Published : 21 Jun 2025, 10:04 PM
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিকে যুক্ত করার পদক্ষেপ, রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোরের উদ্যোগ, স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধচক্রে’ জড়ানোর চেষ্টা বন্ধের দাবিতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ করবে ‘সাম্রাজবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম।
আগামী ২৭ ও ২৮ জুন দুই দিনের এ রোডমার্চ কর্মসূচি শনিবার রাজধানীতে ঘোষণা করা হয়েছে।
নতুন গঠিত এ প্ল্যাটফর্মের পক্ষে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সংবাদ সম্মেলনে ২৭ জুন সকাল ৯টায় ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে রোডমার্চ শুরুর ঘোষণা দেন।
পল্টনের মুক্তিভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, লং মার্চের উদ্বোধনী সমাবেশের পর নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে পথসভা ও মিছিল শেষে কুমিল্লায় প্রথম দিনের সমাপনী সমাবেশ হবে এবং ফেনীতে রাত্রিযাপন করা হবে।
রোডমার্চের দ্বিতীয় দিন ২৮ জুন সকালে ফেনী থেকে যাত্রা শুরু করে মিরসরাই, সীতাকুণ্ডে পথসভা ও মিছিল শেষে চট্টগ্রাম বন্দরের সামনে সমাপনী সমাবেশ হবে।
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের একটি টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার কাজ বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার উদ্যোগের বিরোধিতাসহ রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর চালুর প্রতিবাদে এ রোর্ডমার্চ আয়োজনে ‘সাম্রাজবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণ’ নামের এ প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হয়েছে বলে জানান প্রিন্স।
তিনি বলেন, “এটা এই রোডমার্চের প্ল্যাটফর্ম। স্থায়ী কোনো প্ল্যাটফর্ম নয়। আজ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে জানান দেওয়া হল।”
বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টিসহ অনেক দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ প্ল্যাটফর্ম ও রোডমার্চের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে বলে তুলে ধরেন তিনি।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, "সরকার যদি আমাদের দাবিগুলো মেনে নেয়। দেশবিরোধী চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসে। তখন এই রোডমার্চও আমরা করব না। আর যদি দেশবিরোধী কোনো চিন্তা করা হয়, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক সকল জনগণকে সঙ্গে নিয়েই আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।
"জাতীয় সম্পদ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশপ্রেমিক সকল জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালিয়ে যাব। মা মাটি মোহনা বিদেশিদের হাতে দেব না।"
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে প্রিন্স বলেন, "গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর দেশে যে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার ওই পথে না হেঁটে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে রাখাইনে করিডোর ও লাভজনক চট্টগ্রামের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের লিজ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এর ফলে গণতন্ত্রে উত্তরণের সম্ভাবনায় নানা সংকট তৈরি হচ্ছে ও নানা দেশি-বিদেশি অপশক্তি ওই সম্ভাবনাকে বেহাত করার প্রচেষ্টা নিচ্ছে।"
বন্দরকে আরও লাভজনক করতে জাতীয় সক্ষমতা না বাড়িয়ে বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়া আত্মঘাতী হবে বলে দাবি করেন তিনি।
প্রিন্স বলেন, "বন্দরের মত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদের উপর বিদেশি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। বিদেশিদের নিয়োগের ফলে দেশীয় কর্মসংস্থান কমবে,শ্রমিকরা বেকার হবে।"
বন্দরে মাফিয়াচক্র তৈরি হয়েছে অভিযোগ করে প্রিন্স বলেন, "আমরা বন্দরের মাফিয়াতন্ত্র উচ্ছেদ করে দুর্নীতিমুক্ত অবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানাই। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাই। দেশি-বিদেশি বেসরকারি কোম্পানিকে ইজারা না দিয়ে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই বন্দর পরিচালনা করাই যথাযথ।
”বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলে এ ধরনের বেসরকারিকরণ ব্যয়বৃদ্ধিসহ আর্থিক ঝুঁকি ও দায় বৃদ্ধি করবে। আর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকেই এর খেসারত দিতে হবে।"
মানবিক করিডোর বিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকে ভাষ্য, "সরকার মিয়ানমারের রাখাইনে কথিত মানবিক করিডোর বা ত্রাণ চ্যানেল দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো এই করিডোর দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে। কিন্তু মানবিক করিডোরের কথা বলা হলেও তা মার্কিনের 'চীন ঘেরাও' নীতির স্বার্থে যে ব্যবহৃত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিকভাবে আক্রান্ত হবে।"
তার অভিযোগ, "বাংলাদেশকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করবে। ভারত-চীন-পাকিস্তানসহ নানা শক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে রাখাইন করিডোর বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে।"
সেন্ট মাটিন দ্বীপ নিয়েও সরকারের পদক্ষেপ ‘সন্দেহজনক’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরকার মার্কিন স্যাটেলাইট কোম্পানি স্টারলিংককে এদেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানের অনুমতি দিয়েছে এবং ইতোমধ্যে তা চালু হয়েছে। সরকারের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি বলেও সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়।
প্রিন্স বলেন, "এই মার্কিন কোম্পানি শুধু নিরীহ ইন্টারনেট সেবাই প্রদান করে না, সেই সাথে দেশে দেশে সামরিক ও রাজনৈতিক নজরদারি চালায়। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে, ফিলিস্তিন-ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা-ইসরাইলের পক্ষে তথ্য প্রযুক্তিগত অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে এই ইন্টারনেট কোম্পানি।"
সামরিক শিল্পের মত স্পর্শকাতর খাতে তুরস্ক ও কাতারকে অস্ত্র তৈরির কারখানা নির্মাণের আহ্বানের সমালোচনাও করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন কেন্দ্রীয় পাঠচক্র ফোরামের সদস্য বেলাল চৌধুরী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক হারুনার রশিদ ভূঁইয়া, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিক ঐক্যের আহ্বায়ক মফিজুর রহমান লাল্টু, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ।