Published : 22 May 2025, 01:28 PM
বানু মুশতাক একজন ভারতীয় লেখক, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী। কন্নড় ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। ১৯৪৮ সালে কর্ণাটকের একটি ছোট শহরে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখায় দক্ষিণ ভারতের মুসলিম নারীদের জীবনসংগ্রাম, নিপীড়ন ও প্রতিরোধের চিত্র ফুটে ওঠে। ২০২৫ সালে তাঁর ছোটগল্প সংকলন হার্ট ল্যাম্প আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার অর্জন করে, যা কন্নড় ভাষায় লেখা প্রথম বই হিসেবে এই সম্মান পেয়েছে। তাঁর সাহিত্য ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। তিনি সাংবাদিকতা ও আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন এবং বন্দায়া আন্দোলন-এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন।
বানু মুশতাক – সাহিত্যের অরণ্যে এক বিদ্রোহী । তাঁর কন্ঠে শুধুমাত্র গল্প বলা নয়, বরং অচেতন সমাজের অবহেলিত কণ্ঠস্বরগুলোকে জাগিয়ে তোলার এক শক্তিশালী আহ্বান থাকে। তাঁর লেখনীতে মিশে আছে অতীতের আকুল ইতিহাস, চলমান সমাজের সংগ্রাম এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নের অনাবৃত কাহিনী।
বানু মুশতাকের সাহিত্যিক যাত্রা এক বিপ্লবের গল্প। যেখানে সুর, কথা আর বিদ্রোহের স্পন্দনে প্রতিটি শব্দ নিজেকে পুনর্নির্মাণ করতে থাকে। তাঁর লেখায় গড়ে উঠেছে এক নতুন ধারার সাহিত্য। সুস্পষ্টভাবে প্রথাগত কাঠামোর বিরুদ্ধে উত্থান । পরিবর্তনের আহ্বান । তাঁর সৃষ্টি শুধু একেকটি গল্পই নয়, বরং তা সমাজের প্রতি এক গভীর সমালোচনা। যেখানে মানবিক দুর্বলতা, সংগ্রাম ও ভালোবাসার জটিলতা ফুটে ওঠে।
তাঁর লেখা প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতায় আমরা দেখতেই পাই, কিভাবে সাক্ষরিত ইতিহাস ও সামাজিক বাস্তবতা একে অপরের হাত ধরে থাকে। পুরনো কালের গল্পগুলোকে তিনি আজকের দিনের রূপরেখায় পরিণত করেন। যেখানে রোমাঞ্চ এবং ব্যথার মিলন ঘটে। পাঠককে এক নতুন জগতের সন্ধানে নিয়ে যায়।
সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক বুকারের সম্মাননা লাভের মাধ্যমে বানু মুশতাক বিশ্ব সাহিত্যে পরিচিতি অর্জন করেছেন ।এই পুরস্কার তাঁর সাহসী ও উদ্ভাবনী লেখনীকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। তাঁর কাজ আমাদের সামনে তুলে ধরে সমাজের অকপট সত্য ও অবহেলিত কাহিনীগুলোকে। যা কখনো কখনো প্রচলিত মূল্যবোধের বিরোধী বলে গণ্য হলেও তা বাস্তবতার এক অপরিহার্য প্রতিচ্ছবি। পুরস্কারের এই সাফল্য তাঁকে শুধু সম্মানিতই করেনি, বরং তাঁর মস্তিষ্কে জাগানো এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে।
বানু মুশতাকের কাজের মূল শক্তি হচ্ছে, তিনি অবহেলিত ও গৎবাঁধা মানুষের কাহিনী চিত্রিত করতে পারেন। যাদের জীবন ছিল ধ্বংসাত্মক বেদনার এক অব্যক্ত গান। তাঁর সাহিত্যে দেখা যায়, কিভাবে মানব জীবন এক সাহসী প্রতিরোধে রূপান্তরিত হতে পারে। কিভাবে প্রত্যাশার অতল গভীরে লুকিয়ে থাকে বিদ্রোহের অমর সুর। যা মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশাকে জাগিয়ে তোলে।
