Published : 16 Sep 2011, 01:01 PM
[নমস্য হে অকল্পনীয় পাত্রপাত্রী! তোমাদিগের উপস্থিতি সত্ত্বেও এই বন্তুপিণ্ডটিকে ফিকশন না বলে সোশ্যাল হিস্টরি বলে চালিয়ে দেয়া যাচ্ছে না]
ফোন বাজল ঠিক ৪টা ১৯ মিনিটে। ফোন না, সেল ফোন। আর বাজল বললাম বটে, কিন্তু বাজার কোনো সুযোগ সেটি পায় না। কণ্ঠরোধ করে রাখি আমি। ফলে পকেটের মধ্যে, কণ্ঠরোধহেতু, ভোঁৎ ভোঁৎ করে আওয়াজ করল। আমি ত্যারছা চোখে আমার সঙ্গিনীর দিকে তাকাই। এই ভোঁতভোঁতানি তাকে কিছুমাত্র আন্দোলিত করেছে বলে আমার মনে হলো না। ফলে আমি ভরসা বোধ করলাম। আবার এ কথাও মনে হলো যে সেল ফোনটা আমার শরীরে, মানে পোশাকে, সেঁটে আছে বলেই আমার কাছে এর ভোঁৎ ভোঁৎ বা ঘোঁৎ ঘোঁৎ যে তাৎপর্য বহন করে সেটা কিছুতেই তার কাছে বহনযোগ্য নয়। এসব ভাবতে ভাবতেই আমি পকেটে রাখা সেল ফোনটা বের করে সোফায় আমার পাশে রাখতে শুরু করলাম। কোনো এক কারণে এই সাধারণ স্থানান্তরের কাজটাও আমি ওভাবে ত্যারছা চোখে তাকিয়েই করতে থাকলাম। কেন যে এই ত্যারছামি আমার ভিতরে তখন জন্ম নিয়েছে তা আমি কিছুতেই এখন মনে করতে পারি না। এমনকি তখনও তা মনে পড়ছিল বলে আমার মনে হচ্ছে না। কিন্তু আমার এই ত্যারছামি সঙ্গিনী লক্ষ করলেন বলে মনে হলো। মানে তখন মনে হলো। এবং ভোঁৎ-ভোঁৎজনিত বিচলন বা বিরক্তি না হলেও ত্যারছামিতে তিনি হলেন। মানে তিনি বিরক্ত হলেন বলে তখন মনে হলো; কিংবা হয়তো এখন মনে হলো।
সেল ফোনটা কিন্তু ওভাবে বেজেই চলেছে। বা হয়তো বলা উচিৎ না-বেজে চলেছে। কখনো আমি গুণেছিলাম যে ওটা একেকবার, যদি অবশ্যই ফোনকারী নিজে থেকে কেটে না দেন, ১৪ বার বা ১৫ বার বাজে। ১৪ বার নাকি ১৫ বার? সেটা আর এখন মনে পড়ছে না। এমনকি তখনও মনে পড়ছিল না। তাছাড়া তখন আমি শুরু থেকে ভোঁৎ ভোঁৎ এর সংখ্যা গুণতেও শুরু করিনি। মাঝখান থেকে গুণে আর কী লাভ! এদিকে সোফায় রাখতে না রাখতে সেলের এই আওয়াজ অদ্ভুত বিদ্ঘুটে একটা অবস্থায় দাঁড়াল। প্ল্যাস্টিকের সংস্পর্শেই হয়তো। প্ল্যাস্টিকের সংস্পর্শে নানান বস্তুর গুণগত বদল হয়। হয়তো এজন্যেই প্ল্যাস্টিকের অনেক বিরোধী এখন। কিন্তু ওটা তো থামে না। কী ভয়ানক কথা! আচ্ছা এমন কি সম্ভব যে ফোনকারী একবারে কোন বিরতি ছাড়াই দুইবার চেষ্টা করলেন! তাহলে তো একবারে ৩০ বার কিংবা ২৮ বার ধরে বাজবে। বা না-বাজবে। কিন্তু তা কি সম্ভব! না হলে এতক্ষণ ধরে কীভাবে! আমি অনেক চিন্তাভাবনা করা সত্ত্বেও আবিষ্কার করলাম আমার ত্যারছামি থামল না। বরং সেটা এখন উল্টোপথে সেলের দিকে চলে গিয়েছে। আমার সঙ্গিনী বড়জোর ত্যারছামিতে বিরক্ত, কিংবা বিচলিত, হয়েছিলেন। এখন ত্যারছামি পথবদল করাতে তিনি কী করছেন বোঝার চেষ্টা না করেই আমি সেলের দিকে ত্যারছাই। একটা সুফল পাওয়া গেল। স্ক্রিনে নাম উঠল ফোনকারীর।
ফোনকারীর নাম না-জানা পর্যন্ত বিষয়টা নেহায়েৎ ইনসিডেন্টাল ছিল। এখন আর সেটা কিছুতেই ইনসিডেন্টাল নেই; বরং তার নাম জানা অবস্থায় ফোনটা না-ধরা আমার পক্ষে ইনটেনশনাল হতে হচ্ছে। এই ফোনকারীকে কোনো মুহূর্তেই আমি না-ধরতে চাই না। তিনি আমার আকাঙ্ক্ষিত জনের একজন, এসেক্সুয়্যাল যদিও। সম্পাদক ফোন করেই চলেছেন। কোনো এক জাদুতে তিনি বিরতিহীনভাবে আমার ফোন বাজাতে পারছেন, মানে না-বাজাতে, ভোঁৎ-ভোঁতাতে। এবং আমার অবিচল ত্যারছামি, বিহ্বলভাবে, ফোনের দিকে সোফার রেক্সিনে সেঁটে, সঙ্গিনীর একদম উল্টোপথে চলমান। এরকম অবস্থায়, যদিও বেশি কাল নয়, আমার মনে হলো অনন্ত এক কাল। সেলও ঘোঁৎঘোঁতায়, আমিও রেক্সিনমাখা সোফায় সেঁটে; এবং কিছুতেই আর সঙ্গিনীর দিকে দৃকপাতের একটা সুযোগ আর করে উঠতে পারছি না। এই যে সেলফোন খানা, কোনো এক রহস্যে, একনাগাড় বেজে চলেছে সেটা যে ওর অপরাধ, এবং আমার কিছুতেই নয়, এই আপ্তজ্ঞানও তখন আমার লুপ্ত হবার পথে।
এই মহাকাল ভেদ করে, শেষমেশ, সঙ্গিনী নিজেই উত্থিত হন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনি আমার দিকে চাইলেন। তিনি চাইলেন, কিন্তু তিনি চান বা না চান, আমি প্রকৃত অপরাধীর মতো মুখ করে ফেললাম। সেটি আমার ইচ্ছাকৃত ছিল না। এমনকি আমার আকাঙ্ক্ষিতও ছিল না। অপরাধীর মুখওয়ালা আমাকে তিনি অপরাধী সাব্যস্ত করে শুধালেন,
প্রশ্নটা আমি একদম শুনতে পেলাম। আমার কানে বাজছে এখনো। তখনো সেটা তীক্ষ্ণভাবেই বেজেছিল। অথচ আমি ফোনটা যেন তার দিকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছি এই ভঙ্গিতে বাড়িয়ে ধরলাম।
আর বললাম, 'আমি কী করব?! সম্পাদকের ফোন।'
বলার ঠিক পূর্বমূহূর্তেই আমি টের পেলাম যে সমূহ ভুল একটা উত্তর আমি করতে যাচ্ছি। কিন্তু ততক্ষণে উত্তরটা আর আটকানোর মতো অবস্থা আমার নেই। সঙ্গিনী আমার দিকে আরও সজোরে জানালেন–
গত উত্তরের থেকে এটাকে একটুও আকর্ষণীয় মনে হলো না নিজের কাছে। সঙ্গিনী তীক্ষ্ণভাবেই সেটা স্মরণ করিয়ে দিলেন–
