Published : 10 Jul 2024, 11:02 PM
ঢাকায় এক কর্মসূচি থেকে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বাতিলের ষড়যন্ত্র বন্ধ করে সেটি অব্যাহত রাখার আহ্বান এসেছে।
বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটিতে রাজু ভাস্কর্যে ‘ঢাকাস্থ জুম্ম শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজ’ এর ব্যানারে এক মানববন্ধন থেকে এ আহ্বান আসে।
কর্মসূচিতে ঢাকাস্থ জুম্ম নাগরিক সমাজের সিনিয়র প্রতিনিধি ও অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. অজয় চাকমা বলেন, “সেই ব্রিটিশ কলোনিস্ট সরকার এ অঞ্চলের জাতিসমূহের অস্তিত্বের প্রতি সম্মান রেখে ১৯০০ সালের শাসনবিধি তৈরি করেছিল। কিন্তু এর বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র, সেটা তো এই সরকারের জন্যই লজ্জাজনক।”
তিনি তার বক্তব্যে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অব্যাহত রাখাসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জোর দাবি তোলেন। এ ছাড়া আদিবাসী কোটা পুনর্বহালের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান রাখেন এই চিকিৎসক।
প্রকৌশলী ক্যসাচিং মারমা বলেন, “আদিবাসীদের জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সিডিউল ট্রাইব, সিডিউল কাস্ট ও ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটি নামে প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা রেখেছে।
“আমরা জানি পার্বত্য চুক্তির পেছনে সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০ এর স্পিরিট রয়েছে। আমরা আশা রাখি, সরকার আমাদের ন্যায্য চাহিদা ও সুবিধার কথা ভেবে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সুলভ চাকমা তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, “আমরা জানি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক দশমাংশ নিয়ে গঠিত। এখানকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামো মূল ভূখণ্ডের চেয়ে ঐতিহাসিকভাবে ভিন্ন।
এম এন লারমার এক বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে সুলভ চাকমা বলেন, “তিনি বেলেছিলেন, ‘এই দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে সকল জাতিসত্তাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’ এই অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্যই এই রেগুলেশন দরকার। এটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।”
“আমরা দেখতে পাই মোঘল আমালেও এই অঞ্চলে আলাদা মর্যাদা ছিল। ব্রিটিশরাও এই অঞ্চলকে শাসনবহির্ভূত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এই অধিকারের প্রতি সম্মান রেখে ব্রিটিশ সরকার শাসনবিধি প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই শাসনবিধি বাতিলের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়। এটি সরকারের জন্য লজ্জাজনক।
“জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো টালবাহানা চলবে না। আমরা এম এন লারমার উত্তসূরি। আমরা যেমন সংসদে আইন নিয়ে কথা বলতে পারি, তেমনি বনেজঙ্গলে অস্ত্রও ধরতে পারি।”
কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, “বিশ্বব্যাপী যেখানে আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে, ঠিক সে সময়ে আমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে নানা ষড়যন্ত্র চলেছে। আমাদের প্রায়ই সময় শুনতে হয়, আমরা নাকি বিচ্ছিন্নতাবাদী। কিন্তু আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হতে চাওয়াটা কি বিচ্ছিন্নতাবাদ?
“বর্তমানে আমাদের অস্তিত্বের হাতিয়ার শাসনবিধি বাতিল করার যে ষড়যন্ত্র, এটি আমাদের দেশ থেকে বিতাড়নের ষড়যন্ত্র। সরকার যদি এ ভুলটা করে তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিপর্যয় ঘটবে।”
উৎপল দেওয়ান বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বাতিলের যে ষড়যন্ত্র সেটা আমরা মানি না। আমরা সেই শাসনবিধি বাতিল বা সংশোধন কোনোটিই চাই না। কেননা সেটি পাহাড়িদের সংস্কৃতি, প্রথা ও ঐতিহ্য রক্ষার দলিল। পাহাড়ের ভূমি ব্যবস্থায় খাস জমি নেই। পাহাড়ের সকল জমির মালিকানা আমাদের প্রথাগত হেডম্যান ও রাজাদের ওপর নির্ভরশীল ।”
বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ঢাকার সভাপতি ও ঢাবির শিক্ষার্থী দনওয়াই ম্রো বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা জাতির সমাবেশ। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, প্রশাসন, আইন সবকিছু ওই রেগুলেশনের মধ্যে আছে। কিন্তু বর্তমানে কিছু গোষ্ঠী সেটি বাতিল করার ষড়যন্ত্র করছে এবং সরকারও তাতে সায় দিচ্ছে । যদি এটি বাতিল হয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের সাথে জুম্ম জনগণের করা চুক্তিটাও অবৈধ হবে। আমরা চাই অনতিবিলম্বে এই ষড়যন্ত্র বন্ধ করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন।”
অংশৈসিং বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম শানসবিধি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে একটি শাসনবহির্ভূত এলাকা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমালে সেটাকে ট্রাইবাল এরিয়া বলে ঘোষণা করে। আমরা দেখেছি, জুম্ম জনগণের অনুমতি ছাড়া কাপ্তাই বাঁধ করে লাখো মানুষকে উদ্ভাস্তু হতে বাধ্য করা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিবর্তন হয় কিন্তু জুম্ম জনগণের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ কেউ বন্ধ করে না।”
সাবেক প্রকৌশলী কুবলেশ্বর ত্রিপুরা বলেন, “সেখানে যারা থাকে তাদের কোনো ভূমি মালিকানা নাই। আমাদের মানুষজন প্রতিদিন উচ্ছেদ হচ্ছে । আজকে যে মানুষ যে জায়গায় আছে সে কালকে সেখানে নাই। প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ হচ্ছে। আমাদের প্রথাগত আইন এবং শাসনবিধি বহাল না থাকলে এক সময় আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না।”
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, “যদি এই শাসনবিধি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকবে না। আপনার অনেকেই বাইরে গিয়ে বলে থাকেন বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ বহুজাতির দেশ। কিন্তু এই আইন বাতিল হলে আপনারা সেটাও দাবি করতে পারবেন না।”
অন্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ঢাকাস্থ জুম্ম নাগরিক সমাজের তরুণ প্রতিনিধি সতেজ চাকমা, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের প্রতিনিধি লিটন ত্রিপুরা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক অং সুয়ে সিং মারমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জ্যাকি হ্লা মারমা মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন।