Published : 13 Jun 2025, 09:42 PM
ঈদের ছুটি এখনো শেষ হয়নি, ফাঁকা নগরী। পল্টন থেকে সদরঘাটে যেতে যে সড়কে বাসে বসে থাকতে হত ঘণ্টারও বেশি সময়; সেই সড়ক ধরেই ২০ মিনিটে পৌঁছানো গেল পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিলে।
ওয়াইজঘাটের রাস্তা ধরে হাতের বামে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ফেলে সোজা তাকাতেই চোখের সামনে লাল রংয়ের প্রাসাদ। গেইটের সামনে মানুষের জটলা। এতক্ষণ যে ফাঁকা সড়কের চিত্র দেখা গিয়েছিল, তার বিপরীত চিত্র আহসান মঞ্জিলের প্রবেশ গেইটে। অসংখ্য মানুষ; টিকেট কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইন।
ঈদের এক সপ্তাহ ছুটির পর আহসান মঞ্জিল জাদুঘর শুক্রবার বিকাল থেকে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে, খোলা ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। শনিবার থেকে নিয়মিত সূচিতে খোলা থাকবে জাদুঘরটি।
আহসান মঞ্জিলের টিকেট কাউন্টারের সামনেই দেখা মিলল সংগীতশিল্পী সন্দীপন ও কবি চামেলী বসু দম্পতির সঙ্গে। তারা এসেছেন সন্তান সৌরদীপ্ত জিজোকে নিয়ে।
সন্দীপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আহসান মঞ্জিলে ছেলেকে নিয়ে কখনো আসা হয়নি আগে। আজকে এলাম।"
চামেলী বসু কিছুটা আক্ষেপের সুরেই বললেন, “ঢাকা শহরে বিনোদনকেন্দ্র কেমন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। শিশুদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর তো খুব বেশি জায়গা নেই।”
প্রথমবার আহসান মঞ্জিলে এসে ‘ভীষণ ভালো’ লাগার কথা জানাল সন্দীপন-চামেলী দম্পতির ছেলে সৌরদীপ্ত।
প্রবেশ গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল এক নবদম্পতি বিয়ের সাজে ফটোশ্যুট করছে। কেউ এসেছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, কেউবা বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
মোহাম্মদপুর থেকে আরমানী ইসলাম এসেছিলেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদে তো সবাই গ্রামের বাড়ি যাই, কিন্তু আমার গ্রামের বাড়ি নাই। মোহাম্মদপুরেই জন্ম, ঢাকা শহরই আমার গ্রামের বাড়ি। সবাই বাড়ি চলে গেলে ফাঁকা ঢাকায় ঘুরতে ভালো লাগে, আবার সবাই নাই বলে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকাও লাগে।
“ঈদের ছুটিতে আহসান মঞ্জিলে আসার প্ল্যান ছিল, বন্ধ থাকায় আসা হয়নি। আজকে খোলা হয়েছে, তাই এসেছি। এ ধরনের জায়গাগুলো ছুটির দিনে কেন বন্ধ রাখা হয়? এগুলোতে তো মানুষ ছুটির দিনেই আসবে।”
আহসান মঞ্জিল ঢাকা শহরের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ ছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত এই প্রাসাদটি বাংলার একটি প্রধান রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল। ১৯৯২ সালে ভবনটি পুনঃসংস্কার করে ২৩টি গ্যালারি নিয়ে যাত্রা হয় জাদুঘর হিসেবে।
আহসান মঞ্জিলের পূর্ব পাশে যে ফটকটি উন্মুক্ত, তার ডান পাশে টিকেট কাউন্টার। আর কাউন্টার হিসেবে যেসব কক্ষ ব্যবহৃত হচ্ছে, আগে সেগুলো সৈনিকদের ব্যারাক ও গার্ডরুম ছিল।
প্রাসাদের বড় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মায়ের সঙ্গে ছবি তুলছিলেন রাশেদ ইমতিয়াজ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাকে নিয়ে তো তেমন বের হওয়া হয় না। এজন্য এবার ছুটি অনেক দিন, তাই ঘুরছি। মাকে নিয়ে সিনেমা দেখতেও গিয়েছিলাম।”
আহসান মঞ্জিলের প্রবেশ গেইটের সামনে রিকশা এবং হকারের দোকানের কারণে বিরক্তি প্রকাশ করেন দর্শনার্থীদের কেউ কেউ।
রবিউল ইসলাম নামে এক দর্শনার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গেইটের সামনে আচারের দোকান, আইসক্রিমের দোকানের কারণে এখানে ধাক্কাধাক্কি করে ঢুকতে হয়েছে। দোকান একটু দূরে থাকতে পারে।
“কিন্তু গেইটের সামনে যদি, এ রকম থাকে তাহলে তো লোকজনের প্রবেশ করতে বিড়ম্বনা হয়।”
রবিউলের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখনই দেখা যায়- গেইটের সামনে থাকা ভ্রাম্যমাণ হকারদের তুলে দিচ্ছেন এক পুলিশ সদস্য। কিছুক্ষণ পরই হকাররা প্রবেশ গেইটের সামনে দোকান বসান।
আহসান মঞ্জিলই ঢাকার প্রথম ইট-পাথরের তৈরি স্থাপত্য, যেখানে ঢাকার মধ্যে প্রথম বিদ্যুৎ বাতির প্রচলন হয়। মঞ্জিলের স্থাপত্যশৈলী পশ্চিমাদের সবসময়ই আকৃষ্ট করত। লর্ড কার্জন ঢাকায় এলে এখানে থাকতেন।
১৮৩৫ সালের দিকে বেগমবাজারে বসবাসকারী নবাব আবদুল গনির বাবা খাজা আলীমুল্লাহ এটা কিনে নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৮৭২ সালে নবাব আবদুল গনি নতুন করে নির্মাণ করে তার ছেলে খাজা আহসানউল্লাহর নামে ভবনের নামকরণ করেন ‘আহসান মঞ্জিল’।
এই ভবনটি ১৮৮৮ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ও ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে ৪ হাজারের বেশি নিদর্শন রয়েছে। এই প্রাসাদের ৩১টি কক্ষের মধ্যে ২৩টিতে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ১৯০৪ সালের আলোকচিত্রশিল্পী ফ্রিৎজকাপের তোলা ছবি অনুযায়ী সাজানো হয়েছে ৯টি কক্ষ।
প্রাসাদের সামনের খোলা চত্বরে অনেক রকমের গাছের মন মাতানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে অনেককে। তবে আহসান মঞ্জিলের চারদিকে দোকান, হকারদের ভিড় আর বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান বড় বড় জাহাজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কিছুটা নষ্ট করছে বলে মনে করেন দর্শনার্থীরা।
আহসান মঞ্জিল জাদুঘর মূলত বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের একটি শাখা জাদুঘর হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা রাখা হয়। শনিবার থেকে নিয়মিত সূচিতে আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে পরিদর্শন করা যাবে। শনি থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে আহসান মঞ্জিল। সাপ্তাহিক বন্ধ বৃহস্পতিবার।
এখানে বাংলাদেশিদের প্রবেশমূল্য ৪০ টাকা, ৩ থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য ২০ টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের প্রবেশ ফি ৩০০ টাকা।