Published : 11 Jun 2021, 07:25 PM
চিত্রকর্ম: শাহাবুদ্দিন আহমেদ
সকল সঞ্চয়ই পরিশেষে ক্ষয় পায়। উন্নতির অন্তে পতন হয়, জীবনের অন্তে মরণ হয়। মানুষ অদৃশ্য স্থান থেকে আসে, আবার অদৃশ্য স্থানেই চলে যায়
…….(মহাভারত- স্ত্রীপর্ব)
একজন বীরেন মামা
১. জেলা শহরের গালর্স স্কুল থেকে বস্ত্র ও কাপড় দোকানি বীরেন রায় তার কিশোরীকন্যাকে নিয়ে বাইসাইকেলের সামনে বসিয়ে যাচ্ছিলেন চার কিলো দূরের গ্রামের বাড়িতে। ইট সুড়কির বন্যা বর্ষায় সে রাস্তার দুই হাতা ভাঙ্গা, মাঝেমধ্যে রাস্তা ভেঙ্গে খাদ তৈরি হয়েছে। যে কারণে এর একটি খাদের পাড়ে কন্যা কনাকে সাইকেল থেকে নামিয়ে ওপার যান বীরেন বাবু। কিন্তু কন্যাকে আবার তুলে নিতে ভুলে যান তিনি। প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে অন্য একটি গ্রামের হালটে যেয়ে মনে পড়ে মেয়ের কথা।
বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিক্রিয়া চলছে চারদিকে। এখন এ বৈর সময়ে পরিচিত মানুষেরা অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে। উৎকন্ঠা আর শূন্যতায় ঘিরে ধরা দিন। মেয়ের কথা মনে আসতে এক অসহ্য বিয়োগ ব্যাথা বুকে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ঘাম হতে থাকে শরীরে। আবার ফিরে যান একই জায়গায়। দেখেন যে কনা একটু দূরে গাছের তলায় বইয়ের ব্যাগ ঘাস জঙ্গলে রেখে ছলছল চোখে বসে আছে। বীরেন বাবু গাছের তলায় বসে পড়েন মেয়ের সঙ্গে। এখন একটুতেই বুক ধরপড় করে। ভাবেন বাড়ি গিয়ে কি দেখতে পাবেন। বাড়িতে কি হামলা হয়েছে। বড় ঘর,কাচারি, গোয়াল, খড়ের পালা কি পুড়িয়ে দিয়েছে? গৃহিনী কি করছে? কি করছে অন্য ছেলে মেয়ে? বীরেন বাবুর গলা শুকিয়ে গেছে। ঝোলা ব্যাগে জলের বোতল খুললে তাতে জল নেই। বিশেষত রাতের বেলা দূরে দূরে আগুন আর হৈ চৈ চোখে পড়লে ভাবেন আর না, জমিজমা বাড়ি ঘর এবার বিক্রি করে দিতে হবে। মেয়েকে বলেন, "কণা আর একটু বসিরে! তোর কি খুব ভয় করতেছে? ভয় পাইস না। সব ঠিক অইয়া যাইবো। আজকা তো জমির বায়নার টাকা দিবার কথা মেহের ভাইর। দেহি আসে নাকি। বাড়ি যাইয়া খাইয়া দাইয়া বাইরামু যদি অবস্থা ভালো থাহে। কণা তার সুপুরুষ গৌর বনের বাবার চোখের নীচের কালি দেখে, তার চোখের তারায় অনিশ্চয়তার ছায়া দেখে। বলে শরীর কি খারাপ লাগতেছে বাবা?
২.