তাঁর কবিতা ও গদ্যে রূপান্তরিত অনুভূতি কখনো সরল, কখনো গভীর রহস্যময়। এইভাবে তিনি সামাজিক ও মানবিক দ্বন্দ্বকে এমন এক ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেন, যা পাঠকের প্রাণের কথা বলে।
অবশ্যই, বানু মুশতাকের সাহিত্যের জগতে আগমন কেবল প্রশংসা নয়—সামাজিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠিত আদর্শের বিরোধিতা তাকে কখনো বয়কটের শিকারও করেছে। কিছু ষড়যন্ত্রমূলক আন্দোলন ও সংখ্যালঘু দলের অসন্তুষ্টি তাঁর বিদ্রোহী ভাবধারার বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে জোরালো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে এই প্রতিক্রিয়াই তাঁর লেখাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। কারণ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সমাজের অপ্রকাশিত সত্যকে প্রকাশ করা। অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সেই নির্দোষ কষ্টকে শব্দে রূপদান করা।
বানু মুশতাকের রচনার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, সমাজের অশান্ত রাগ, অভাব ও অকপট ভালোবাসা। তিনি কেবল অতীতকে স্মরণ করান না, বরং বর্তমানে বিদ্যমান দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য ও অসমতার সামনে দাঁড়িয়ে জাগিয়ে তোলেন মানুষের ন্যায়বিচার ও স্বাধীনচেতনা। তাঁর সাহিত্যে চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে এক নতুন সমাজ ও মানবতার প্রতিচ্ছবি। যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সত্য, সাহস এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম কখনো থামে না।
বানু মুশতাকের শব্দ কেবল বিনোদনের একটি উপায় নয়; তা এক সামাজিক আন্দোলনের, এক সাংস্কৃতিক রূপান্তরের স্বরূপ। তাঁর বইগুলোতে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে লেখক তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও কল্পনার মিশেলে তৈরি করেছেন এক অনন্য কাব্যরূপ, যা পাঠককে চিন্তার গভীরে ডুবাতে বাধ্য করে। তাঁর প্রতিটি কাজ যেন এক মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা। মানবতার সংগ্রামের এক অবিচ্ছিন্ন চক্র। যা যুগে যুগে আমাদেরকে পরিবর্তনের প্রেরণা জোগায়। আমাদেরকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে—বাঁচতে হলে কীভাবে বিদ্রোহ করতে হয়? তাঁর সাহিত্য অন্ধকার ও আলো, কষ্ট ও প্রেম, অপরাধ ও মুক্তির এমন এক নাটকীয় সমাহার।
সাহিত্যের জগতে বানু মুশতাক শুধু একজন লেখক হিসেবেই নয় একজন সমাজচিন্তাবিদ, একজন অনুসন্ধানী হিসেবে বিরাট প্রেরণার উৎস।
নিচে The Week পত্রিকায় ১৮ মে ২০২৫ সালে প্রকাশিত আর এস সন্তোষ কুমার-এর নেয়া বানু মুশতাক-এর সাক্ষাৎকারটির বাংলা তর্জমা প্রকাশিত হলো।
বানু মুশতাক ধারাবাহিকভাবে পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
“আমার রক্ত-রঙীন কালি ভরা হৃদয়ের কলম আজ ভেঙে পড়েছে। আমার মুখ আর কথা বলতে পারছে না। চিঠি লেখার বাকি নেই আর। আমি ধৈর্যের মানে জানি না। যদি তুমি এই বিশ্বকে আবার সৃষ্টি করো, পুরুষ এবং নারীকে পুনরায় গড়ে তোলো, তবে অনভিজ্ঞ কুমোরের মত আচরণ করো না। পৃথিবীতে নারী রূপে অবতীর্ণ হও, প্রভু!
একবার নারী হও, হে প্রভু!”
