Published : 30 Apr 2024, 05:56 PM
নব্বই দশক পরবর্তী সময়ে দেশের নগরীগুলোতে ‘অপরিকল্পিত, মানববিচ্ছিন্ন ও পরিবেশ বৈরী’ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দ্রুত নগরায়নের ধারা গড়ে উঠেছে বলে মনে করে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’।
দেশজুড়ে চলমান তাপপ্রবাহ সেই ‘অপরিকল্পিত নগরায়নেরই ফল’ মন্তব্য করে সংগঠনটির সহ-সভাপতি ইকবাল হাবিব বলেছেন, “তাপদাহ অনুভবের তীব্রতা বৃদ্ধির অন্যতম মূল কারণ হল ‘ভুল নগরদর্শন’। বাংলাদেশে বনজ সম্পদ ও বনভূমির অবক্ষয় ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর ল্যান্ডসেট স্যাটেলাইট বিশ্লেষণী গবেষণা অনুযায়ী গত ২৮ বছরে শুধু ঢাকা থেকেই প্রায় ৮৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি এই সময়ে নির্মাণ এলাকা বা স্থাপনা বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ সবুজ গাছপালা এবং জলাশয় ধ্বংস করে কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে।
এভাবে গড়ে ওঠায় এ মহানগরীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ‘সাংঘাতিকভাবে বিপর্যস্ত’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এ স্থপতি।
মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন ইকবাল হাবিব। দেশের বেশিরভাগ এলাকায় এপ্রিল মাসজুড়ে চলা তাপপ্রবাহের মধ্যে ‘তাপপ্রবাহের তীব্রতা, দায় কার, করণীয় কী’ শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
লিখিত বক্তব্যে ইকবাল হাবিব বলেন, “নগরের এই তাপদাহ আসলে অনুভবের বিষয়। বর্তমানে নগরীগুলোতে তাপমাত্রা অনুভবের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির চেয়ে অনুভবের মাত্রা বেড়েছে। কারণ পরিবেশ ও প্রতিবেশের সাথে সহনশীল ও সহাবস্থানের মানসিকতার প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণও তীব্রভাবে বেড়েছে।
“পাশাপাশি, ধনী-দরিদ্র বা সামর্থ্যবান-অসামর্থ্যবানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের তীব্রতার প্রতিফলনই হচ্ছে এই অনুভবের প্রখরতা বৃদ্ধি। ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। আর প্রকারান্তরে এভাবেই অর্ধবিকলাঙ্গ একটি প্রজন্ম তৈরির যন্ত্রে পরিণত হয়েছে আমাদের নগর ও নগরায়ন।”
জাতিসংঘের হিসাবে গত এক দশকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গড়ে প্রায় ১.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ বরাবরই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকির তালিকায় অন্যতম। পাশাপাশি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এল নিনোর প্রভাব বাংলাদেশে চরমভাবাপন্ন পরিবেশ ও আবহাওয়ার সৃষ্টি করছে। ফলে ঋতু পরিবর্তনে অসঙ্গতি দেখা দিচ্ছে।
“এছাড়া নদীর ওপর বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং নদী শাসন ও খনন ব্যবস্থাপনার অভাবে নদীমাতৃক এই দেশের নদীগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। এভাবে উত্তপ্ততার পরিধি বাড়ছে, তারপর মাত্রা সীমাহীন না হলেও তীব্র দাবদাহ অনুভূত হচ্ছে।”
দেশে বনজ সম্পদের ক্ষয় যে ক্রমশ বাড়ছে, সে কথা তুলে ধরে ইকবাল হাবিব বলেন, এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বহুগুণ বাড়ছে। ভূখণ্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য হলেও বাংলাদেশের বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে বন আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির ১২.৮ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসেবে, বাংলাদেশে বার্ষিক ২.৬ শতাংশ হারে বন উজাড় হয়েছে। গত ১৭ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে।
দেশের নগরীগুলোতে পারস্পরিক দূরত্ব না মেনে ভবন নির্মাণ করায় বাতাস চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে বলেও পর্যবেক্ষণ দেন এ স্থপতি।
ইকবাল হাবিব বলেন, “বাতাসের প্রবাহধারা নিশ্চিত করার যে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা ছিল তা কোনভাবেই বাস্তবায়ন করা যায়নি। ঢাকার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে 'ইমারত নির্মাণ বিধিমালা'র অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবর্তন কিংবা তার ব্যত্যয় করে অননুমোদিত ভবন নির্মাণ চলমান অবস্থাকে আরো দুর্বিষহ করেছে।
“ঢাকায় অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা ৯৪ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে অনুমোদন নেওয়ার পর আইন লঙ্ঘনকারীরাও রয়েছেন। ফলে বাতাসের আনুভূমিক চলাচল সড়ক করিডোরের বাইরে নেই বললেই চলে। এভাবে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য নগরীগুলোর বিভিন্ন এলাকা ‘উত্তপ্ত দ্বীপের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তাপীয় দ্বীপ বা হিট আইল্যান্ড’ এ রূপান্তরিত হয়েছে।”
আট দাবি বাপার
>> বন ও বনভূমি সুরক্ষায় জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আইনভঙ্গকারীদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা।
>> সিটি করপোরেশন ও সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন নিবৃত করা। 'নগর বন' সৃষ্টির ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা।
>> পুকুর, খাল ও অন্যান্য জলাশয় পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করে নদীর সঙ্গে সেগুলোর সংযোগ স্থাপনের আশু উদ্যোগ নেওয়া।
>> সমীক্ষানির্ভর নীতিমালা প্রণয়ন, প্রণোদনা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সাম্যতার ভিত্তিতে নগরদর্শন নিশ্চিত করা। ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করা।
>> শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সচেতনতা বাড়ানো ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়া।
>> অবিলম্বে ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় যথাযথ শুদ্ধিকরণের উদ্যোগ প্রয়োজন।
>> অনুপোযোগী বাহন চলাচল, নির্মাণ কার্যক্রম ও মালামালের পরিবহনজনিত দূষণ, ইটভাটার দূষণ, ময়লার ভাগাড়, কারখানার ধোঁয়াসহ অন্যান্য বায়ু দূষণকারী কার্যক্রম রোধে পদক্ষেপ নেওয়া।
>> অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্য সবুজায়ন নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। সেই আলোকে দেশব্যাপী সুপরিকল্পিত নগর সবুজায়ন নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া।
বাপার সভাপতি নূর মোহাম্মদ তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মিহির লাল সাহা, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।