কোলকাতার বাগুইআটির বাড়িতে বসে বীরেন বাবু এই স্মৃতি আর ১৫ বছর আগের যাপন করা এ জীবনের কাহিনী শুনাতে থাকেন ঢাকা থেকে তার জ্যেঠতুতো বোনের কণিষ্ঠ সন্তানকে। ঐ ভাগ্নে তার নিজের ভাগ্নের বিয়েতে কোলকাতা নগরীর পেরিফিরি এরিয়ায় এসেছিলেন। এ বিয়েটিই মামার এখানে আসার সূত্রধরের ভূমিকা পালন করেছিল।
ধীরেন মামা তার বাংলাদেশী ভাগ্নেকে পেয়ে তার হারিয়ে যাওয়া দেশের আর সময়ের স্মৃতির উজানে চলে গেলেন।
"ঐ সুময় আমাদের দুকান থিকা মাল নিতো পাইকারি, বাকী রাখতো, তাগো মদ্যে দেখা গেল কয়েকজন আর আমার সাতে দেহাই করে না। বুঝি, কাউরে কইতে পারি না। কেন তাদের আর পাওয়া যায় না। ফাঁকি দিল। আর .. ঐ টাকা পাই নাই। আবার এগা মদ্যে কেউ কেউ দিছে এডাও সত্য।"
এ সব বিহবলতা পেয়ে বসলে মামা ভাগ্নে দুজনেই আড়ষ্ঠ হয়ে যান। মামা তার বাড়ি, পালান, চাষের জমি, পুকুর বিক্রি করে কোলকাতায় চলে আসার কাহিনী বলতে থাকেন। বলতে থাকেন ঐ গ্রামের সৎ মুসলমান প্রতিবেশীরা তাকে বার বার ইন্ডিয়া পাড়ি দিতে বারণ করছিল। কিন্তু রাতে নামলেই মোটর সাইকেলে করে বাড়ির পৈঠা ধইরা উইঠা আসতো চেনা অচেনা নানা চেহারার লোকজন। তারা নানা কায়দায় নানা উছিলায় টাকা দাবি করতে থাকে। তাগো তো আর বাধা দেয়ার ক্ষমতা ওগো নাই। একজন দুইজন না। দলে দলে আসতো।
'একবার একজন কয় কি যে এইডা কিন্তু চাঁদা না। ঘরের অন্য রুম থিকা মেয়ে বলে যে 'চাঁদা নাইলে এইডা কী ?' এতে কইরা প্রচন্ড ক্ষেইপ্যা যায় একটা ছেলে। হে কী কান্ড! কিরা কতা কইলো। তারপর অসহ্য রকমের গালি আর হুমকির পর হুমকি। মেয়ে আমার তরাসে কাঁপে। একবার তো আমাগো খেড়ের পালায় আগুন ধরাইয়া দিল। গোয়াল ঘরে গরুদের দাপাদাপি । খালি ভয় দেখানোর জন্য। যেন আমরা তাগো কমদামে সব দিয়া ইন্ডিয়া পলাইয়া যাই। " কী যে যন্ত্রনাকর দিন। দিন রাত সমান মনে অইতো। আমারতো টেনশনে একবার মাইল্ড স্ট্রোকই অইয়া গেল। হাটের্র অসুখ, ডায়াবেটিস শুরু অইয়া গেল।
মামা বলতে থাকেন, এইহানে কিন্তু এই সব নাই। মুসলমান লোককে কেউ কিছু কইলে কিন্তু খবর আছে। ওরা রুইখা খাড়ায়। আমাগো মতোন পলায় না। বাংলাদেশে অয় সহিংসতা, একপাক্ষিক, একতরফা। প্রতিরোধ নাই। এইখানে কিন্তু দুই পক্ষের সংঘর্ষ অয়। আর এহোনো ভারত সিক্যুলার। এহানে মজসদিরে এট্টা ইট তুল্লে খবর আছে। আর পত্রিকায় পড়ি বাংলাদেশে তো প্রতিদিন গড়ে দুইটা মন্দির, মূর্তি ভাংচুর করা হয়। নানান স্বার্থ জমি জমা, বাড়ি ঘর, টাকা পয়সা নিয়্যা। ধমীয় মতবাদ নিয়্যাও লাগে।
মামা জিজ্ঞেস করেন ভাগ্নেকে তার ছেড়ে আসা, হারিয়ে যাওয়া গ্রামের লোকজন এখন কেমন আছে।