উপরের আবেদনটুকু বানু মুশতাকের বারোটি গল্পের সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’-এর একদম শেষ গল্পটি থেকে নেয়া। এই সংকলটি ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বুকার পুরষ্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত। এই বাক্যগুলি কেবল একটি আবেদন নয়। বরং নারীর অস্তিত্বের প্রতি সহানুভূতিহীন এক বিশ্বব্যবস্থার প্রতি কঠোর নিন্দা।
মুশতাকের কণ্ঠস্বরে বিদ্রোহের স্পন্দন ও প্রচণ্ড সততার ঝিলিক ফুটে ওঠে। তাঁর গল্পগুলি সরল বর্ণনার মাঝে এক জটিল পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি। যেখানে সমাজের প্রান্তিক নারীরা নিজেদের খুঁজে পান। এদের গীতিময় আবেদন সত্ত্বেও, স্বাধীনতা, পছন্দ ও সুখের প্রশ্নে মানব জীবনের সেই কঠিন প্রশ্নগুলিকে উত্থাপন করে। যা আমাদের ভাবনাকে গভীরে ডুবে যেতে বাধ্য করে।
একজন কর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিক ও লেখক হিসেবে, তাঁর রচনায় রয়েছে অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি এক অবিচল প্রতিশ্রুতি। তিনি সেই সেই কাঠামোর মুখোমুখি হন, যা নারীদের—বিশেষ করে মুসলিম ও দলিত নারীদের—প্রান্তিক জীবনে আবদ্ধ করে রাখে। একই সাথে তাদের স্বাভাবিক প্রাণোচ্ছল্লতাকে করুণা এবং স্পষ্টতার সাথে আলোকিত করে।
বর্তমানে ৭৭ বছর বয়সী বানু মুশতাক ছাত্রাবস্থার দিন থেকেই লেখার তাগিদ অনুভব করতেন। তবে কীভাবে শুরু করবেন তা জানতেন না। অবশেষে, ১৯৭৩ সালে কলেজের সিনিয়র ও দূর সম্পর্কের আত্মীয় মুশতাক মহিউদ্দিনের সাথে বিবাহের এক বছর পূর্বে তিনি তাঁর প্রথম গল্প ‘নানু অপরাধিয়ে’ (আমি কি অপরাধী?) রচনা করেন। তবে, বিবাহের পরবর্তী জীবনে হতাশা ও হিস্টেরিয়ার ছায়া গ্রাস করে। তাঁর লেখালেখির মাঝে দীর্ঘ বিরতি ফিরে আসে।
আশির দশকে, তৃতীয় কন্যা আয়েশার জন্মের পর তিনি আবার লেখা শুরু করেন। সেসময় তিনি কন্নড় ম্যাগাজিন ‘লঙ্কেশ পাত্রিক’ এ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি একজন মুসলিম মহিলাকে সিনেমা দেখতে যেতে নিষেধ করার বিরোধিতা জানান। তারপর থেকে, এখন অবধি তিনি ছয়টি ছোটগল্পের সংকলন, একটি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধ এবং একটি কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছেন।
হার্ট ল্যাম্প-এর গল্পগুলি মূলত ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কন্নড় ভাষায় লেখা হয়েছিল । পরে দীপা ভাস্তি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তাঁর কাজকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন যেন আমাদের সকলকে একটি কথা মনে করিয়ে দেয়- যে সাহিত্যের প্রকৃত শক্তি কেবল বর্তমান জগৎকে প্রদর্শন করে না, বরং এই জগতকে যেমন হওয়া উচিৎ তেমনভাবে কল্পনা করার সাহস করে।
বানু মুশতাকের দেয়া একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ
আপনার প্রথম গল্পটি কখন প্রকাশ করেছিলেন ?
বানু: আমার প্রথম গল্পটি বিয়ের পরেই প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিন আমি আমার অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র স্বাস্থ্য নিরীক্ষক পিতা এস.এ. রহমানের সঙ্গে ব্যাঙ্গালোরের জায়ানগরে গিয়েছিলাম। বাবার এক পুরোনো বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে। সবার সাথে গল্প করার মাঝে হঠাৎ আমার মনে হলো —এলাকাটা ঘুরে দেখবো। বাইরে ঘুরতে গিয়ে আমার দৃষ্টি একটি নাম ফলকে আটকে গেল। ওটা ছিল ‘প্রজামাতা’ সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক এম এ. এন এ. মুর্থির। পত্রিকাটি আমি তখন নিয়মিত পড়তাম।
আমি দরজায় কড়া নাড়লাম। নিজেকে পরিচয় দিলাম যে আমি একজন গল্প লেখক। প্রজামাতায় একটি গল্প প্রকাশের ইচ্ছের কথা জানালাম। তিনি সরলভাবেই বললেন “ঠিক আছে, পাঠিয়ে দাও”। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে আমি ঠিকানা জানতে চাইলাম। তিনি জানালেন যে ঠিকানাটি ম্যাগাজিনের পাতায় পাওয়া যাবে। তবুও আমি জোর করেই সরাসরি ঠিকানাটি চাইলাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য। তিনি সাথে সাথেই দিলেন। সেই মুহূর্তটি আমার জীবনে চিরদিন মনে গেঁথে থাকার মতো হয়ে রইলো। ঘরে ফেরার পর আমি খুব সাবধানে ‘নানু অপারাধিয়ে’ শিরোনামে গল্পটির একটি পরিপাটি কপি প্রস্তুত করে ডাকের মাধ্যমে পাঠালাম। ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। প্রায় একবছর পেরিয়ে গেলেও গল্পটি প্রকাশিত হয়নি। লেখার জন্য আর কোনও গল্প ছিল না। ততদিনে আমার বিয়ে হয়ে গেল মুশতাকের সাথে। আমাদের বিয়ের এক মাস পর, আমরা বেলুড়ে আমার মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম। উনি বাইরে পত্রিকা কিনতে গিয়েছিলেন। প্রজামাতা পত্রিকায় আমার গল্পটি ছাপা হয়েছে দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে আমার কাছে ছুটে এলেন।
ওই গল্পটির প্রকাশ কি আপনাকে আরও গুরুত্ব সহকারে লেখালেখি করতে উৎসাহিত করেছিল?
