Published : 13 Jun 2024, 08:27 AM
জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক দক্ষিণের অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সহায়তার অঙ্ক ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি বছর দুই হাজার কোটি ডলার থেকে দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি উন্নত বিশ্ব দিলেও তা না রাখার কথা বলেছেন গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশনের (জিসিএ) প্রধান নির্বাহী প্যাট্রিক ফারকোয়েন।
ঢাকা সফরে এসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ২০২১ সালে গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর জন্য অভিযোজনের অর্থায়ন দুই হাজার কোটি ডলার থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বাড়িয়ে প্রতি বছর চার হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল উত্তরের দেশগুলো।
“আমরা এখন ২০২৪ সালে এসে কোথায় আছি? বাস্তবতা হচ্ছে, ২০০০ কোটি ডলারের অঙ্ক উপরে দিকে যাওয়ার কথা থাকলেও যাচ্ছে কিন্তু নিচের দিকে।”
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলবায়ু অভিযোজনে কাজ করা নেদারল্যান্ডস-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিসিএ’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) প্যাট্রিক ফারকোয়েন ভাগেনিংগেন ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের গ্লোবাল ফরেস্ট ডিপ্লোমেসির ভিজিটিং প্রফেসর।
অভিযোজনের জন্য অর্থায়নের পথ তৈরি এবং মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করছে জিসিএ।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ও বিভিন্ন দেশ-প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ডাচ সরকার প্রতিষ্ঠিত জিসিএ’র সুপাইভাজরি বোর্ডের চেয়ারের দায়িত্ব রয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান-কি মুন।
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চট্টগ্রাম ওয়াটার সাপ্লাই ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের (সিডব্লিউএসআইপি) সঙ্গে স্থানীয়দের জলবায়ু অভিযোজনের বিষয়কে সম্পৃক্ত করার একটি উদ্যোগ উদ্বোধন করতে এবার বাংলাদেশে এসেছেন অধ্যাপক ফারকোয়েন।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, যিনি এর আগে বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেছেন।
জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের অর্থায়ন কমিয়ে দেওয়ার পেছনে ইউক্রেইন ও ফিলিস্তিন সংকটকে অন্যতম কারণ হিসাবে দেখছেন প্যাট্রিক ফারকোয়েন।
তিনি বলেন, “এই সংখ্যা কমে যাচ্ছে কেন? কেননা, উন্নয়ন সহযোগীরা তাদের উন্নয়ন বাজেট কমিয়ে দিচ্ছে। কেন তারা উন্নয়ন বাজেট কমাচ্ছে? কারণ, ইউক্রেইন সংকট, ফিলিস্তিন সংকট এবং অন্যান্য কারণে উন্নয়ন বাজেট কমে যাচ্ছে।”
প্যাট্রিক ফারকোয়েন বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ৪০০০ কোটি ডলার কেবল আসতে পারে তখনই, যদি বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতারা ‘তাদের কণ্ঠ উচ্চকিত করতে পারেন।’
“তার যদি রাজনৈতিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারেন…। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে খুবই উচ্চকণ্ঠ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তিনি পালন করেছেন।”
জিসিএ এর প্রধান নির্বাহী বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি হচ্ছে, যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় সেটাকে কাজে পরিণত করা। আপনি বছরে চার হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সুতরাং এটা দিতে হবে। আমরা বলতে পারি না যে, ‘চলুন ভুলে যাই… ধন্যবাদ; চলুন অন্য প্রসঙ্গে যাই’।
“আমি মনে করি, ২০২১ সালে যেটা টেবিলে উত্থাপন করা হয়েছে, সেটা রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটাই প্রথম অগ্রাধিকার।”
প্যাট্রিক ফারকোয়েন বলেন, “বিশ্ব দুই হাজার কোটি থেকে বাড়িয়ে চার হাজার কোটি ডলার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং সেটা পুরো বিশ্বের জন্য। অথচ বাংলাদেশেরই প্রয়োজন ৮৫০ কোটি ডলার। তার মানে পুরো সংখ্যাটাই অপ্রতুল এবং সেটাও নিচের দিকে যাচ্ছে।”