…ওই শুন! আমাগো গ্রামের দিকে তো আরো আত্নীয় স্বজন আছে, তাগো বাড়ি কী যাওয়া অয়? আর সবতো দেহি টাউনে যাইবার লাগছে। কেউ মানিকগঞ্জ শহরে, কেউ ঢাকায়। সব চাষের জমি বিক্রী আইয়া যাইতেছে খবর পাই । আর বানের জলের মতো নীরবে আ্সতেছে ইন্ডিয়ার বিভিন্ন পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়। কারো কি কোন বিকার নাইরে? কোন পদক্ষেপ নাই? তুই না বামপন্থী রাজনীতি করতিস! ঢাকায় বামপন্থীরা তো আমাগো চাইতেও সংখ্যালঘু নারে? ৪২ বছর আমাগো কোলকাতায় বামফ্রন্ট ছিল, এহন টিকিটা দেহা যায় না। যাও আছে দুই চার জন ত্যাজ হারাইয়া ফা্লাইছে।
এভাবে সকাল থেকে দুপুর চলে আসে। চলে আসে মধ্যাহ্ন ভোজের সময়। খেতে খেতেও মনের জমাট পাথর গুড়ো করছেন তিনি কথার জাঁতাকলে। আমার শরীরের ঘ্রাণে যেন তার গ্রাম বাড়ি পুকুর, পালান , গাছ লতা জড়িয়ে রয়েছে। ভাগ্নেকে দেখে তার স্মৃতিভারাতুর মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝড়তে থাকে।
বীরেন মামা মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে ছেড়ে কোলকাতার ফুল বাগানে থাকতেন। তার মেসে আসতেন মানিকগঞ্জ, টা্ঙগইলের মুক্তিযোদ্ধারা। আসতেন মুজিবনগর সরকারের লোকজনও।
আমি তাগো জন্যে পাচক অইয়া গেলাম। রানতে রানতে আর সময় পাইতাম না। ঘাম বাইরিয়া যাইতো। হইটালের খাওন উনাদের মুখে ধরতো না। রুচি আইসতো না। আমার ঘরে আসতে হইতো। বাজার কইরা লইয়া আসতো কেউ কেউ। রান্নায় সাহায্য করতো। কাইটা কুইটা ধুইয়া টুইয়া দিতো। আমি কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা অইয়াই আইছিলাম। আমার ইন্ডিয়া যাওয়া আসা ছিল নিয়মিত। রাণা ঘাটে ট্রেনিং লইছি অল্প কয়াকদিন। শুনছিসতো এই সব কথা।
৩.
মনে পড়ে রে! সেই যে সাইকেল নিয়্যা কলেজে যাইতাম কলেজে। কলেজ থিকা ফিরতে দেরি হেইলে মা মাইটালের পাড়ে হিজল গাছের তলায় খাড়াইয়া থাকতো। কহন ফিরি তা দেহার জন্যে। কুকুর পোষার শখ ছিল। আথালপাড়ে আমার জন্য আমার ভোলার সঙ্গে বাছুড়ডাও খাড়াইয়া থাকতো। এহনকার এই মাঘ ফালগুনে শরষা ক্ষেত ফলে নুইয়া পড়ছে। খেসারি মাসকালাই, মটর কলই য়ে ভইরা রইছে সব। আমরা সাইকেলে কইরা বাজারে এমুনকি স্নানেও বড় গাঙ্গে, কালীগঙ্গায় যাইতাম। পথে পইড়তো পলাশ, শিমুল মান্দারের চালা। এহন এই পাঁচাত্তর বছর বয়সে রাইতে ঘুম কইমা গেছে। শ্যাষ রাইতে ঘুম ভাইঙ্গা গ্যালে দ্যাশের কতা মনে পড়ে। স্বপ্নেও দেহি। গ্রামের সেই হালট, ধূলা উড়ানো নতুন মাটি তুলা রাস্তায় বাচ্চাদের মার্বেল খেলা ফুটবল খেলার মাঠ, এই তুগো ম্ইধ্যে কেউ আমাদের গ্রামটায় দশ বছরের মদ্যে কোনদিন গ্যাছস? আমাগো বাড়িডার গাছ গাছালি ঐ রকম আছে? না কাইটা বেবাক সাবার করছে। আম বাগান আর নারকলে গাছ গুইলা….