বানু: না, আমি বিবাহিত ছিলাম বলে আমি কিছুই লিখতে পারিনি। আমাকে আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হয়েছিল। আর তারা আমার লেখালেখি নিয়ে কখনোই খুশি ছিল না। আসলে, আমাদের বিয়ে সাত বছর পিছিয়ে যায় কারণ আমি একজন শিক্ষিত এবং কর্মজীবী নারী। ১৯৭০ সালে স্নাতক শেষ করার পরপরই, আমি অল ইন্ডিয়া রেডিওর বেঙ্গালুরু স্টেশনে ঘোষক হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম। আমার বিয়ের পরের দিনগুলো ছিল হতাশা আর ঝগড়াঝাঁটির ।
আপনার স্বামী কি আপনার গল্পের মতোই স্বল্পভাষী ও বিচক্ষণ?
বানু: আমি খুবই আবেগপ্রবণ। আর তিনি শান্ত। কোনো ঘটনা বা কথোপকথনে কিছু ঘটে গেলে, আমি সহজেই ভুলতে পারি না। আমার মনে বারবার ফিরে আসে। কিন্তু তিনি সবসময় বলতেন, “কেন মনের মধ্যে এভাবে ধরে রাখছো? ওটা আমাদের বিষয় নয়, ভুলে যাও।” তিনি সহজে সব ভুলে এগিয়ে চলে যান, আমি পারি না। এ কারণেই আমি এই গল্পগুলো লিখতে থাকি—এটা ছিল আমার স্মৃতি ও অনুভূতির বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক উপায়।
বিয়ের মাত্র আঠারো দিনের মধ্যে তিনি আমাকে হাই স্কুলের শিক্ষকতা থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রভাবিত করেছিলেন। আমার আত্মীয়রা আমাকে পদত্যাগ না করার পরামর্শ দিয়েছিল। চাকরি ছাড়ার পর, আমি এতটাই কষ্ট অনুভব করলাম যে রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলাম। ঘরে ফিরে আমি তাকে দায়ী করতে লাগলাম। বেশ কিছু খারাপ কথা বলে ফেললাম। তিনি ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। পরের দুই বছর আমি অনুশোচনায় ডুবে ছিলাম।
হার্ট ল্যাম্প-এর কেরোসিনের ঘটনায় ব্যক্তিগত কিছু আছে কি?
