Published : 18 Jun 2025, 10:54 PM
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন হলে আরেকটি ‘স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান’ গড়ে উঠবে বলছে গণফোরাম। আর বিএনপি বলছে, এনসিসি হলে তার ‘জবাবদিহিতা থাকবে না’ বিধায় প্রয়োজন নেই।
এনসিসি গঠনে এমন বিরোধিতায় ‘হতাশা’ প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল মাল্টিপারপাস হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় দিনের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, “জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছি- রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানের দিক থেকে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো, যেগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ দিবে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক দলগুলো অনুভব করে কিনা।
“দুই-একটি দল থেকে নীতিগত মতপার্থক্য থাকলেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল মনে করে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। আবার বেশ কয়েকটি দল এ বিষয়ে একমত হয়নি।”
এনসিসি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল মন্তব্য করে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, “জাতির স্বার্থে আমরা যেন এনসিসি নিয়ে একটা ঐক্যমতে আসতে পারি। কিন্তু খুবই হতাশাজনক, আমরা ঐক্যমতে আসতে পারিনি।”
বেলা সাড়ে ১১টায় শুরুর পর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এরপর দুপুরের খাবারের বিরতির পর বেলা ৩টায় ফের সংলাপ শুরু হয়।
এদিন আলোচনা ছিল ‘বয়কট’ থেকে জামায়াতে ইসলামীর সংলাপে ফিরে আসা। আর বিকালে ‘বৈষম্যের’ অভিযোগ তুলে গণফোরাম ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির বেরিয়ে যাওয়া এবং আবার ফিরে আসা।
সংলাপ বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলার কথা বলা হলেও তার আগে শাহাদাত হোসেন সেলিম সংলাপ থেকে বের হয়ে যান। তিনি ব্যক্তিগত কারণে বেরিয়ে যাচ্ছে বলেছেন।
শাহাদাত হোসেন বেরিয়ে যাওয়ার পর পর সাড়ে ৪টার দিকে বের হয়ে যান গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি। তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
এসবের বাইরে মূলত এনসিসি ছিল আলোচনার বিষয়।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সেখানে ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, আইয়ুর মিয়া, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।
এনসিসি কী?
রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে নয় সদস্যের একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের সুপারিশ রয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের।
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি’ গঠনের এ সুপারিশ করেছে কমিশন।
এনসিসিতে থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে উভয়কক্ষের কোনো একজন সংসদ সদস্য।
বিএনপির আপত্তি যেখানে
সংলাপ থেকে বের হয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এনসিসিকে সাংবিধানিকভাবে অনেক অনেক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর জবাবদিহিতা নাই। যদি কর্তৃত্ব থাকে, ক্ষমতা থাকে কিন্তু জবাবদিহিতা থাকে না, সেই রকম কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমরা গণতান্ত্রিক পার্টি হিসেবে সমর্থন জানাতে পারি না।”
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতিকে প্রধান করে নয় সদস্য বিশিষ্ট একটি সাংবিধানিক কাউন্সিলের প্রস্তাব করেছে কমিশন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী, উচ্চ কক্ষ ও নিম্ন কক্ষের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেত্রী, প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত ডেপুটি স্পিকারের নিয়ে এসসিসি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা এ ধারণার সাথে একমত না।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকলে অতীতের নির্বাচনগুলো এভাবে হত না মন্তব্য করেন বিএনপির এই স্থায়ী কমিটির সদস্য।
এনসিসি নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিকল্প কোনো প্রস্তাব যদি আসে, সেটা আমরা দলের মধ্যে আলোচনা করবো। সেটা নিয়ে আমাদের আবার চিন্তা করতে হবে।
“সাংবিধানিক কমিশনগুলো নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন আছে। সে আইনগুলোকে আমাদের সংশোধন করতে হবে। আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ, গঠন সংক্রান্ত যে আইন আছে, নির্বাচন কমিশন গঠনতন্ত্র সম্পর্কিত যে আইন আছে, সে আইনের আমরা নিজেরাও সমালোচক।
“আমরা প্রস্তাব করেছিলাম সেই আইনটি, অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সবার সাথে আলোচনা করে সে আইনটি সংশোধন করুক। তারপর আমরা ব্যবস্থা নেব।”
এনসিপির ‘হতাশা’
এনসিসির বিষয়ে ঐক্য না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, “এনসিসি নিয়ে ঐকমত্য হয়নি, পরবর্তী সপ্তাহে আলোচনা করা হবে। আমরা মৌলিক সংস্কারের যে রূপরেখা দিয়েছিলাম ঐকমত্য কমিশনকে, তার মধ্যে এনসিসি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
“আমরা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে অনুরোধ করেছিলাম জাতির স্বার্থে আমরা যেন এনসিসি নিয়ে একটা ঐক্যমতে আসতে পারি, কিন্তু খুবই হতাশাজনক আমরা ঐক্যমতে আসতে পারিনি।”
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ কমিশনগুলোকে দলীয়করণ করা হয়েছে। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আজকের রাজনৈতিক দলগুলো এই কমিশনগুলোর বিদ্যমান আইন নিয়ে বিরোধিতা করেছিল। এই আইনগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। এসব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের কাজ করবে বলে বলেছিল।
“কিন্তু আজকের আলোচনায় সেই দলগুলোর কাছ থেকে কোন বিকল্প প্রস্তাব পাইনি, তাই ঐকমত্য হয়নি। কিছু দল আগে এনসিসির বিষয়ে মতামত দিলেও আজকে বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু কেন বিরোধিতা করেছেন তার ব্যাখ্যাও দেননি।”
সংস্কার নিয়েও ‘সংশয়’ নাহিদের
তিনি বলেন, “সার্বিকভাবে আজকের দিনটা আমাদের জন্য হতাশার। আশা করেছিলাম এনসিসির বিষয়ে একটা নীতিগত সিদ্ধান্তে আসতে পারবো, কিন্তু সেটা হয়নি। যারা বিরোধিতা করেছেন, তারা যেন একটা প্রস্তাব দেয়। না হলে এই যে গণঅভ্যুত্থান, সংস্কার এগুলো ব্যর্থ হবে।
“এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আগের নিয়মেই চলবে, সেই ধরনের শঙ্কা সংশয় তৈরি হয়েছে, আজকের আলোচনার পরে।”
যা বললেন আলী রীয়াজ
এদিন বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে এনসিসি নিয়ে বড় ধরনের অগ্রগতি হবে’ বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।
তিনি বলেছেন, “আজকে আমরা আলোচনার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেছি যে, প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল যেটি সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও জেলা সমন্বয়ন কাউন্সিল।
‘‘এগুলো নিয়ে আজকে আলোচনা করব। আমরা আশা করছি যে, এসব আলোচনায় আমরা বড়রকমের অগ্রগতি অর্জন করতে পারব।”
বৈঠক শেষে বিকালে সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধানের দায়িত্ব পালন করা আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, “আজকে আমাদের বড় অর্জন হল, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান জেনেছি, পারস্পরিক আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নিয়ে দলগুলো আগ্রহ দেখিয়েছে।
“সংবিধান সংস্কার কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নাম প্রস্তাব করেছিল। কেউ কেউ এই নাম পরিবর্তনের কথা বলেছে। আমরা বলেছি লক্ষ অর্জনের জন্য নাম পরিবর্তন কোনো বিষয় না। আলোচনাটি খানিকটা অগ্রগতি হয়েছে। এই আলোচনাটি আগামী সপ্তাহে পর্যন্ত আমরা রাখবো।”
সংলাপের দ্বিতীয় দিনে জামায়াতের বয়কট ও বুধবার দুটি দলের বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “যে কোনো আলোচনায় সৌহার্দ্যপূর্ণ থাকবে ও ভিন্ন মত থাকবে। এতগুলো রাজনৈতিক দল, ক্ষোভ বিক্ষোভ থাকবেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সকল রাজনৈতিক দল সহযোগিতা করছে।”
গণফোরাম বলছে এনসিসি হবে ‘স্বৈরতান্ত্রিক’
গণ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান এনসিসির বিষয়ে জোরালো বিরোধিতা করে বলেন, “এই যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে প্রস্তাবনাগুলো আমাদের কাছে দিয়েছিল, আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে সকল বিষয়ে দলীয়ভাবে আলোচনা করে মতামত দিয়েছি। এখন যে আলোচনাগুলো করছে, সবচেয়ে বড় বিষয় জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল-এনসিসি যেটা করতে চাচ্ছে, এইটার ব্যাপারে, সরকার যেটা ঘোষণা করেছিল সেটা আলোচ্য বিষয়ে নাই।”
তিনি বলেন, “এখানে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের সরকারের তিনটি অঙ্গ রয়েছে, একটা বিচার বিভাগ একটা নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভা। এই তিনটিকে একত্রিত করে যদি এনসিসি গঠন করা হয় তাহলে যে সরকার হবে তা সরকারের উপরে আরেকটি সরকার হবে।”
মিজানুর রহমান বলেন, “আমি বলেছি, আগে রাজা নিজে আইন করতেন, সেই আইনে রাজা বিচার করতেন। আজকে যদি সরকারের বাইরে এই ধরনের এনসিসি গঠন করা হয়, তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে যদি সংক্ষুব্ধ হই তাহলে বিচার পাব না। কারণ হলো সেখানে প্রধান বিচারপতি স্বাক্ষর করবে।
“এখানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার কথা বলা হয়েছে, যেখানে জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকবেন, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেতা থাকবেন, ফলে এটা একটি স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার একটি অপচেষ্টা করা হবে-এটা আমরা বলেছি। এই কারণে এই গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে যা বলেছিল তাতে আমরা অংশগ্রহণ করি নাই।
“কোন জনসাধারণ সংক্ষুব্ধ হলে সে যাবে আদালতে, কিন্তু যেখানে প্রধান বিচারপতি স্বাক্ষর করবেন সেখানে আদালতেও যেতে পারবেন না।”
ঐকমত্য নিয়ে বাসদের ‘দ্বিধা’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “এখানে ঐকমত্য কমিশন, কেউ কেউ বলেছিল ঐকমত্য হবে কিনা, যেখানে সবাই মিলে ঐকমত্য হবে সেইটাই হবে ঐকমত্য কমিশনে। যেটা হবে না, সেটা বাদ থাকবে, তার ভিত্তিতে আমরা আলোচনায় বসেছি।
“প্রধান উপদেষ্টা ৫ অক্টোবর আমাদেরকে বলেছিলেন, তখন বলেছিলাম এতগুলো সংস্কার কমিশন করছেন এখানে সবাই মত দিবে? কীভাবে গ্রহণ করবেন।
“তখন তারা বলেছিল, প্রত্যেকটা দল যে সব বিষয়ে মত দিবে তা গ্রহণ করবো আর যেটা কাছাকাছি আছে সেটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করে ঐকমত্যের চেষ্টা করবো, যেগুলো নীতিগত বিরোধ থাকবে সেগুলো সরিয়ে রাখবো।”
যা বলছে সিপিবি
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “আমরা আমূল পরিবর্তন চাই। কিন্তু ইচ্ছা করলেই আমরা তো আমূল পরিবর্তন করতে পারবো না। এটা করতে হলে, জনগণের মেন্ডেট নিয়ে করতে হবে। সাংবিধানিক কাউন্সিলসহ যে ত্রুটির মধ্য দিয়ে একক কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা গড়ে উঠে, আমরা বলেছি সেটা ভাঙার জন্য। আর সেই সংস্কারের প্রধান ধাপ হবে একটা সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য সংসদ।
“এখন এনসিসি নিয়ে নীতিগতভাবে আমাদের দ্বিমত নাই, কিন্তু এই মুহূর্তে যে কারণে বলা হচ্ছে সেটার (এনসিসির) প্রয়োজন দেখছি না।”