বৃদ্ধ বীরেণ মামার স্মৃতি মেদুরতা যে কত ইলিউশন, ভ্রান্তি সে সবের যে কিছুই নেই; সব পরিবর্তন হয়ে গেছে। গ্রামের মধ্যে গ্রামই নেই , সব চকচকে। পীচঢালা রাস্তা, গ্রামে আগের মতো কাদা ধূলা নাই, কারো ঘরে বাশেঁর বেড়া নাই। গ্রামে সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট টেলিভিশন, ইন্টারন্টে । চাষের জমি উধাও, সেখানে নতুন নতুন ঘরবাড়ি, কারো মধ্যে সরলতা নেই। সবাই আগের চেয়ে তার আমলের থেকে বেশিমাত্রায় ভোগবাদিতার কাদার মধ্যে ডুবে গেছে তাতো তার খেয়াল নেই, ভাবে তার ঢাকা থেকে আসা ভাগ্নে। অথবা বাইরে থেকে বুঝতে পারলেও মস্তিষ্ক অন্তরেরর মধ্যে যে সেই কিন্তু ধর্মের নামে অধর্ম চর্চা যে বেড়ে গেছে এটা তিনি বুঝতে পারেন।
এহনতো দেশে চান্দের মদ্যে কি মওলানা সাইদ না কি, তার নাকি মুখ দেহা যাইতেছে। কি রে! ঢাকায় কি মঞ্চের কতা শুনি অনেক নাকি লোক অয়। জায়গাডা কি পিজি হাসপাতালের দিকে না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিটলাদের বিচারের মতোন, রাজাকারদের ফাঁসি চায় ওরা? মোল্লারা কি বিরুদ্ধে ক্ষ্যাপছে। আওয়ামী লীগ কি করে। তারা কি এতে সমথর্ন দ্যায়? একসঙ্গে অনেক প্রশ্নের ঝড়। কৌতুহল …আর …আশা ।
কাদের মোল্লা তো বিশাল রাজাকার ছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় তার ফাঁসি হইলো। হায় রে হায় ! তার পক্ষ নিয়্যা এইহানে কোলকাতায় কি বড় মিছিল! ওরে বাপরে। ধর্ম নিয়্যা ইচ্ছা মতো খেলতেছে। আর মানুষও সেইরকম! ধর্মরে অধর্ম আর অধর্মরে ধর্ম ভাবে।
মামার চোখের রজতবিন্দু আস্তে আস্তে কান্নার বাষ্পে ভরাট হতে থাকে। কাঁদতে থাকেন তিনি।
অনেক কথা, কথার পিঠে আসতে থাকে। মামার সঙ্গে দেশে থাকতে ভাগ্নের এভাবে প্রাণ খুলে কথা বলা খুব কম হয়েছে। মামা যে এত ভালো কথক এতদিন সে খেয়াল করেনি।
এমন সময় মামার মেয়ে কণা গাঁদা ফুল গুজে দিয়ে যায় ফুলদানীতে। শীতের গাঁদা ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়লে মামা বলে এই কোলকাতায় সারাবছরই বারো মাসেই গাঁদা হয়। ক্ষ্যাতে গাঁদার চাষ পর্যন্ত করা হয়। বাংলাদেশেও একই চাষ হয় বারো মাসই। বাংলাদেশেও ফুল চাষে সরকারও সাহায্য করে। ফুলের ব্যবাসায় অনেকেই জড়িয়ে পড়েছে। এগুলো করপোরেট কালচারের একটা অংশ, উত্তর আসে।
চলেন আপনারে বাই এয়ারে নিয়ে যাই।
মায়া বাড়াইয়া লাভ কি? আমি আর যামু না। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়াই মনে অয় ভুল করছিলাম। গ্রান্ড হোটেলে বইসা মজা মারলেই ভালো হইতো। বাংলাদ্যাশেতো ওরাই শক্তিশালী। আসল মুক্তিযোদ্ধাগো খবর নাই। নকলের ভীড়ে আসল উধাও । খলনায়করাই হইলো নায়ক , আর নায়করা হইলো গিয়া খলনায়ক।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। ভাগ্নে তার অন্য আত্নীয়ের বাড়ি যাবে। বীরেন মামা গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে অটো স্ট্যান্ডে এস ভাগ্নেকে গাড়িতে তুলে দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি অন্য বাঁকে অদৃ্শ্য না হওয়া পযর্ন্ত তাকিয়ে থাকেন।