বানু: হ্যাঁ। আমাদের একটা বড় যৌথ পরিবার ছিল। চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকাটা আমাকে পাগল করে তুলছিলো। আমি আমার স্বামীকে বলতাম, "তুমি আমার জীবন নষ্ট করেছ।" আমি সত্যিই বিরক্ত ছিলাম। সে কিন্তু শান্ত থাকতো। এবং আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতো। একবার, হতাশার মধ্যে আমি নিজের উপর সাদা পেট্রোল ঢেলে নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে, সে সময়মতো তা বুঝতে পেরে আমাকে জড়িয়ে ধরে ম্যাচের বাক্সটি কেড়ে নেয়। সে আমার কাছে অনুনয় বিনয় করে। আমাদের বাচ্চাটিকে আমার পায়ের কাছে রেখে বলেছিল, "আমাদের ছেড়ে যেও না।" আমি তখন বুঝতে পারলাম, কী ভয়াবহ কাজ করতে যাচ্ছিলাম। পিছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, এটি প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা হতে পারে। কিন্তু এই অনুভূতিটা আরও গভীর ও ভারী হয়ে উঠেছিল । যেন আমার ভিতরের কিছু ভেঙে যাচ্ছে। আমার গল্পের সবকিছুই কিছুটা আত্মজীবনীমূলক। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে আরও সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল।
আপনার সক্রিয়তা(Activism)এবং লেখালেখির রূপান্তর বা পরিবর্তন সম্পর্কে বলুন।
বানু: আশির দশকে কর্ণাটকে অনেক সামাজিক আন্দোলন সক্রিয় ছিল। এই সমস্ত আন্দোলনের সুস্থ দাবিও ছিল। তারা জাতি এবং শ্রেণীগত শ্রেণীবিন্যাস বিলোপ করতে চেয়েছিল। আমি এতে জড়িত হয়ে পড়েছিলাম। বিশেষ করে হাসান-এ, যেখানে আন্দোলনের অনেক নেতা সক্রিয় ছিলেন। আমি সামাজিক কাঠামো, সাংবিধানিক নিশ্চয়তা এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের দুর্দশা সম্পর্কে জানতে শুরু করি। ১৯৮১ সালে আমার তৃতীয় কন্যা আয়েশার জন্মের পর, আমার আবার হিস্টিরিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। যা আমার স্বামী দ্রুত বুঝতে পারেন। একদিন, তিনি বিভিন্ন ওষুধপত্রের সাথে লঙ্কেশ পত্রিকার একটি কপিও আমাকে এনে দিয়েছিলেন। ঐ পত্রিকাটি পড়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। সেই সময়ে, বিজাপুরের নাজমা ভাঙ্গি নামে একজন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাকে নিয়ে একটি সমস্যা দেখা দেয়। একটি মুসলিম যুব কমিটি নির্দেশ দেয় যে মহিলাদের সিনেমা দেখতে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু ঐ নারী সিনেমা দেখতে গেলে, সেই কমিটির লোকজন তাকে হয়রানি শুরু করে। আমি ক্ষুব্ধ হয়ে আমার প্রতিবাদ লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিই। আমার বাচ্চাকে কোলে শুইয়ে রেখে আমি একটি প্রবন্ধ লিখলাম। যেখানে প্রশ্ন করেছিলাম, যে শুধুমাত্র কি একজন মুসলিম পুরুষেরই বিনোদনের অধিকার আছে? আমি এটি ‘লঙ্কেশ পাত্রিক’-এ পাঠালাম। দুই-তিন দিনের মধ্যেই এটি ছাপা হয়ে গেল। ব্যাপারটা বেশ শিহরিত করেছিলো আমাকে।
আপনার বেশিরভাগ চরিত্র এবং গল্পের কাহিনী ‘হাসান পেনশন মহল্লা’ নামের আপনার পাড়া-প্রতিবেশি এসেছে।
বানু: আমরা বান্দায়া সাহিত্য আন্দোলনের (কন্নড় ভাষায় একটি প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলন) খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সাথে অনেক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছি। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমার কী লেখা উচিত। তারা আমাকে বলেছিল, "নিজের সম্পর্কে, তোমার পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে, তোমার মা, তোমার নারীসমাজ সম্পর্কে, তোমার যৌবন সম্পর্কে, তোমার মহল্লা সম্পর্কে লিখো।" তখনই আমি বুঝতে শুরু করি যে আমি আমার নিজের জগৎ সম্পর্কে লিখতে পারি। আরেকটি প্রশ্ন ছিল, আমার কোন নাম ব্যবহার করা উচিত? সেই সময়ে, কন্নড় সাহিত্যে হিন্দু পুরুষ লেখকদের প্রাধান্য ছিল। এমনকি কয়েকজন মুসলিম পুরুষ লেখকও [তাদের লেখায়] তাদের নিজস্ব শিকড় বা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসতে পারতেন না। আমি আমাদের মহল্লা এবং আমাদের বাস্তবতা সম্পর্কে লিখতে শুরু করি। আমার পূর্বপুরুষরা এই এলাকায় থাকতেন। আমাদের চারপাশের বেশিরভাগ মানুষ বন্ধু বা আত্মীয় স্বজন ছিলেন। আমার লেখার প্রধান চরিত্র ছিলেন মুসলিম নারীরা।এবং আমি মুসলিম নাম ব্যবহার শুরু করি। সর্বদা প্রচলিত সামাজিক অবস্থার প্রতিক্রিয়ায় আমি কিন্তু সৃজনশীলভাবেই লিখতাম। সব জায়গায়ই সমস্যা একই ছিল। নারীদের হয়রানি, নির্যাতন, বিধিনিষেধ, পুরুষের দাস বানানো।
আপনি কি সেই সময় লঙ্কেশ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে যাচ্ছিলেন?
