Published : 09 May 2025, 11:37 PM
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সুবিধা পাওয়া পদ্মা ব্যাংকের বিরুদ্ধে সুদ-আসল মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের ৮৭৪ কোটি টাকা আটকে রাখার যে অভিযোগ উঠেছে তা খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমানতও আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে আলোচিত এই ব্যাংকটির বিরুদ্ধে।
গত ৫ মার্চ অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক, যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সংস্থার উপসহকারী পরিচালক জাকির হোসেনকে।
দুদকের উপপরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে অনুসন্ধান শুরুর তথ্য দিলেও এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারেননি।
পদ্মা ও ফারর্মাস দুই ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের আমলেই নানা ঋণ অনিয়মে ধুঁকছে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকটি। ২০১৪ সালে সাবেক মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের মালিকানায় যাত্রা করা ব্যাংকটির জলবায়ু তহবিলের অর্থ ফেরত দেওয়া নিয়ে আলোচনা অনেক দিনের।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে আর্থিক খাতের অনিয়মে বারবার আলোচনায় আসা চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের সময় ২০০২ সালে জলবায়ু তহবিলের এই অর্থ ফেরত দিতে ২০৩৮ সাল পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়।
তবে তার আগেই আদায় করে এই অর্থ কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
একই সঙ্গে শুধু ধুঁকতে থাকা পদ্মা ব্যাংক নয়, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার আটকে থাকা অর্থ আদায়ে পথনকশা করার সিদ্ধান্তও হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে পদ্মা ব্যাংকে জলবায়ু তহবিলের টাকা আটকে রাখার অভিযোগ অনুসন্ধানে নামল দুদক।
সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে, এ বিষয়ে পদ্মা ব্যাংকের কাছে প্রয়োজনীয় নথিপত্র চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চাওয়া হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের ব্যাংক হিসাব খোলার ফর্ম, গ্রাহক পরিচিতির (কেওয়াইসি) তথ্য, হিসাব পরিচালনাকারীদের তালিকা, সিগনেচার কার্ড, চেক বইয়ের বিবরণী ও হিসাব সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নথি।
এছাড়া স্থায়ী আমানত-এফডিআর হিসাবের বছরে বছরে পরিশোধ করা সুদের পরিমাণ, বর্তমানে বকেয়া থাকা সুদ ও আসলের প্রকৃত অঙ্ক, ট্রাস্ট ফান্ড ও পদ্মা ব্যাংক উভয়ের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া এফডিআর নগদায়নের আবেদনপত্র এবং সংশ্লিষ্ট সকল নথির সত্যায়িত কপি চাওয়া হয়েছে।
এক বছর মেয়াদি স্থায়ী আমানতে সর্বোচ্চ সুদ দেওয়ার প্রস্তাব পেয়ে ২০১৫ সালে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের ৫০৮ কোটি ১৩ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা জমা রাখা হয়।
অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে। সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
পরের বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন নাফিজ সরাফাত; পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম হয় পদ্মা ব্যাংক।
আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না পদ্মা ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকটিতে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো মূলধন জোগান দেয়। মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য বেশকিছু নীতিছাড়ও দেওয়া হয়।
তবুও নাফিজ সরাফতের সময়ে ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বরং খেলাপি ঋণ আরও বাড়ে। সব আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না।
পদ্মা ব্যাংকের দুর্দশা নিয়ে আলোচনার মধ্যে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন নাফিজ সরাফাত।
কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই জলবায়ু তহবিলের টাকা ফেরত পায়নি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সুদসহ আটকে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৭৪ কোটি টাকায়।
শুধু জলবায়ু তহবিল নয়, ধুঁকতে থাকা পদ্মা ব্যাংকে আরও অনেক সরকারি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। বিষয়টি গত বছর ১৩ সেপ্টেম্বরে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকেও ওঠে।
ওই বৈঠক শেষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, “আমার মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড বলে একটি ফান্ড রয়েছে। সেখানে ৩ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা সরকার দিয়েছিল। এরমধ্যে ৫৯৭ কোটি ৬২ লাখ ৫২ হাজার ২৫২ টাকা বিগত সরকার সাবেক ফারমার্স বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকে এফডিআর করে রেখেছিল।
“ওই ব্যাংকে যে টাকাটা রাখা হয়েছিল তা সুদে আসলে বেড়ে পাওনা হয়েছে ৮৭৩ কোটি ৮১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৩ টাকা। এই টাকাটা বার বার চাওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকটি দিতে পারছে না।
“তারা সরকারের সাথে কোনো আলোচনা না করেই নিজেরাই বছর বছর এই এফডিআরটা নবায়ন করছে। তাদের এখন বক্তব্য হচ্ছে ২০৩৮ সালের আগে এই টাকাটা আমাদেরকে দিতে পারবে না; না সুদ, না আসল।”
এরকম সমস্যা শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয়সহ আরও অনেক জায়গায় থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেগুলো কী বিবেচনায় রাখা হয়েছে আমরা তো বলতে পারছি না।
“এ বিষয়টি আমরা উপদেষ্টা পরিষদে তুলেছিলাম। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নিয়ে এবং যেসব মন্ত্রণালয় বা সরকারি সংস্থার অর্থ আটকে রয়েছে তাদের সাথে একসাথে বসে একটা রোডম্যাপ তৈরি করে দেবে, যাতে পাবলিক মানিটা ফেরত আসে। সরকারি কাজে লাগানো যায়।”
কতদিনের মধ্যে অর্থ আদায় করা হবে জানতে চাইলে এই উপদেষ্টা বলেন, “কবে পাওয়া যাবে জানলে তো আমরা খুবই খুশি হতাম আমরা তো সেটাই জানতে পারছি না।”
তবে ব্যাংকগুলোর বাস্তব অবস্থা বিবেচনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “তারা কত সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে পারবে। আমাদের ২০৩৮ এর আগে কত আগে কত অনুপাতে ফেরত আনা যাবে সেটা সেটা রোডম্যাপটা করা হলে বলা যাবে।”
জলবায়ু তহবিলের টাকা আটকে রাখার অভিযোগের বিষয়ে পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজী মো. তালহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। তারা আমাদের ব্যাংকে ডিপোজিট রেখেছেন। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকের তারল্য সংকট থাকায় আমরা তাদের অর্থ ফেরত দিতে পারছি না। তবে তাদের আমানতের রিনিউয়াল আমরা নিয়মিত করছি।”
তিনি বলেন, “তারা মূলত ৫০০ কোটি টাকা রেখেছিল। এখন সুদসহ সেই পরিমাণ বেড়ে ৯০০ কোটি টাকারও বেশি হয়েছে।”
তালহা বলেন, “২০১৫-১৬ সালে যখন আমানত নেওয়া হয়েছিল, তখন থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিত সুদ পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু ২০১৮ সালের পর ব্যাংক আর্থিক সংকটে পড়ায় এরপর থেকে অর্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়নি।”
দুদকের নথিপত্র সংগ্রহের বিষয়ে কাজ চলছে দ্রুতই তা দুদকে পাঠানো হবে বলেছেন তিনি।
পুরনো খবর:
পদ্মা ব্যাংকে জলবায়ু তহবিলের টাকা: ২০৩৮ নয়, আগেই ফেরতের পদক্ষেপ