‘জলবায়ুর চশমায় দেখা হোক যে কোনো প্রকল্প’
যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজনের বিষয়কে বিবেচনার কেন্দ্রে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক ফারকোয়েন।
তিনি বলেন, যে কোনো উন্নয়ন অর্থায়নে, সকল ঋণ কিংবা অনুদানে এবং বাস্তবায়নাধীন সব ধরনের প্রকল্পে জলবায়ুর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাখা দরকার।
“এটা কেবল বেশি অর্থ আসার বিষয় নয়, বর্তমানের অর্থকে কতটা বেশি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে খরচ করা যায়, সে বিষয়ও রয়েছে। এটাও সমীকরণের আরেকটা অংশ।”
জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানকে ‘অসাধারণ’ হিসাবে বর্ণনা করে জিসিএ এর প্রধান নির্বাহী বলেন, বৈশ্বিক দক্ষিণের অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভিন্নতা হচ্ছে, এখানে স্থানীয় জনগণ উন্নয়ন প্রকল্পের আকার দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
“স্থানীয়দের নেতৃত্বে অভিযোজনের এজেন্ডা বাংলাদেশের খুব প্রোথিত। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেটি জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে করদাতাদের টাকায় ১২০ কোটি ডলার খরচ করছে। অভিযোজনের ক্ষেত্রে এটা বিরল অঙ্ক। ১২০ কোটি ডলার বড় সংখ্যা মনে হলেও এখানে প্রয়োজন কিন্তু ৮৫০ কোটি ডলার।”
জলবায়ু বিষয়ক নীতি প্রণয়ন ও নীতিগত সংস্কারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের এগিয়ে থাকার বিষয়টি তুলে ধরে প্যাট্রিক ফারকোয়েন বলেন, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনাসহ সব ধরনের ফ্রেমওয়ার্ক এখানে রয়েছে।
“নীতি সংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুব অগ্রগামী অবস্থানে রয়েছে। আমার মতে এর কারণ হচ্ছে, জলবায়ুর অভিঘাত এখানে দশকের পর দশক ধরে অনুভূত হচ্ছে। সুতরাং প্রয়োজনের খাতিরেই নীতিগত সংস্কারকে বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে।”
জলবায়ু বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফকে সহযোগিতা দেয় জিসিএ
অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান হিসাবে কার্যক্রম শুরু করলেও এখন উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে জলবায়ু বিষয়ক তথ্যানুসন্ধান এবং বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ দেওয়ার কাজ জিসিএ করে বলে জানান অধ্যাপক ফারকোয়েন।
উন্নত দেশগুলোকে বিশ্লেষণমূলক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতার কথা কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বৈশ্বিক উত্তরের নেতাদের অগ্রাধিকারের কেন্দ্রে জলবায়ু জরুরি অবস্থা নেই। বরং ইউক্রেইন, ফিলিস্তিনের সংকট, খাদ্য নিরাপত্তা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে খুবই ব্যস্ততা তাদের।
“আপনি যদি তাদেরকে কাজ করার উপায় না দেন, তারা দ্রুত অন্যত্র দৃষ্টি ফেলবে। এ কারণে আমাদের দ্বিতীয় শক্তি হচ্ছে বিশ্লেষণ। অর্থনৈতিক বিষয়াদি তুলে ধরে আমরা তাদের সামনে যুক্তি হাজির করে থাকি যে, এটা করুন, ওটা করবেন না; অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ন্যাচারাল সলিউশন যদি আপনি ব্যবহার করেন, তা খরচ কমাবে।”
জিসিএ বাংলাদেশের মোংলা এবং চট্টগ্রামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যেখানে বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবিসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পের ক্ষেত্রে জলবায়ু অভিযোজনের বিষয়কে সম্পৃক্ত করার বিষয় রয়েছে।
প্যাট্রিক ফারকোয়েন বলেন, আইএমএফের রেজিলিয়েন্ট সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) হচ্ছে জলবায়ু বিষয়ক সবচেয়ে বড় ফান্ড। আরএসএফের অর্থায়ন বাংলাদেশও নিচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতি ও নীতি সংস্কার নিয়ে কাজ করে আইএমএফ।
“আমরা আইএমএফ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে দেখি জলবায়ুর সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিত সেখানে আসছে কি না। কেননা, জলবায়ু বিভাগ বলতে কিছু আইএমএফের নাই। এক্ষেত্রে জিসিএ এর মত প্রতিষ্ঠান আইএমএফকে সহযোগিতা দিয়ে থাকে।”