এই সংলাপ চলতে থাকলে আমার কোথাওই পৌঁছানো সম্ভব হতো না। আমার ভ্যাবদামির কারণেই। কিন্তু দয়ালু সঙ্গিনী তখন এক মায়াবী জালে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। না আসলে হয়তো একটা মায়াময়, কিংবা মায়াবতী স্তরে তিনি পৌঁছে গেলেন। এবং অসম্ভাব্য সেই সংলাপে আমার ভবিষ্যৎহীন দশা তিনি কোনোভাবে ঠাহর করে থাকতে পারলেন। এবং বললেন–
ফোন-ধরা বিষয়ক সঙ্গিনীর সবক পেয়ে ফোনটা নিয়ে হন্তদন্ত আমি কফি-পানশালার বাইরে আসি। দরজা ডিঙোনোর সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয় এই বাইরে-আসার কিছুমাত্র জরুরিত্ব ছিল না। এমনকি বাইরে-আসাতে বিশেষ কিছু অব্যাখ্যেয় ভেজাল তৈরি হতে পারে, অনাকাঙ্ক্ষিতও বটে। দৌড়ে একইভাবে পিছন ফেরার কথা মাথায় এসেছিল বটে, কিন্তু তখন পিছন ফিরলেও আর সেই দুর্ঘটের উপশম সম্ভব হয় না। একবার মনে হলো বটে যে পিছন ফিরে দেখি সঙ্গিনী ঠিক কীরকম মায়াবতী চোখে তখন তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কিন্তু কোনো এক কারণে ভারী একটা ভয়ার্ত মন তখন তৈরি হয়েছে। আমার আর পিছন ফেরার যথেষ্ট সাহস হলো না। অদ্ভুত এক তাড়াহুড়ার মধ্যে মন তখন নির্বিচার নিপতিত। এই তাড়াহুড়ার মধ্যেও আমার ক্ষণিক সময়ের জন্য মনে হলো যে কফি-পানশালাতে আমার তো একটু পরেও ঢুকতে হবে এবং সেটা কিছুতেই খুব আকাঙ্ক্ষিত হবে না। সেই ভাবনায় খানিকক্ষণ কাটিয়ে দিতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু সম্পাদকের তৃতীয় কিস্তির ফোনও তখন বাজতে শুরু করেছে। মানে কিস্তিপ্রতি ১৪ কিংবা ১৫ বারের হিসেব মতো। আমি তড়িঘড়ি ফোনটা রিসিভ করতে বোতাম চাপি। এবং চাপার ঠিক আগের মুহূর্তে আমি বুঝলেও কিছুতেই কল কেটে দেয়ার বোতামটা না টিপে থাকতে পারলাম না। ফলে অগত্যা আমার যা করণীয় থাকল তা হলো আবার ঠিক ফিরতি পথেই ফোনটাকে পাঠানো। এখন আমি, একটুও চাইনি যদিও, ফিরতি-কল করবার জন্য বোতাম টেপাটিপি করছি যখন, একটু ত্যারছা চোখে কাচের ওপারে সঙ্গিনীর দিকে তাকাই। তিনি ওখান থেকেই আমাকে দেখছেন। একটুও ত্যারছা চোখে নয়। আমাকে দেখছেন। মানে আমার নতুন করে কল টেপাটিপি দেখছেন।
ফোনের রিং ওই প্রান্তে আদৌ বেজেছে কি বাজেনি, সম্পাদক ধুম করে বলে বসলেন–
আমি তারস্বরে বোঝানোর চেষ্টা করি–
বলেই বুঝতে পারি, এত কথা-বলার আবশ্যকতা ছিল না। এতে অতি-অর্থের আশঙ্কা প্রবল। এবং সম্পাদক সময় না নিয়েই বললেন–
আমার এতক্ষণের তাড়াহুড়া কণ্ঠস্বরে প্রবল শ্বাসধ্বনিতে রূপ নেয়। এবং ঘুম ভিন্ন অন্যকিছু করছিলাম সেটা সত্য হলেও তখন অনুচ্চারণযোগ্য ছিল। আমি বুঝতে পারি। কিন্তু বলবার ঠিক পরেই।
পরে ফোন দেবার আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও আমি সম্পাদককে তখন অব্যাহতি দেবার কারণ পাই না।
ঘুমে শরম নাকি অন্যকিছুতে আমার মাথায় তখন আর আসছে না। নাকি ঘুম মানেই অন্যকিছু! আর অন্যকিছু মানেই শরম! আমি তখন তালগোল পাকিয়ে ফেললাম।
সম্পাদকের দৃশ্যকল্প দেখি বেসামাল জায়গায় গিয়ে ঠেকে। কাচের মধ্যে হঠাৎ সঙ্গিনীর দিকে চোখ যায়। তাঁর চোখ পূর্ববৎ তীক্ষ্ণ এদিকেই প্রোথিত।
আমি বিলকুল নাবুঝ হয়ে পড়ি যে কী করব। গত কয়েক মিনিটের মধ্যে কোথা থেকে কোথায় যে সবকিছু প্যাঁচপোঁচ লেগে। আমি মরিয়া হয়ে তাঁকে থামাই–
সম্পাদক, হঠাৎ, বিস্ময়করভাবে, শান্ত বেড়ালের মতো হয়ে গেলেন। গলার স্বর যথাসম্ভব নামিয়ে, হয়তো এমনকি স্নেহমাখা গলায়, হতে পারে, বললেন–
সম্পাদকের এহেন টীপ্পনিতে, কিংবা আসলে টীপ্পনিহীন সমাহিতপ্রায় বক্তব্যপ্রদানে আমার ধৈর্যশ্চ্যুতি ঘটে।
'আরে আপনি তো আচ্ছা লোক! ইরোটিক আমি বানালাম? এতক্ষণ আমাকে জেরার মধ্যে রাখলেন। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কেমন কেমন একটা ইয়ে ব্যাপার বানালেন। একটা সাধারণ ব্যাপার নিয়ে খ্যাচর খ্যাচর করে আমাকে অতিষ্ট করে দিলেন।'
আমাকে আসলেই বিশেষ পেরেশান শোনালো। এমনকি আমার নিজের কানেই। সম্পাদক, এদফা, বেশ ভাল ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। বা তাঁর খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস নিয়ে সম্যক ধারণা না থাকার কারণে আমার মনে হলো। তিনি তড়িঘড়ি বললেন–
আমার প্রায় আর্তনাদে সম্পাদক এবারে কথা ঘোরানোর সিদ্ধান্ত নিলেন বোধহয়–
হঠাৎ আমার সাহিত্য-জীবন চলচ্চিত্রের মতো আমার চোখে ভাসতে শুরু করল। সম্পাদক নিজে খুব ভাল লেখেন আমি জানতাম। তাঁর কথন-যোগ্যতাও আমার পরিচিত। কিন্তু তাই বলে সেলফোনে চলচ্চিত্রের মতো আমার লেখক-জীবনকে দেখিয়ে দিতে পারবেন, আমার একেবারেই কখনো তা ভাবনা ছিল না। আমার মুখে বিশেষ কোনো কথাও আসছে না দেখতে পেলাম। মানে শুনতে পারলাম। মানে না-শুনে বুঝতে পারলাম। আমার প্রাণ জুড়ে এমন কান্না চেপে আসলো যে কথা বলতেও বিশেষ সাহস হলো না। আমি কিছু বলছি না বলেই বোধহয় সম্পাদক, হয়তো সেলফোনের বিলের পুরো সদ্ব্যবহারের স্বার্থে, কথা বলেই চললেন। মোটামুটি এতখানি শুনবার পর আমার মনে পড়ল আমি কফি আসলে এখনো খাই-ই নাই। সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ল আমার সঙ্গিনী যে ভিতরে অপেক্ষমান। সেই অত্যন্ত বাস্তব বার্তাটি মনে পড়াতে কেমন একটা ভীতির অনুভূতি আমার হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। মনে হলো সেলফোন লাইনটা ফুস করে কেটে দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ি। কিন্তু তা করতে গেলে কান থেকে যন্ত্রটিকে আমার নামাতে হয়। আর তা কিছুতেই আমি করতে পারলাম না।
প্রায় মৃত্যুঘোষণা দেয়ার মতো গলায় আমি বললাম–
সম্পাদককে ভারী অবাক শোনালো–
এবারে আমাকে বেপরোয়া শোনালো রীতিমতো।
'না তো।' বেপরোয়া গলা বাদ দিয়ে আমি সম্পাদককে পরোয়া করতে শুরু করলাম।
সম্পাদক শুধালেন, 'কিঁউ?'
তাঁর এই কিঁউ-ধ্বনিতে আমার মাথার কী যেন একটা ভেজাল হলো।
আমি উত্তরে বললাম, 'কিঁউ কিঁউ।'
সম্পাদক বললেন, 'বস্, আপনি তো একদমই ঠিক নাই। কী হইছে কন তো?'
আমি আবার বলি, 'কিঁউ কিঁউ। কুঁই..কুইঁ।'
সম্পাদক বোধহয় বিচলিত হলেন। কী বলবেন সম্ভবত খানিকক্ষণ ভাবলেন।
তারপর বললেন, 'আপনে আর বাংলা কইবেন না?'
আমি বলে চলি, 'কুঁই…কুঁই…কুঁইইইই…কুঁইইইইইইইই….'
সম্পাদক হঠাৎ কিছু একটা খুঁজে পেলেন, 'আরে আপনার তো দেখি মেটামরফসিস চলতাছে।'
আমি আবারও, 'কুঁইইইইই…কুঁইইইইই…কেঁওও….কেঁওওওঔ…হ্ঔ হ্ঔ…ঘউউউউউউ…ঘউ ঘউ…………'
আমি থামলে সম্পাদক একটু বিরতি নেন। তারপর বললেন–
আমি ফোন বন্ধ করি না। তথাপি আশা করি এই সংলাপ একদা শেষ হবে। আমি সে কথাও বলি না।
মনে হলো সম্পাদক সত্যি সত্যি ফোন রেখে দিয়েছেন। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ওটার পর্দার দিকে তাকিয়েই থাকি আমি। ভিতরে যেতে হবে ভাবতেই আমার পা শুকিয়ে যায়।
মৃদু পায়ে আমি ভিতরে ঢুকি। ফোনটা পকেটে না-চালান দেয়ার কোনোই কারণ নেই। কিন্তু সেই সাধারণ কথাটাই আমার মনে থাকে না। আমি কফির ট্রের মতো করে ফোনটা বাগিয়ে একটু একটু করে টেবিলের দিকে যাই। আমার এই যাত্রাপথ পুরোটা তীক্ষ্ণ নজরে দেখতে থাকেন সঙ্গিনী। তাঁকে কী ভীষণ শান্ত দেখায়! আমি বাতের রুগির মতো করে চেয়ারে তাঁর সম্মুখে বসি। তিনি কিছু না বলে কফির খাতা উল্টাতে শুরু করলেন। তারপর, বহুকাল পর, তিনি বললেন–
আমার খুব বলতে ইচ্ছা করে যে এটা সম্পাদকের ফোন ছিল। কিন্তু আমি বলি–
সঙ্গিনী আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁকে একটুও বিচলিত দেখাল না। যেন তিনি জানতেনই যে আমি এই ভাষায় উত্তর করব। এর মধ্যে হাতের ইশারায় তিনি কফি-ডেস্কের দিকে কী জানি বললেন। হয়তো কফি তাঁর খাওয়া হয়ে গেছে। বিল দিতে বলছেন। কিংবা হয়তো কোন কফি নেব আমরা তা ইতোমধ্যেই বলা হয়ে গেছে। আমার আর মনে পড়ল না ঠিক কত সময় আমি বাইরে ছিলাম। আমি অধোবদনে বসেই থাকি। সঙ্গিনী আরও কিছু অনন্তকাল পর বলেন–
'কুঁই? তুমি ভেবেছো এতেই পার পেয়ে যাবে? তুমি ভেবেছো এই ভাষা আমি বুঝি না? আমি খুবই ভালো বুঝি।'
এবারে আর কিছু না-বলে আমি বসে থাকি। অধোবদনে। মাথা যথাসম্ভব শূন্য। বসে থাকি না-খাওয়া কফির জন্য। কিংবা হয়তো বিলের জন্য।
হঠাৎ, আচমকাই, সম্পাদকের চলচ্চিত্র চোখে ভেসে উঠল। কোলের উপর মুঠি-শক্ত করে-রাখা ফোনটা আমি টেবিলের উপর তুলি। খুবই স্পষ্টভাবে সেটার দিকে তাকাই। এরপর সঙ্গিনীর দিকে তাকাই। এবারও স্পষ্ট করে। কুঁইকুঁইহীন আমার দৃষ্টিনিপাতে সঙ্গিনী একটু ভুরু কুঁচকালেন। আমি আবার ফোনের পর্দার দিকে তাকাই। তারপর–
তারপর, একটুও না-ভেবে, একটানে আমি ঠিকানা টাইপ করে সম্পাদককে পাঠিয়ে দিই। বিল কিংবা কফির জন্য সেখানে আর থাকি না। গটগট করে হেঁটে বাইরে চলে আসি। সঙ্গিনী আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিনা সেটাও আর দেখার দরকার লাগে না তখন।
বাইরে এসে প্রথম যে চাকাওয়ালা বাহনখানা পেলাম তার তলে আমার ১১০০ টাকার মোবাইল ফোনখানি চালিয়ে দিলাম। নিখুঁতভাবে। টেম্পোর হেলপারের চোখে তখন ঝিলিক। কিন্তু সে একটুও বোঝেনি বোধহয় এটা কী। আর ঠিক তখুনি মনে পড়ল সময়টা একবার দেখে নিলে হতো।
একমাত্র সময় না-জানা ছাড়া আর কোনো সমস্যাই তখন নেই। কারণ ততক্ষণে সঙ্গিনীর সাততলার উপরে মায়াবী ফ্ল্যাটটার ঠিকানা সম্পাদক পেয়ে গেছেন।
(শুরু ১৭ই মার্চ ২০০৯॥ মোহাম্মদপুর, ঢাকা; শেষ ১২ই সেপ্টেম্বর ২০১১॥ শ্যামলীর একটা খাবার হোটেল, ঢাকা)
আর্টস-এ প্রকাশিত লেখা
প্রত্যাবর্তন: আমার 'ফেরা' নিয়ে যে কাহিনী না বললেও চলত (গল্প)
সায়েরার সঙ্গে ডিজিটাল মোলাকাত (সাক্ষাৎকার)
কক্ মানে মোরগ: উদ্ভ্রান্ত মোরগজাতি ও তাহাদের বিহ্বল প্রতিপালকগণ (গল্প)
—–
মানস চৌধুরী
…….
লেখকের আর্টস প্রোফাইল: মানস চৌধুরী
ইমেইল: [email protected]
—
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts