাথে Un Chien Andalou (১৯২৯) এবং L'Age d'Or (১৯৩০) সিনেমায় কাজ করেন, যা সুররিয়ালিস্ট চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
এমনকি সালভাদর দালি ও ওয়াল্ট ডিজনি দুজনে মিলে কাজ করেছিলেন!
সালভাদর দালি এবং ওয়াল্ট ডিজনি—দুইজনই ছিলেন তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিপ্লবী। একজন ছিলেন সুররিয়ালিস্ট শিল্পী, অন্যজন ছিলেন অ্যানিমেশন জগতের পথিকৃৎ। ১৯৪৫ সালে, এই দুই সৃজনশীল প্রতিভা একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁদের যৌথ প্রকল্পের নাম ছিল - দেস্তিনো (Destino)। এটি একটি অসমাপ্ত স্বপ্ন ছিল। দেস্তিনো একটি সুররিয়ালিস্ট অ্যানিমেটেড স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। যা দালির শিল্পশৈলী এবং ডিজনির অ্যানিমেশন দক্ষতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করা হচ্ছিল। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি গল্প বলা। যেখানে সময়, প্রেম এবং ভাগ্যের রহস্যময়তা ফুটিয়ে তোলা হবে।
দালি এবং ডিজনি একসঙ্গে প্রায় আট মাস ধরে এই প্রকল্পের ওপর কাজ করেন। ডিজনির স্টুডিওর শিল্পী জন হেনচ দালির নির্দেশনায় স্টোরিবোর্ড তৈরি করেন। এই চলচ্চিত্রের জন্য দালি বেশ কিছু চিত্রকর্ম আঁকেন, যা তাঁর স্বপ্নময় এবং অবচেতন মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন ঘটায়।
ডিজনি ও দালি
এই প্রকল্পটি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং ব্যয়বহুল ছিল। ১৯৪৬ সালে ডিজনি এটি বন্ধ করে দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ডিজনির স্টুডিও আর্থিক সংকটে পড়েছিল, যার ফলে তাঁরা এই প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করতে পারেননি।
১৯৯৯ সালে, ডিজনির ভাইপো রয় ই. ডিজনি এই প্রকল্পটি পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ফ্রান্সের ডিজনি স্টুডিওর একটি দলকে দায়িত্ব দেন দালির স্টোরিবোর্ড এবং নোটের ভিত্তিতে চলচ্চিত্রটি সম্পন্ন করার জন্য।
২০০৩ সালে, অবশেষে দেস্তিনো( Destino) মুক্তি পায় এবং এটি ডিজনির অ্যানিমেশন ও দালির সুররিয়ালিস্ট শিল্পশৈলীর এক অনন্য সংমিশ্রণ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
সালভাদর দালি এবং ওয়াল্ট ডিজনির যৌথ কর্ম এক অনন্য শিল্প-সংযোগ। যা বাস্তবতা এবং কল্পনার সীমা অতিক্রম করে। যদিও দেস্তিনো তাঁদের জীবদ্দশায় সম্পন্ন হয়নি, তবুও এটি আজও শিল্পপ্রেমীদের জন্য এক বিস্ময়কর সৃষ্টি হিসেবে রয়ে গেছে।
Destino এনিমেশনে দালি ও ডিজনি এভাবে উপস্থাপিত হয়েছেন
দালি বিজ্ঞাপন, প্রোপাগান্ডা এবং ডিজাইনেও দক্ষ ছিলেন। তাঁর সৃষ্টি করা লোগো এবং চিত্রচরিত্র বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয়েছে।
এই বিস্ময়কর শিল্পী যিনি শুধুমাত্র চিত্রশিল্পেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, কমার্শিয়াল আর্টেও সক্রিয় ছিলেন। বিশ্বাস করতেন যে শিল্প কেবলমাত্র গ্যালারির জন্য নয়, বরং এটি জনসাধারণের কাছে পৌঁছানো উচিত।
দালি কমার্শিয়াল আর্টকে একধরনের সৃজনশীল প্রকাশ হিসেবে দেখতেন। বিজ্ঞাপন, পণ্য ডিজাইন এবং ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁর সুররিয়ালিস্ট শৈলী প্রয়োগ করেছিলেন। ব্রায়ানস হোসিয়ারি, ল্যানভিন চকোলেট, আলকা-সেল্টজার, এবং ব্রানিফ এয়ারলাইন্স-এর জন্য বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন, যেখানে তাঁর স্বপ্নময় অদ্ভুত শৈলী ফুটে উঠেছিল।
দালি বিশ্বাস করতেন যে কমার্শিয়াল আর্ট শিল্পের একটি অংশ। এটি শিল্পীর সৃজনশীলতার প্রসার ঘটাতে পারে। ফ্যাশন, গহনা ডিজাইন, এবং এমনকি পারফিউম ব্র্যান্ডের জন্যও কাজ করেছিলেন। তাঁর মতে, শিল্পের মাধ্যমে বাণিজ্যিক দুনিয়াকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব।
তবে, দালি কখনোই শিল্পের মৌলিকতা বিসর্জন দেননি। তাঁর সুররিয়ালিস্ট শৈলী বজায় রেখে কমার্শিয়াল আর্টে কাজ করেছেন। যা তাঁকে অন্যান্য শিল্পীদের থেকে আলাদা করেছে। তার বিজ্ঞাপনগুলো সাধারণ প্রচারমূলক কাজের চেয়ে বেশি ছিল—এগুলো ছিল শিল্পের এক নতুন রূপ।
কমার্শিয়াল আর্টকে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উপাদান না দেখে বরং তিনি এটিকে শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর কাজ আজও শিল্প ও বিজ্ঞাপনের সংযোগকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে।
দালি শুধুমাত্র একজন সুররিয়ালিস্ট শিল্পীই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। যার জীবনধারা ছিল অদ্ভুত এবং মজার কাণ্ডে ভরা। তিনি রেস্তোরাঁর বিল পরিশোধ না করার জন্য একটি অভিনব কৌশল অবলম্বন করতেন।
দালিকে যখন কোনো বিল পরিশোধ করতে হতো, তখন তিনি একটি চেক লিখতেন এবং সেটি স্বাক্ষর করতেন। কিন্তু বিল পরিশোধের আগে, তিনি চেকের পিছনে একটি ছোট্ট আঁকিবুঁকি বা স্কেচ তৈরি করতেন। তিনি জানতেন যে রেস্তোরাঁর মালিক বা কর্মচারীরা তাঁর স্বাক্ষরিত চেকটিকে একটি শিল্পকর্ম হিসেবে সংরক্ষণ করবেন। সেটি ব্যাংকে জমা দেবেন না।
ফলে, যা হবার তাই হতো! দালি বিল পরিশোধ না করেই রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন!
এই কৌশলটি এতটাই কার্যকর ছিল যে বহু রেস্তোরাঁ তাঁর স্বাক্ষরিত চেককে নগদ অর্থের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করত। সেটি ফ্রেমে বাঁধাই করে রেখে প্রদর্শন করত। এটি ছিল দালির একধরনের সৃজনশীল প্ররতারণা! যা তাঁর সুররিয়ালিস্ট চিন্তাধারারই একটি অংশ।
দালির জীবনধারা ঠিক তার চিত্রশিল্পের মতোই অদ্ভুত ও চমকপ্রদ ছিল। তিনি শুধু তার গোঁফ দিয়েই বিখ্যাত ছিলেন না, তার গৃহপালিত পশুদের নির্বাচনও ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী!
দালির সবচেয়ে বিখ্যাত গৃহপালিত প্রাণী ছিল একটি আরমাদিয়্যো-প্যাটার্নযুক্ত ওসেলট। নাম ছিল বাবু। তিনি বাবুকে প্রায়ই রেস্তোরাঁ ও হোটেল ভ্রমণে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। যেন এটি কোনো সাধারণ গৃহপালিত বিড়াল! এমনকি একবার তিনি নিউইয়র্কের এক প্রখ্যাত রেস্তোরাঁয় বাবুকে নিয়ে গিয়েছিলেন, আর পাশে বসা অতিথি ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠেন।
আর্মাদিইয়্যো ও দালি
শুধু বাবু নয়, দালি তার পাগলাটে জীবনে পিঁপড়াভর্তি টোস্ট খাওয়ার গল্প করেছেন। কখনো কখনো তাকে দেখা গেছে অ্যাটম পাসেপ্রিও নামে এক বিশালাকার ব্যাঙ নিয়ে মেতে থাকতে। তার শিল্পে যেমন রহস্যময়তা ছিল, তেমনি তার পোষা প্রাণীদের প্রতি অদ্ভুত ভালবাসাও ছিল।
দালির বিশ্ব যেন বাস্তবতা ও কল্পনার মিশ্রণে গড়া এক অদ্ভুত রাজ্য!
