Published : 06 Jul 2025, 04:08 PM
সপ্তাহের পাঁচদিন কর্মব্যস্ততার চাপে ক্লান্ত শরীর ও মন যখন ছুটির দিন পায়, তখন অনেকেই নানান অভ্যাসে নিজেকে তরতাজা করার চেষ্টা করেন।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব অভ্যাস সপ্তাহান্তে বিশ্রাম নেওয়ার নামে করা হয়, এর মধ্যে কিছু কিছু পরের সপ্তাহকে আরও কঠিন করে তোলে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মনরোগ-বিশেষজ্ঞ ক্যারোলিন ক্যারল এবং জে কানজিয়ালোসি রিয়েলসিম্পল ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেন, “সামান্য কিছু পরিবর্তনেই ছুটির দিনগুলো হতে পারে আরও উপকারী। যা মানসিক স্বচ্ছতা, শক্তি ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সপ্তাহ শুরু করতে সাহায্য করবে।”
অতিরিক্ত ‘স্ক্রিন টাইম’
সপ্তাহের চাপ কমাতে অনেকেই টিভি সিরিজ দেখা, স্মার্টফোনে দীর্ঘ সময় কাটানো বা টিকটকে সময় ব্যয় করেন।
ক্যারলিন ক্যারল বলছেন, “এভাবে অন্যদের জীবনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখা এক ধরনের অনুভূতি তৈরি হয়, যেখানে সরাসরি কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে হয় না।”
তবে এই অভ্যাস ঘুম, খিদা ও শক্তির স্বাভাবিক ছন্দকে নষ্ট করে দেয়। ফলে কাজ শুরুর দিনে হয় মাথা ঝিমঝিম, ক্লান্ত মন ও শরীর নিয়ে।
এর সমাধান হিসেবে ক্যারল, নির্দিষ্ট সময় পর পর বৈদ্যুতিক যন্ত্রের পর্দা থেকে বিরতি নেওয়ার পরামর্শ দেন।
একটি পর্ব শেষ হওয়ার পর বা ‘স্ক্রলিং’য়ের এক পর্যায়ে নিজেকে থামিয়ে দিয়ে রান্না, লেখালেখি বা হালকা স্ট্রেচিংয়ের মতো কাজ করা দরকার।
এতে শরীর-মন দুটাতেই সংযোগ ফিরে আসে। আর প্রকৃত চাহিদাগুলো বোঝা যায়। সেটা হতে পারে বিশ্রাম, মেলামেশা বা অন্যকিছু।
একেবারে নড়াচড়া বন্ধ রাখা
কেউ কেউ ছুটির দিনে একদম শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেন, আবার কেউ হয়ত ছুটির দিনেও নিজেদের ঠাঁসা সময়সূচিতে আটকে ফেলেন।
ক্যারলিন বলছেন, “অনেকেই মনে করেন ব্যায়াম মানেই শাস্তি, শরীর নিয়ে দুশ্চিন্তা, তাই তা এড়িয়ে চলেন।”
তবে মানসিক স্বচ্ছতা, ঘুম ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে শরীরচর্চা সাহায্য করে। সপ্তাহান্তে একেবারেই নড়াচড়া না করলে আরও বেশি ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন বা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
এই মনরোগ চিকিৎসক পরামর্শ দেন— শরীরচর্চাকে বাধ্যতামূলক না ভেবে বরং শরীরের ভালো লাগা কোনো কাজ বেছে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সেটা হতে পারে হালকা হাঁটা, ঘর গুছাতে গুছাতে নাচা বা দিনের শুরুতে পাঁচ মিনিটের স্ট্রেচিং।
পুরোপুরি পরিকল্পনা এড়িয়ে চলা
অনেকেই ভাবেন, সপ্তাহজুড়ে এত পরিকল্পনা আর দায়িত্বের পর ছুটির দিনে আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে না। তবে পরিকল্পনা না করলে সেই অজানা কাজের চাপ আরও বেশি মানসিক চাপ তৈরি করে।
ক্যারল বলেন, “যতদিন কাজগুলোকে অস্পষ্ট ও অনির্ধারিত রাখি, ততদিন সেগুলোর চাপ অজান্তেই বাড়তে থাকে।”
সমাধান? বড় পরিকল্পনা নয়, বরং ছোট্ট এক ধাপ। হতে পারে কাজ শুরুর দিনের ক্যালেন্ডার দেখে নেওয়া বা একটা কাজ লিখে রাখা যেটা ভুলতে চাই না।
খুব ছোটভাবে শুরু করলে পুরো কাজটা কঠিন মনে হয় না, বরং মানসিকভাবে তৈরি হওয়া সহজ হয়।
ঘুমের সময়চক্র নষ্ট করে ফেলা
ছুটির দিনে অনেকেই খুব দেরিতে ঘুমাতে যান বা অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে কাটান।
ক্যারলিন ক্যারলের ভাষায়, “এটা এক ধরনের আনন্দ বাড়ানো, দায়িত্ব এড়িয়ে চলা বা মুক্তির অনুভূতির চর্চা।”
তবে ঘুমের সময় যদি খুব এলোমেলো হয়ে যায়, তাহলে শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি মানিয়ে নিতে পারে না।
তিনি বলেন, “ঘুমানোর সময় একটু এদিক-সেদিক হলেও প্রতিদিন একই সময়ে ওঠার চেষ্টা করুন। পাশাপাশি রাতে ঘুমানোর আগের সময়টা নিয়ে সচেতন হোন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন— রাত জেগে থাকাটা কি সত্যিই আরামদায়ক নাকি শুধুই মনের অস্থিরতা?”
