Published : 28 Sep 2024, 03:55 PM
বিনয় মজুমদারকে মনে করা হয় জীবনানন্দ-উত্তর বাংলা কবিতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি। আবার অনেকের মতে, জীবনানন্দের পর তিনিই বাংলা ভাষার প্রকৃত খাঁটি কবি। জীবনানন্দ দাশের কাব্যভাষার নতুন রূপকার। জীবনানন্দের কাব্যচেতনার ভেতরে থেকেই তিনি এর নতুন সমীকরণ করেন। তবে আধুনিক বাংলা কবিতায় যে একজন শক্তিমান কবির আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নক্ষত্রের আলোয়’ (১৯৫৬) দিয়েই জানান দেন বিনয়। তাঁর এ গ্রন্থভুক্ত মাত্রাবৃত্তে লেখা ‘উম্মোচনের গান’ কবিতাটি থেকেই আমরা টের পাই তাঁর কবিত্বশক্তির আগাম সংকেত।
তুমি তো কথা বলো, জীবন প্রত্যহ
সকাল বিকেলের যে চেনা গদ্যে
লিখিত একরূপে, তুমি তো অহরহ হাঁটছো রূঢ় সেই ভিড়ের মধ্যে
আমি তো চাঁদ নই, পারি না আলো দিতে
পারি না জলধিকে আকাশে তুলতে
পাখির কাকলির আকুল আকুতিতে
পারবো কি তোমার পাপড়ি খুলতে?
কবিতাটি নিঃসন্দেহে প্রেমের আর এ প্রেমের আকুতিই জুড়ে আছে তাঁর কবিতার চেতনালোকে। কবি ও কবিতাপ্রেমী মাত্র তাই জানেন বিনয় তাঁর দুরন্ত প্রেমের মানবী গায়ত্রীকে নিয়েই নির্মাণ করেন তাঁর কবিতার পৃথিবী। কলেজ জীবনের এই সুন্দরী ও মেধাবী সহপাঠিনীকে ঘিরেই মূলত আবর্তিত তাঁর স্বপ্ন কল্পনা জীবন ও জিজ্ঞাসা। একধরনের লঘু বিদ্রুপ ও পরিহাসে তিনি সেখানে উম্মোচন করেন মানুষের স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় জীবনের জটিল এক সত্য, এক অনাত্মীয় নির্মম ও প্রেমহীন বাস্তব রূপসত্তা যে সত্তার প্রতীক তাঁর কবিতার মানসী তার কাছে এক অধরা। তিনি তাই অনায়াসে বলে উঠতে পারেন:
তবুও কেন যে আজো হায় হাসি, হায় দেবদারু
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়
এই প্রকৃত সারসই তাঁর জীবন ও কবিতার নায়িকা। তাকে নানারূপে নানা অবয়বে আকার ও দেখার প্রয়াসে তিনি একই কাব্যগ্রন্থের তিনটি নামে প্রকাশ করেন- ‘গায়ত্রীকে’, 'ফিরে এসো চাকা' এবং ‘আমার ঈশ্বরী’। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে: ‘ঈশ্বরীর কবিতাগুলি’, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মীকির কবিতা’, ‘কাব্য সমগ্র’ ও ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’। ‘কাব্য সমগ্র’ প্রথম খন্ডের জন্য তিনি ‘কৃত্তিবাস পুরস্কার’ ও ২০০৫ সালে ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ লাভ করেন এবং একই বছরে 'হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ' কাব্যগ্রন্থের জন্য পান ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’। প্রেম ও প্রকৃতি বিনয়ের কবিতার প্রধান উপজীব্য। তবে সে প্রকৃতি জীবনানন্দ থেকে আলাদা নয় বরং তার নবরূপায়ণ।
অনেকে ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল আকাশের হৃদয়ের।
কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা
ফড়িং তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়
উড়ে যায়, শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালার আকাশের লাল ঝরে
বাতাসের আশ্রয়ে-আশ্রয়ে।
আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছো ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা, রথ হয়ে জয়
হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন সুর হয়ে লিপ্ত হবো
পৃথিবীর সকল আকাশে।
[ফিরে এসো চাকা]
সময়ের সঙ্গে এক বাজি ধরে পরাস্ত হয়েছি।
ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষায়, স্বপ্নে বৃষ্টি হয়ে মাটিতে যেখানে
একদিন জল জমে আকাশ বিম্বিত হয়ে আসে
সেখানে সত্বর দেখি, মশা জন্মে, অমল প্রত্যুষে
ঘুম ভেঙে দেখা যায়; আমাদের মুখের ভিতরে স্বাদ ছিল, তৃপ্তি ছিল যেসব
আহার্য পচে
ইতিহাস সৃষ্টি করে। মুখ ক্রমে ব্যথা হয়ে ওঠে।
অঙ্গুরীয়লগ্ন নীল পাথরের বিচ্ছুরিত আলো
অনুষ্ণ ও অনির্বাণ জ্বলে যায় পিপাসার বেগে
ভয় হয়, একদিন পালকের মতো ঝরে যাবে।
[ফিরে এসো চাকা]
সত্যি সত্যি পালকের মতোই ঝরে গেলেন তিনি চিরাচরিত নিয়মে। প্রকৃত সারসের মতোই উড়ে গেলো তাঁর আত্মার পাখি হিংসার এ পৃথিবী ছেড়ে। ২০০৬ সালের ১১ ডিসেম্বর, সোমবার পৈতৃক ভিটে চব্বিশ পরগনার ঠাকুর নগরের বিনোদিনী কুঠিতে সকাল আটটা ত্রিশ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ সাধু কবি। একজন যন্ত্রপ্রকৌশলী ও একজন গণিতবিদ হয়েও শুধুমাত্র কবিতার জন্য পুরো জীবন উৎসর্গ করলেন তিনি। ফলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অথবা জ্যোতির্ময় দত্ত বলতেই পারেন তিনি ‘কবিতার শহীদ’। সিজোফ্রেনিক ছিলেন। আর তার জন্য অনেকটাই নাকি দায়ী গায়ত্রীর প্রতি উপেক্ষিত একতরফা প্রেম। নব্বই দশকের পর থেকে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই অসুস্থতা মৃত্যু পর্যন্ত ছিল। তবে শোনা যায়, বিনয় যতটুকু না মানসিক রোগী ছিলেন তার প্রকাশক ও প্রিন্টমিডিয়া তাকে ততটাই বানিয়েছিল, আর তা তাদের হীনস্বার্থে।
সৃজনশীল প্রতিভাবানেরা মনোরোগের শিকার হতেই পারে। শুধু কি বিনয় মনোরোগী ছিলেন ছিলেন? ঋত্বিক ঘটক ও কবি-সঞ্জয় ভট্টাচার্যও। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে কাকতালীয় মিলটা খুঁজে পাওয়া যায় শুধু উনিশ শতকের বিখ্যাত জার্মান কবি ফ্রেডেরিক হোল্ডার্লিনের সঙ্গে। দু’জনের সমান চৌত্রিশটি বছর কেটেছে মানসিক ভারসাম্যহীন। দু’জনই ছিলেন অবিবাহিত। জীবনের শেষ দিনগুলো ফ্রেডেরিককে দেখাশোনা করেন একটা মুচি পরিবার, আর বিনয়কে দরিদ্র ফুলবিক্রেতা পরিবার। অথচ বিনয়ের জীবন ছিল বৈচিত্র ও রূপকথার মতো। জন্ম তাঁর ১৯৩৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাবার কর্মস্থল মিয়ানমারে (বার্মা)। শৈশবেই চলে আসেন আজকের ফরিদপুর জেলার বৌলতলী গ্রামে। অনুন্নত পশ্চাৎপদ এ গ্রামটির চিত্রকল্প বিনয়ের মনোজগতে গভীর রেখাপাত করে, যেমন বরিশালের হাওড়-বিলের স্মৃতি মগজে গেঁথেছিল জীবনানন্দের। ১২ বছর পর্যন্ত ছিলেন বৌলতলী গ্রামে। তারপর বাবার সঙ্গে চলে আসেন চব্বিশ পরগনার শিমুলপুরে। কলকাতার নগরজীবনে বিষিয়ে উঠলে স্থায় হন এখানেই, হয়ে ওঠেন ঠাকুর নগরের মানুষগুলোর হৃদয়ঠাকুর। সাধুর মতোই ছিল সাত্মিক তার জীবন। অথচ এই মানুষটাই যৌবনে ছিলেন দুরন্ত ও সৃষ্টি-অন্বেষী এক মানুষ। বাংলাভাষীর কোনো সীমানা মানতে চাননি তিনি। তাই সীমান্ত দিয়ে বিনা পাসপোর্টে ঢুকে পড়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে আজকের বাংলাদেশে। ঐ জন্য তাকে ছ'মাস জেল খাটতে হয় বলে জেনেছি। দেখেছেন বাবা-মা'র সমস্যা সঙ্কুল জীবন। সেই চিত্র ধরে রেখেছেন 'এলা শহরে' কবিতায় 'বর্মার কথা মনে এলেই আমার মনে আসে এলা শহরের কথা। এলা উত্তর বার্মার একটি ছোট শহর। বাংলাভাষায় পড়াশোনার স্কুল এলাতে ছিল না। সুতরাং আমার লেখাপড়া চলত বাড়িতে। আমার মা-বাবা আমাকে লেখাপড়া শেখাত। অ-য় অজগর আসছে তেড়ে/আমটি আমি খাব পেড়ে। ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে/ঈগল পাখি পাছে ধরে। বাবা- মা'র জীবন ছিল সমস্যা-সঙ্কুল। যেমন একটি সমস্যা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো। 'বউদো বাদ্য' মানে বৌদ্ধ ধর্ম বর্মার ভাষায়। বাবা কঠোর পরিশ্রম করেছে সারাজীবন। বাবা পাঁচটি ভাষা জানত। কিন্তু বর্মা ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় তো কোনো বই অনুবাদ করে গেলো না।' অন্যভাষা শিখলে অন্য দেশকে জানার সুযোগ থাকে। বাবা সেই সুযোগ না নিলেও বিনয় ঠিকই নেন। মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে রুশ ভাষা শিখে ছয়টি রুশগ্রন্থ অনুবাদ করেন।
এক সময় এ যন্ত্রপ্রকৌশলীর কবিতাই হয়ে ওঠে তাঁর জীবন ও জীবিকা। তাঁর কবিতাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে গায়ত্রীর উপেক্ষিত প্রেম, আর সেই প্রেম থেকেই জীবনের মধ্য গগনে এসে বিচ্যুতি ঘটে তার মনের। তার জন্য আটবার নাকি যেতে হয় তাকে মানসিক হাসপাতালে। কিন্তু এ পাগলাগারদ নিয়ে যিনি কৌতুক করতে পারেন তিনি কতখানি পাগল ছিলেন! হয়তো গায়ত্রীকে ভালোলাগাটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় পাগলামি। তাইতো তিনি বলতে পারেন:
আমি তৈরি হয়ে আছি
ফের যদি বলে চল পাগলা গারদে
তবে আমি বলব আমার আবিষ্কৃত জ্যামিতির
উপপাদ্য আরও আছে। সেগুলি লিখে
দেখাচ্ছি।
আমি আবিষ্কার করে গোপন রেখেছি।
তাছাড়া
আমার বয়সও হয়েছে ৭১ বছর।
জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসেও গায়ত্রীর প্রতি বিনয়ের সমান প্রেমানুভূতি ছিল। গায়ত্রীর সংসার ভরে গেছে সন্তান ও নাতিতে। কিন্তু বিনয়ের মতে তারা কেউ হারেননি বরং জিতে গেছেন দু’জনেই। তাদের ঠিকানা একই জায়গায়। তারা কেউ নেই একসাথে তবু আছেন একসাথে, বইয়ের পাতায়।
'আমরা দু’জনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো।
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খ্রিস্টান হয়েছো
তুমি আর আমি কিন্তু দু’জনেই বুড়ো হয়ে গেছি।
আমার মাথার চুল যেরকম ছোট করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোট করে ছাঁটা
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই। যখন দু’জনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখবো না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।
[আমরা দু’জনে মিলে : হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ]
তাঁর কথা দিয়েই শেষ করছি তাঁকে নিয়ে এ লেখা:
‘নিশ্চিত মরেছি আমি, মর্তের জীবন শেষ হল।
মর্তের শরীর ছেড়ে সরাসরি স্বর্গলোকে আমি।’
হ্যাঁ, সত্যিই তিনি আজ স্বর্গলোকে। কিন্তু তাঁর কবিতার নিঃশ্বাসগুচ্ছ আজও ছড়িয়ে আছে কবিতাপ্রেমীর প্রাণে, প্রেম ও বিরহের যৌথ উদযাপনে।