Published : 12 May 2025, 06:47 PM
আন্দোলনের মাঠে প্রতিপক্ষের উদ্দেশে এবং ভিন্ন ধর্ম ও নারীদের নিয়ে আক্রমণাত্মক কটূভাষার বয়ান ও স্লোগান ব্যবহারের ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছেন সংগীত শিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান।
এই শিল্পী মনে করেন, প্রতিশোধের পাল্টাপাল্টি চর্চা কেবল বিদ্বেষই ছড়াচ্ছে সমাজে, যা দেশের জন্য কোনো ভালো পরিণতি বয়ে আনছে না।
ফেইসবুকে এক দীর্ঘ পোস্টে হত্যা-সহিংসতা এবং ঘৃণা-বিদ্বেষ উসকে দেয় এমন কথাবার্তা ও স্লোগান বন্ধে উদ্যোগ নিতে অন্তর্বর্তী সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে আহ্বান জানিয়েছেন সায়ান।
তিনি মনে করেন ‘ঘৃণা নিয়ন্ত্রণ কমিশন’ এখন সময়ের দাবী। আইনি প্রক্রিয়ায় ঘৃণার চর্চাকে নিষিদ্ধ করার তাগিদ দিয়েছেন সায়ান।
সরকারকে উদ্দেশ্য করে সায়ান লিখেছেন, “আমি বর্তমান সরকারকে এই বিষয়গুলোতে কঠোর হতে জোর দাবী জানাই। আপনারা ঘৃণা চর্চার বয়ানকে চিহ্নিত করুন,আক্রমণাত্মক ভাষা-ভংগী এগুলো নিয়ে কাজ করুন। সিভিলিয়ানদের জন্য সিভিল বিহেভিয়ারের এর মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করার কথা ভাবুন।
“বিভিন্ন মঞ্চে গিয়ে একে বেশ্যা,তাকে দালাল, এগুলো তো রোজকার ব্যাপার হয়েছে । তার সংগে এই যে জবাই করার কথা বলা, " ধরে ধরে জবাই কর", এটা পৃথিবীর যে কোন সমাজে,যে কোন রাষ্ট্রে কিভাবে গ্রহণযোগ্য? এইভাবে ঘৃণার এবং হত্যা-হুমকির খুল্লামখুল্লা চর্চা চালিয়ে যাবে কেউ,আর তারপর সেটার কোন পরিণতি হবে না, এটা কেন গ্রহণ্যোগ্য? এখানে তো ব্যক্তিকে হত্যা করার কথা বলা হচ্ছে। এটা কিভাবে স্বাভাবিক? এটা স্লোগান হিসাবে কেন আপত্তিকর নয়? হত্যার উস্কানি নয়?"
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের কথা তুলে ধরেন সায়ান।
তিনি বলেন, “ওই সময়ও আনন্দ হয় নাই প্রাণে। শিহরিত হই নাই। বিচার চাওয়া আর জবাই করা এক ব্যাপার না। বিচারের সংস্কৃতিই সেটা নয়।”
সায়ানের কথায়, সাধারণের ভিড়ে উন্মত্ত জনতা মিশে থাকে এবং তাদের কাছ থেকে কিছু আশা করারও থাকে না। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা আশা করেন সায়ান।
তিনি লিখেছেন, “সাধারণ জনতার ভিড়ে সুশীলও থাকেন, উন্মাদ মব-জনতাও থাকেন। তাদের কাছে কিছু আশা করি না বাড়তি। তারা রাষ্ট্রের দায়িত্বে নাই। তারা যে যার নীতি-গতি-বিবেক অনুযায়ী আচরণ করবেন, সকলেরই দেশ, সকলেই স্বাধীন। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দিক থেকে তো একটা মানদণ্ড থাকতে হবে আচরণের। কেন একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে বেশ্যা ডেকে পার পাবেন? কেন যে কেউ যে কাউকে ভালো না লাগলেই জবাই করার হুমকি দেবেন,এবং তার স্বাভাবিকীকরণ হবে?”
অন্য ধর্ম এবং নারীর প্রতি বিদ্বেষ বন্ধে ‘ঘৃণা নিয়ন্ত্রণ কমিশন’ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন সায়ান।
“কেন বিভিন্ন মাহফিলে ঘেন্না ছড়ানোর বয়ান চলতে পারে যুগের পর যুগ, অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি? মেয়েদের প্রতি? একটা "ঘৃণা নিয়ন্ত্রণ কমিশন " এখন সময়ের দাবী।”
আন্দোলন-কর্মসূচিতে স্লোগানের মাধ্যমে বিরুদ্ধ পক্ষের প্রতি সহিংসতা প্রদর্শনের সমালোচনা করেছেন এই শিল্পী।
সায়ান লিখেছেন, “সেদিন দেখলাম কোন এক মঞ্চ থেকে কেউ কেউ তালে তালে বলছেন," একটা একটা লীগ ধর,ধরে ধরে জবাই কর!"। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা মানুষেরা কেন এই চর্চায় কোন সমস্যা পাচ্ছেন না?? মব-জনতা উন্মাদনায় ভেসে যাচ্ছে জংলীপনায়। কিন্তু রাষ্ট্রের নিযুক্ত সেবকেরা কি করে এখানে নির্বিকার থাকবেন?
“এগুলোকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে দেখতে চাই। কেউ অপরাধ করলে তার বিচার করবেন আদালতে। জবাই করার স্লোগানের মধ্যে ২০১৩ তেও দেশপ্রেম ছিল না, এখনো নাই। বিচারের মানসিকতা ছিল না।এখনো নাই।”
জুলাই অভ্যুত্থান দমনকারী এবং যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে সায়ান লিখেছেন, “এই দেশে গণহত্যার আগের জমানার কারিগরেরা বা সহযোগীরা কেউ নাই এখন। গোলাম আজম, নিজামী এরা কেউ নাই আর। হাসিনাও এখানে ফিরবে শুধু বিচারেরই মুখোমুখি হতে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ সেটা নিশ্চিত করবে, তাতে কোন সন্দেহ রাখলাম না।
“কিছু লোকের পাল্টাপাল্টি প্রতিশোধের খেলা থেকে মুক্তি পেতে চাই। গা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে সংস্কৃতি পাল্টাবে না। কাজ করতে হবে। ক্যাম্পেইন করতে হবে। এখানে মানুষ গালি দেয়া এবং জবাই করার হুমকি দেবার মধ্যে দিয়ে দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব শেষ করে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।”
গায়েবি মামলা বন্ধে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি লিখেছেন, “সরকারকে বলছি। গায়েবী মামলা দিয়ে তুলে নিয়ে যেয়েন না কাউকে কেউ কিছু বললেই। কোন কথাগুলো ভায়োলেন্ট এবং অফেনসি।, সেগুলোর তালিকা করেন।”
ঘৃণার চর্চা বন্ধে আইনি প্রক্রিয়া চাইছেন সায়ান, যা রাজনৈতিক নিষিদ্ধের তুলনায় সহজ প্রক্রিয়া বলে মনে করেন তিনি।
“আইনিভাবে ঘৃণা চর্চাকে নিষিদ্ধ করেন। এটা কোন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার জটিল প্রক্রিয়ার চেয়ে কিছুটা সহজ হবে করা। ঘৃণা চর্চাকে খাটো করে দেখবেন না। সেখান থেকে বৈধতা আসে বড় বড় অপরাধের।”