পুরো ছুটির দিনজুড়ে কেবল কাজের তালিকা পূরণে ব্যস্ত থাকা
যারা মনে করেন ছুটির দিনই একমাত্র সময় সমস্ত ঘরের কাজ, বাজার, কাপড় ধোয়া, পরিস্কারসহ সব সেরে ফেলার, তারা হয়ত কর্মদক্ষতায় আনন্দ পান। তবে এই সময়টুকু একঘেয়ে কাজের ধারাবাহিকতা হয়ে যায়।
মনরোগ-চিকিৎসক জে কানজিয়ালোসি বলেন, “এইভাবে কাটানো ছুটির দিনে কর্মফল পেলেও মানসিকভাবে সন্তুষ্ট হওয়া যায় না।”
তাই কাজ ও আনন্দের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। কাজ, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো ও নিজের জন্য সময়— এই তিনটির মাঝে সমন্বয় ঘটালেই সপ্তাহের শুরু হয় আনন্দময় মনোভাব নিয়ে।
একেবারে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া
অনেকে ছুটির দিনগুলোতে পুরোপুরি নিজেকে সমাজ ও দায়িত্ব থেকে গুটিয়ে নেন। মনে করেন, এটি মানসিক শান্তির পথ।
তবে জে কানজিয়ালোসি বলছেন, “এভাবে মানসিক বিচ্ছিন্নতা বাড়ে। যা হতাশা, একাকিত্ব বা বিরক্তি তৈরি করতে পারে। কারণ কিছুটা সামাজিক যোগাযোগ, অর্জন বা আনন্দদায়ক কিছু করা— এই তিন উপাদান ডোপামিন, অক্সিটোসিন, সেরোটোনিন ও এন্ডরফিনস’য়ের মতো হরমোন বাড়িয়ে তোলে।”
এই চক্র থেকে বের হতে বন্ধু বা পরিবারের কাউকে দিয়ে একটা সহজ পরিকল্পনা করা— যেমন এক কাপ চা খাওয়া বা একসঙ্গে হাঁটাই হতে পারে সমাধান।
ছুটির দিনকে নতুনভাবে ভাবুন
প্রায়ই বিশ্রাম নিতে গিয়ে যদি অপরাধবোধে ভোগা হয়, যদি মনে হয় সময় নষ্ট হচ্ছে- তাহলে সেই বিশ্রামের সময়টাও হয়ে যায় এক ধরনের কর্মব্যস্ততা।
ক্যারলিন ক্যারল মনে করিয়ে দেন, “বিশ্রাম ও পুনর্জাগরণ নিজের মধ্যেই একটি উৎপাদনশীল কাজ। এটি বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজন।”
বিশ্রামের মানে হতে পারে- ঘুম, প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো, না হয় সৃজনশীল কোনো কাজে ডুবে যাওয়া।
ছুটির দিন নির্ঝঞ্ঝাট হওয়া মানে এই নয় যে তাতে কোনো ছন্দ থাকবে না। বরং হালকা একটা কাঠামো থাকলে দিনগুলো অগোছালো না হয়ে অর্থবহ হয়ে ওঠে।
“লক্ষ্য কখনই শুধু কর্মদক্ষতা নয়। বরং এমন ছন্দ তৈরি করা, যাতে সময় কাটানো হয় সচেতনভাবে, চাপ ছাড়াই”- বলেন ক্যারল।
আরও পড়ুন
স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের অস্বাস্থ্যকর দিক