দালির অদ্ভুত সংগ্রহশালায় ছিল এমন সব জিনিস, যা একজন সাধারণ শিল্পীর কাছে কল্পনাতীত! তিনি একবার দাবি করেছিলেন যে, তার কাছে একটি শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া সোফা আছে—যা ছিল তার বিখ্যাত লিপসোফা। এটা অভিনেত্রী ম্য উইস্টের ঠোঁটের অনুপ্রেরণায় তৈরি।
দালির সংগ্রহে আরও ছিল স্বর্ণ ও রত্নখচিত হাঁসের ডিম এবং একজোড়া প্রস্ফুটিত গোলাপ দিয়ে সাজানো টেলিফোন। তিনি এমনকি একটি প্রাচীন ডাইভিং স্যুট কিনেছিলেন। সেটি গায়ে চড়িয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কিন্তু বাতাসের অভাবে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ার দশা হয়েছিল!
তার অদ্ভুত সংগ্রহশালা তার সৃজনশীলতাকে আরও রহস্যময়ভাবে প্রকাশ করত।
বিশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী এবং চিত্রধারা-পরিবর্তনকারী এই শিল্পী যিনি একসময় নিজের তুলির প্রতিটি আঁচড়ে স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দিতেন, তিনিই জীবনের এক পর্যায়ে এসে সেই সৃজনশীল শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সময়ের সাথে তার হাত কেঁপে উঠত, তার ভাবনা গুলিয়ে যেত। নিজের শিল্প সৃষ্টি করতে গিয়ে তিনি নিজেই যেন বন্দি হয়ে পড়ছিলেন।
যে মানুষটি রঙের বিস্ফোরণে তার কল্পনাকে প্রাণ দিতেন, তিনি একসময় তুলি ধরতেই ভয় পেতেন। তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা স্ত্রী গালা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন থেকেই দালির জীবনের রঙ মুছে যেতে থাকে।
গালা মারা যাওয়ার পর তিনি আরও বিষণ্ণ হয়ে পড়েন এবং জনসমক্ষে আসা কমিয়ে দেন। গালার অবর্তমানে দালি যেন হারিয়ে ফেললেন তার সৃজনশীলতার ভিত্তি।
তার শেষ জীবন ছিল এক অন্ধকার সময়ে ডুবে থাকার মতো। তিনি বিছানায় পড়ে থাকতেন। লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান এবং বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন। কখনো কখনো নিজের কণ্ঠও হারিয়ে ফেলতেন। যেন নিজের ভেতরের কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করার শক্তিও নেই।
শেষ জীবনে দালি
একজন শিল্পীর জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো—যখন তার হাতে সৃষ্টি করার ক্ষমতা থাকে কিন্তু তার মন আর তাকে নির্দেশ দিতে পারে না। দালি হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন কিন্তু সেই স্বপ্নকে ক্যানভাসে রূপ দিতে আর পারছিলেন না।
তবুও, দালি চিরকাল শিল্পের ইতিহাসে রয়ে যাবেন সেই রহস্যময় প্রতিভা হিসেবে যার কল্পনা ছিল সীমাহীন। কিন্তু শেষ জীবনে সেই কল্পনাই যেন তার বন্দিত্ব হয়ে উঠেছিল।
৮০ বছর বয়সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে তিনি পার্কিনসনসের মতো উপসর্গ অনুভব করতে থাকেন। এই ব্যাধি তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।
১৯৮৪ সালে তিনি আগুনে দগ্ধ হন, যা তার স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটায়।
অবশেষে, ২৩ জানুয়ারি ১৯৮৯ সালে ৮৪ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার শেষ দিনগুলো কেটেছিল নিঃসঙ্গতা ও শারীরিক দুর্বলতার মধ্যে, কিন্তু তার শিল্প চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।
সালভাদর দালি সৃজনশীলতার মুক্তচিন্তার প্রতীক। আধুনিক চিত্রকলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এক অনন্য সৃষ্টিশীল প্রতিভা যিনি বাস্তবতা ও অবচেতনতার মধ্যে এক বিস্ময়কর সেতু তৈরি করেছিলেন।
দালির কাজ আজও শিল্পপ্রেমীদের অনুপ্রাণিত করে। তাঁর চিত্রশৈলী, ভাবনা এবং ব্যক্তিত্ব শিল্পের ইতিহাসে চিরকালীন হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র
https://www.theartstory.org/artist/dali-salvador/
https://www.daliuniverse.com/2025/02/20/salvador-dali-and-andre-breton-a-surreal-connection/
https://www.thecollector.com/salvador-dali-the-life-and-work-of-an-icon/
https://www.britannica.com/biography/Salvador-Dali
https://www.reddit.com/r/museum/comments/sjplmd/salvador_dali_the_enigma_of_hitler_1939/
https://parispass.com/en/things-to-do/10-unique-dali-facts