এ গল্প আমার এক বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু সহপাঠীর মামার গল্প।
একজন রণজয়দা
১. রণজয় দা আমার সেই একই বন্ধুর সহোদর, ভারতের ঝাড়খন্ডের দেওঘরে থাকেন। আমার বন্ধু যখন বেশ ছোট, গ্রামের স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে সময়েই তিনি বাংলাদেশে ছেড়ে ভারতে চলে যান। অনেকবার তার সম্পর্কে আমার বন্ধুর মুখে শুনেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পাঠকালীন সময়ে ওকে চিঠি লিখলে আমার কথাও সেখানে থাকতো। আমাদের উনি বলতেন যে কেরাণী হওয়ার জন্য যেন লেখাপড়া আমরা না করি। স্বাধীনভাবে শিড়দাঁড়া উঁচু করে যেন বেড়ে উঠি। আমার প্রয়াত বাবা বৃটিশ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে কোলকাতায় চাকরি করতেন। ভারত ভাগের সময়ে বাবা ঢাকায় চলে আসেন। আমি আমার ভাই বোন অনেক বার কোলকাতায় গিয়েছি।
এবার বন্ধুকে তার দাদা ওনার ওখানে বেড়াতে যাওয়ার জন্য বলতেন। আমার অনেকবার ইচ্ছাও ছিল আমার বন্ধুর সঙ্গে কোলকাতা যাওয়ার। তো আমার বন্ধুর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য কোলকাতায় যেতে হবে। আমাকে সে বলে তার সঙ্গী হওয়ার জন্য। কিন্তু আমার হাতে সময় ছিল না।
২. ওর সঙ্গে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ওর মুখ থেকে কোলকাতায় দেওঘরে দাদার সঙ্গে ওর সাক্ষাৎ আর সময় কাটানোর গল্প শুনি। ওদের মুখোমুখি দেখা হয়েছিল ৪১ বছর পর । কেননা ও যখন প্রাইমারিতে নীচের ক্লাশে পড়তো, তখন স্থানীয় মহুকুমার সবচে প্রাচীন ও বিখ্যাত কলেজে বি.কম পড়তেন দাদা। বন্ধুর মুখ থেকে শোনা যে, এ সময় কোন কারণে অবুঝ আদরের ছোট ভাইকে কোন খেলায় বাধা তার মূল্যবান খাতার কাগজ ছিড়ে ঘুড়ি বানানোর অপরাধে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে প্রচন্ড পিটিয়ে রক্ত বের করে ফেলে। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার বাবা রণজয়কে ধাওয়া দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। দুপুর সন্ধ্যার খাওয়া বন্ধ , ভয়ে ভয়ে দাদা বাড়ি ফেরে রাতে, চুপি চুপি বাবার নজর এড়িয়ে।
৩. সেই ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, পুত্র নিয়ে চিকিৎসা নিতে কোলকাতার প্রান্তিক এলাকায় ভাগ্নের বাড়িতে ওঠে। আষাঢ় বা শ্রাবণের জলছাট বাতাসে ভিজতে ভিজতে উড়তে উড়তে বেশ ভোরে ভাগ্নের বেলঘড়িয়ার বাড়ি খুঁজে পায় ওরা। তখন কাঠকয়লার রান্নার ধোয়া রাস্তায় আর মোড়ে মোড়ে ধুপ ধুনোর গন্ধের মৌতাত। ঢাকা থেকে কোলকাতা নগরীর বিরাটীতে শ্যামলী পরিবহনের বাস থেকে নেমে অনেকটাই ঘুরতে ঘুরতে রিক্সা নিয়ে লাগেজ ব্যাগে ভরাট হয়ে ভাগ্নের ভাড়া বাড়িতে ওঠে।
