Published : 06 Jun 2025, 07:47 PM
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দিলে ‘নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হবে না’ দাবি করে বিরোধিতাকারীদের ‘প্রতিহত’ করার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, “বন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা যাদের আনছি তারা পৃথিবীর যে-সব দেশে কাজ করে সেসব কোনো দেশেরই সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েনি।”
ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এমন দাবি করে নিজেদের ‘ভিত্তিহীন’ বিরোধিতা ও ‘অপপ্রচারের’ শিকার হতে না দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সন্ধ্যা ৭টায় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, “আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই আপনারা নিজেদেরকে ভিত্তিহীন বিরোধিতা এবং অপপ্রচারের শিকার হতে দেবেন না।
“অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন্দর ব্যবস্থাপনার উদ্যোগে আপনাদের দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রাখুন। যারা বিরোধিতা করছে তাদের প্রতিহত করুন।”
তিনি বলেন, “আমরা চাই, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। এ কারণে বিনিয়োগ পরিষেবার উন্নয়নের পাশাপাশি বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছি।
“এটা করা সম্ভব না হলে দেশের কোটি কোটি মানুষের বেকারত্ব ঘুচবে না। অর্থনৈতিক সংকট রয়েই যাবে।”
সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার খবরে এ নিয়ে বির্তক তৈরি হয়েছে।
বিদেশিদের হাতে বন্দর ছেড়ে দিলে দেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অর্থনীতির বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এ উদ্যোগের বিরুদ্ধে মত দিচ্ছেন।
বিএনপির শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক দল চট্টগ্রামে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়া নিয়ে সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকেও কথা এসেছে। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত; এখানে স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের মতামত প্রয়োজন হবে।
২৫ মে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিন দেশের তিন কোম্পানির সঙ্গে সরকারের আলোচনা চলার কথা বলেছেন।
পুঁজিবাজারভিত্তিক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দরে আমরা গভীর সংস্কার করতে চাচ্ছি। আমরা চাচ্ছি যেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় কোম্পানি বন্দর ব্যবস্থাপনা করতে পারে।
“এজন্য আমরা বিদেশের সবচেয়ে বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে কথা বলছি। দুবাই পোর্ট ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে কথা বলছি; এপি মুলার মার্কসের সঙ্গে কথা বলছি এবং পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটির সঙ্গে কথা বলছি। ফলে যেটা হবে, ওরা যদি ম্যানেজ করেন, তাহলে আমাদের বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে।”
এরপর চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেছেন, বন্দর নিয়ে মত না বদলালে কোরবানির ঈদের পর বাম গণতান্ত্রিক জোট ও তেল-গ্যাস, বন্দর রক্ষা কমিটি লং মার্চ কর্মসূচি দেওয়া হবে।
প্রায় ৪০ মিনিটের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে অনেকের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। মাঝেমাঝে এমন কথাও শুনেছি যে এ বন্দর বিদেশিদেরকে নাকি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
“আমি আগেও জানিয়েছি, চট্টগ্রাম বন্দর হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। বর্তমানে এই হৃৎপিণ্ড অতি দুর্বল। এখন যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় তাকে রেখে দিলে আমাদের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।”
চট্টগ্রাম বন্দরকে শক্তিশালী করার জন্য অভিজ্ঞদের সাহায্য লাগবে দাবি করেন মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি তারা বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সেরা, সবচেয়ে অভিজ্ঞ। তারা ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাসহ বিশ্বজুড়ে বন্দর পরিচালনা করে।
“তাদের কাজ বন্দর ব্যবস্থাপনা করা, আমাদের লক্ষ্য হলো বন্দর ব্যবস্থাপনার কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের কাছ থেকে শিখে নেওয়া।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, যদি ৩১ সালের মধ্যে আমরা বন্দরের কাজ শিখে ফেলি এর পরবর্তী ৫ বছরে অর্থাৎ ৩৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর যত দেশে যত বন্দর এই কোম্পানিগুলো চালায় তাদের বহু বন্দর এই বাংলাদেশিরাই পরিচালনা করবে।
“আপনারা যে বন্দরেই পা দেবেন, দেখবেন সেখানে বাংলাদেশিরা আছেন। বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে। বহু লোকের ওপরে ওঠার সুযোগ হবে। তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই তারা আমাদের চাকরি দেবে।”
নিজের জাহাজে চড়ার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আগে যেকোনো জাহাজে চড়লে দেখতেন জাহাজের নাবিক চট্টগ্রামের কিংবা সিলেটের।
“বন্দরের কাজ একবার শিখে নিতে পারলে ভবিষ্যতে আমরা যে বন্দরে যাব না কেন দেখব সেখানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেট আর বরিশালের লোক। বাংলাদেশের লোক।”
বন্দর আধুনিক হলে তা শুধু বাংলাদেশের অথর্নীতিতেই ভূমিকা রাখবেন না, বরং আমরা নেপাল, ভূটানসহ পাশের সকল দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ‘ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে’ বলে দাবি করেন তিনি।
এই বন্দরই এ অঞ্চলের অর্থনীতির সমৃদ্ধির ‘চাবিকাঠি’ দাবি করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “কুমিরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত নানা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্যে সমগ্র উপকূল অঞ্চল দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
“এই পুরো অঞ্চলে অনেকগুলো শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে শুধু সমুদ্রের সান্নিধ্য এবং তার ব্যবহারের দক্ষতার কারণে। তার সঙ্গে গড়ে উঠবে আরেকটি নতুন শিল্প।
“আধুনিক পদ্ধতিতে সমুদ্রে মাছ পালন, আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্প। এটি আরেকটি নতুন জগত সৃষ্টি করবে। এ ব্যাপারে আমরা আমাদের বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি এবং তারা উৎসাহ সহকারে সাড়া দিয়েছেন।”