বানু: আমি কেবল একজন লেখকই ছিলাম না। আমি ১০ বছর ধরে একজন প্রতিবেদক ছিলাম। কিন্তু লঙ্কেশ পত্রিকায় রিপোর্ট করার সময়ও আমি গল্প লিখছিলাম। এগুলো প্রজাবানি, কর্মবীর এবং অন্যান্য প্রধান কন্নড় প্রকাশনায় প্রকাশিত হত। ১৯৮১ সাল থেকে আমার গল্পগুলি নিয়মিত দীপাবলি এবং উগাদির বিশেষ সংস্করণ এবং রবিবারের সাময়িকীতে প্রকাশিত হতো। কিন্তু কোনও প্রকাশক আমার রচনাগুলিকে বই হিসেবে প্রকাশ করতে এগিয়ে আসেননি। ১৯৯০ সালে, নাগভূষণ নামে একজন আমার প্রথম গল্প সংকলন প্রকাশ করেন। আমার দ্বিতীয় সংকলন ‘বেঙ্কি মালে’ কর্ণাটক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার জিতে নেয়। বেঙ্কি মালে-র গল্প 'ব্ল্যাক কোবরা' থেকে ২০০৪ সালে গিরিশ কাসারভাল্লির 'হাসিনা' সিনেমাটি নির্মিত হয়েছিল। এটি তিনটি জাতীয় পুরস্কার জিতেছে।
আপনার বেশিরভাগ গল্পই মুসলিম সম্প্রদায়ের পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে।
বানু: হ্যাঁ, আমি ধারাবাহিকভাবে উগ্র ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করে আসছি। এই বিষয়গুলি এখনও আমার লেখার কেন্দ্রবিন্দু। সমাজ অনেক পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু মূল বিষয়গুলি একই রয়ে গেছে। যদিও প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়, নারী এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মৌলিক সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। আমি এও লিখছি যে মিডিয়া প্রায়শই মুসলমানদের ভুলভাবে উপস্থাপন করে। আমি একবার একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির একটি বিভ্রান্তিকর ছবি দেখেছিলাম। যাকে একটি অল্পবয়সী মেয়ে মালা পরিয়ে দিচ্ছিল। যা বাল্যবিবাহের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু বাস্তবে, এটি ছিল একজন কুরআন শিক্ষক এবং তার ছাত্রীর কুরআন অধ্যয়ন শেষ করার পরের ছবি। একটি ঐতিহ্য যেখানে শিক্ষককে মালা এবং উপহার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এই ধরনের ভুল উপস্থাপনা আমাদের ধারণাকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আপনার লেখার কারণে কি কখনও কেউ আপনাকে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা করেছে?
বানু: হ্যাঁ, ২০০০ সালে। বেঙ্কি মালে পুরস্কার জেতার পর। আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা হয়েছিল কারণ আমি মুসলিম মহিলাদের মসজিদে নামাজ পড়ার অধিকার সমর্থন করেছিলাম। এক ব্যক্তি যিনি আগে থেকেই উস্কানিদাতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কুখ্যাতি অর্জনের জন্য আমাকে ছুরিকাঘাত করার চেষ্টা করেন। আমি তাকে শাস্তি দিতে পারতাম। তার বিরুদ্ধে ৩০৭ ধারা (হত্যার চেষ্টা)-এর অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু আইনগত শাস্তি তাকে দিইনি। কারণটি হলো আমার মেয়ে লুবনা। আমি আর লুবনা আমরা একসাথে আইনশাস্ত্র অনুশীলন করছিলাম। লুবনা আমাকে লোকটিকে ক্ষমা করতে বলে। কারণ সে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করে যাচ্ছিল। বলছিল যে তার একটি ছোট বাচ্চা আছে। আমি তার দুর্দশা দেখেছি এবং তাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। একবার, সে আমার অফিসের বাইরে অপেক্ষা করছিল এবং তার সন্তানদের জন্য মিষ্টি কিনতে টাকা চাচ্ছিলো। তা দেখে আমার স্বামী হাসতে থাকে। আমি তাকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে বললাম যেন আর কখনোই আমার সামনে না আসে।