জীবনের স্তরে স্তরে অধীত বাংলার রেনেসাঁ –যুগ পুরুষদের জীবনী, সাহিত্য্ গল্প উপন্যাস,আর কবিতার মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ে। কোলকাতা তার কাছে স্বপ্ন। কৈশোরে দাদাদের চিঠি পড়ে আর আকাশবানী শুনে শুনে অন্তর্জগত আর দিব্যজ্ঞানের অনুসন্ধানে নামা মানুষ সে।
নিজের ঘরের জানালার পাশের গাছের ডাল পাতার মতো চেনা মনে হয় তার কোলকাতা, যদিও সশরীরে এই প্রথম।
ছোটবেলায় অনেক দিন স্বপ্নে সাইকেল নিয়ে ঢাকা থেকে উড়ে উড়ে কোলকাতায় এসেছে সে।
প্রচুর প্রিয় ব্যক্তিত্ব বিশেষত কবি,লেখক যাদের সৃষ্টিকর্মের জন্য আত্নার সহচর হিসাবে ঠাঁই করে নিয়েছে তাদের স্মৃতি ভীড় করছে। অনেকবার স্বপ্নে সে কোলকাতায় এসেছে। তার ভাইরাও এসেছে স্বপ্নে। এই তাহলে কোলকাতা, তার প্রথম আসা। বন্ধু কবি মানুষ, হৃদয়বৃত্তি পদ্মফুলের মধুর মতো। তার সমস্ত কথাই নান্দনিক পয়ারবদ্ধ। তার আনুভূতিক বিষয়গুলোও সবিস্তার ধ্রুপদী প্রকাশ ।
একসময় দাঁত নখে লড়াই করা জীবন সংগ্রামী রণজয় অনুকূল চন্দ্র ঠাকুরের ভক্ত হয়ে কোলকাতা ছেড়ে ঝাড়খন্ডের দেওঘরে চলে যান। তিনি ইশ্বরকে দেখতেন জ্ঞানমার্গ দিয়ে, ভক্তিমার্গ দিয়ে নয়। যাপনের মধ্যাহ্নে এসে ডানকুনিতে ছোট একটি একতলা মাথা গোঁজার ঠাই করেন নিজ নামে।
বাংলাদেশ থেকে ৭২/৭৩ সনে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়া রনজয় দা নরম নীরিহ অন্তর্মুখী স্বভাবের হলেও একাত্তরে তার এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। বাড়ির লোকজনের বাধায় অস্ত্রের প্রশিক্ষন নেয়া সম্ভব হয়নি। যাওয়া হয়নি সীমান্ত এলাকা পেরিয়ে। কিন্তু তার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের জন্য পোষাক, খাবারের জন্য চাল ডাল সংগ্রহ সবই করতেন তিনি। ভাল ছাত্র হিসাবে এলাকায় সুনাম থাকায় স্কুল কলেজের সবাই একনামে চিনতো । এলাকার রাজাকাররাও তাকে ঘাটাতো না। কেননা রাজাকার প্রধানের পুত্র ছিল দাদার কলেজ সহপাঠী। সে সহপাঠী আবার ছিল মুক্তিযুদ্ধের ঘোর সমর্থক। সুযোগের সদবব্যহারও করেছেন তিনি একশত ভাগ, পদ্মা নদীতে পাকিস্তানী হানাদারদের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত মুক্তিবাহিনীর অনেক সদস্যকে সেবা করেছেন তিনি। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ওঠেনি। পরে স্বাধীন দেশেই নানা রকম হিংসা শঠতার শিকারে পরিণত হন তিনি, যার মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষও ছিল। একটি ঘটনায় চরম অপমানিত হওয়ায় দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছর পরেই তার অপর সহোদর বড় ভাইয়ের ওখানে কোলকাতায় চলে যান তিনি। সেখানে স্কুলে চাকরি নেন।
৪১ বছরে এই দাদার কথা সে ভেবেছে অনেক। চিঠিতে তো আর সব বলা হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া চিঠি লেখার অনভ্যস্থতাও একটি বিষয় বটে।
পাতলা দোহারা গড়নের সেই দাদা দেওঘর থেকে বেলঘড়িয়া রেলস্টেশনে নেমে ঘাসের বাদার আর নর্দমার কচু বন ভেঙ্গে কাঠকয়লার চুলার চায়ের দোকান পার হয়ে প্রফুল্ল নগরে পোঁছান। তখন ভালো তবলা বাজিয়ে ছোট ভাগ্নের রেকর্ডারে জাকির হোসেনের হাতের তালু আর আঙ্গুলের ধারাপাতে বৃষ্টিপতন হচ্ছিল। খৈনি টিপতে টিপতে আগুয়ান দাদাকে তার সর্বকণিষ্ঠ ভ্রাতা দেখার বিস্ময় আর পুলক। যেন সৌর জগতের অপর প্রান্ত থেকে মহাকালের কোন খেয়ায় চেপে নেমে এসেছেন তিনি। হাঁটার ভঙ্গী, গতি স্পন্দনের তালে কী যেন ভাবতে ভাবতে স্নেহের অনুজকে দেখেই থমকে যান দাদা। আবেগে ডুকরে ওঠেন। যে ছোট ভাইকে স্টীল ছবি বা চিঠির অক্ষর ছাড়া মুখোমুখি দেখার ভাগ্য হয়নি। কী কী বলতে যেয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন, কাঁদতে থাকেন। কথাগুলো ভেসে যায়।
৪. এই দাদা ছাত্রজীবনে অনেক পাঠ করতেন। গ্যারিবল্ডী থেকে সুভাষ বসু, গান্ধী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমির উপর। নজরুলের বিদ্রোহী গান অসাম্প্রদায়কি চেতনা তাকে নাড়া দিত বলে চিঠিতে লিখতেন। লিখতেন তার প্রিয় গান 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে', 'হিন্দু না ঔ মুসলিম জিজ্ঞাসে কোন জন?'
সে পারিবারিক গ্রন্থাগারটির সামাজিকীকরণ ছিল বিভিন্ন দিবস ধরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের যোগসূত্র ধরে। আবছাঅস্পষ্ট তাও মনে পড়ে এই দাদা তাকে মোহিনী মোহনের লেখা " মুক্তির মন্দির সোপানতলে" গানটি শিখিয়েছিলেন। এসব আবার তাদের বাবার কাছ থেকে পাওয়া। মুকুন্দ দাসের গানের চর্চাও হতো ওদের বাড়িতে।
৫. স্ত্রীকে সল্টলেক আনন্দময়ী হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দাদা আমার বন্ধু আর তার পুত্রকে নিয়ে যান পূর্বা এক্সপ্রেস ধরে দেওঘরে। কোলকাতা থেকে জসিডি স্টেশনে যাওয়ার পথ তিনশ দশ কিলোমিটার। ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা পর থেকে বড় বড় পাথর, পাথুরে জমি, অসমতল উচু নীচু টিলাময় কয়লা,অভ্র খনি। তা দেখতে দেখতে বিকেলে জসিডি রেলস্টেশন থেকে অটো রিক্সায় দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রমে পৌছে ওরা।
বিশাল জায়গা জুড়ে আশ্রমের অবস্থান। স্কুল কলেজ, হাসপাতাল, ভেষজ আয়ুর্ব্বেদ ওষুধ প্রস্তুতের কারখানা, উদ্ভিদ উদ্যান, গোশালা, দুগ্ধ উৎপাদন কেন্দ্র। গাছে জঙ্গলে কালোমুখ হনুমান, ময়ূর, ঘুঘু ছাড়াও ছোট চিড়িয়াখানা আছে। অনতি দূরে এটি টিলার ওপর রয়েছে শিশুদের বিনোদন কেন্দ্র। এখানকার বৈদ্যনাথ ধাম এলাকাটিও বেশ বড়। দাদার কোয়াটারের ছাদে দাঁড়ালে নন্দন, ত্রিকূট আরো কতগুলো পাথুরে পাহাড়, টিলা দেখা যায়।
পুত্রসহ সেসব ঘুরে ফিরে সন্ধ্যায় ঠাকুরের সমাধি দর্শনের পর ঠাকুরের পৌত্রদের সান্নিধ্যে যেতে হয় তার বৌদির সঙ্গে। তারা শুনতে চান ঢাকার খবর। একর পর এক প্রশ্নের কী সব এলোমেলো উত্তর দেয় সে, তা আর মনে নেই। এই ঠাকুর কিন্তু বাংলাদেশের পাবনার হেমায়েতপুরের লোক। তাদেরও পাবনা ছেড়ে এইদিকটায় চলে আসতে হয়েছে। কেন আসতে হলো এ ইতিহাস আমার বন্ধু জেনেও সে বিষয়ে কোন কথা তোলেননি তাদের সামনে। সেখানকার ওষুধ নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান রসায়নবিদ দেশভাগের সময়কার তার পিতা পিতৃব্যদের গল্প বলেন বন্ধুর কাছে। বিক্রমপুর, অধুনা মুন্সীগঞ্জে পদ্মার পাড়ের সেই বাড়ি, সেই পুকুরঘাট, আজো তার স্মৃতিতে। সেখানে কখনো যাওয়া হয়েছে কিনা তা জানতে চান তিনি। কিছু স্মৃতি সততই সুখের আর কিছু সবসমযেই দুঃখের। তিনি বলেন, তৎকালীন পূব বাংলার বাঙ্গালী হিন্দুদের জীবন ও দেশভাগের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে থাকেন।
পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন আত্নীয় স্বজনের কাছে বিভিন্ন উছিলায় গিয়ে বিভিন্ন বাঙ্গাল পাড়ায় অথবা কসমোপলিটন পাড়ায় আমার বন্ধু তার বীরেণ মামা, রনজয়দার মতো কুরুক্ষেত্র থেকে পলাতক অর্জুনদের খুঁজে বেড়ায়। তাদের তত্ত্ব তালাশ করে। দেশভাগের ক্ষত আর বিভেদ নিয়ে নোট নেয়, ডায়েরি লিখে। আমাকে জানায়, বড় গবেষণা করার জন্য। আর আমি তাকে বলি কী হবে এ সব চর্চা করে। আমি তাকে শত চেষ্টা করেও ফেরাতে পারি না ঐ কাজ থেকে। কেননা তাতে এ সব নেশার লোকেদের ক্ষুণ্ণি বৃত্তি, জীবনে প্রতিষ্ঠায় ঝামেলা বিপত্তি আর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। সে উত্তর দেয় ভালোবাসার আন্দোলন তৈরির জন্যই আমি অসীম তমসার মধ্যে যতটুকুই পারি আলোক সঞ্চার করতে পারি। সবাই মিলে যদি বিন্দু বিন্দু কাজ করি তবে মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তন সম্ভব।
আমরা আলোচনা করি আড্ডায় সারা দুনিয়ার সকল ধর্ম জাতি গোত্র জ্ঞান বিসর্জন দিয়ে অভেদ মনুষ্যজাতি জ্ঞান করে স্বপ্নে ঢুকে পড়ি। আমরা আলোচনা করি এবং ভাবি মহাকাল আর প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায়। তারপরও যে মানুষরা লাভে লোভে চলে, সে মানুষেরাই কখনো কখনো সংকীর্ণ স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহত্তর স্বার্থে আত্মোৎসর্গ করতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। অদ্ভূত মনুষ্য চরিত্র। আর কেউ কেউ ভাবি দুনিয়ায় কেনই বা মানুষ জন্ম নেয় আবার কেনই বা চলে যায়।