Published : 27 Aug 2024, 10:41 PM
জনগণের অংশগ্রহণে গণশুনানির মাধ্যমে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ জ্বালানির দাম বাড়ানো বা কমানোর ক্ষমতা প্রায় দেড় বছর পর অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলো।
মঙ্গলবার আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক গেজেটে অধ্যাদেশ জারির কথা জানিয়ে আইনের ৩৪ (ক) ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে। ওই ধারা বলে সরকার নির্বাহী আদেশে যখন ইচ্ছা জ্বালানির দাম নির্ধারণ করতে পারত।
ধারাটি বাতিল হওয়ায় কমিশন গঠনের যে উদ্দেশ্য ছিল, জনগণের হাতে যে ক্ষমতা ছিল; তা আবার পুরোপুরি কার্যকর হলো বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
গণশুনানি করে জ্বালানির দাম নির্ধারণে ৯০ দিনের সীমাকে দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘প্রতিবন্ধকতা’ হিসেবে চিহ্নিত করে ২০২৩ সালের শুরুতে ক্ষমতাটি সরকার নিজের হাতে নিয়েছিল।
গত বছরের ২৯ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) বিল’ সংসদে পাস করায় আওয়ামী লীগ সরকার। মঙ্গলবার অধ্যাদেশের গেজেট জারি করে সেই আইন সংশোধন করা হলো, ক্ষমতা ফিরে গেল বিইআরসির কাছে।
গেজেট অনুযায়ী, আগের আইনটি এখন থেকে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৪’ নামে বর্ণিত হবে।
আইনের ৩৪-এর ‘ক’ ধারা অনুযায়ী, ট্যারিফ নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ বা সমন্বয়ের ক্ষমতা গিয়েছিল সরকারের হাতে। তবে এটি বিলুপ্ত করায় এখন থেকে আগের মতোই গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে বিইআরসি আইন সংশোধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়, পাস হয় সংশোধিত অধ্যাদেশের খসড়া।
আইনটি সংশোধন হওয়ার বিষয়ে মঙ্গলবার বিইআরসির সচিব (যুগ্মসচিব) মো. খলিলুর রহমান খানের কাছে জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এতে করে যে কারণে রেগুলেটরি কমিশন গঠন করা হয়েছে, তা পুরোপুরি কার্যকর হবে। দাম নির্ধারণে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকবে। জনগণের ক্ষমতা আবার জনগণের কাছে ফেরত এলো।”
জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে সব পর্যায়ের ভোক্তা এবং অংশীজনের সমন্বয়ে এখন থেকে শুনানি হবে বলে জানিয়ে খলিলুর রহমান বলেন, শুনানিতে তাদের পরামর্শ, মতামত, অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্যাস-বিদ্যুৎতের দাম নির্ধারণ করা হবে।
“আগে এই কার্যক্রম শেষ করতে ৯০ দিন সময় লাগত, পরে যা কমিয়ে ৬০ দিন করা হয়েছির। সেটিকে আমরা ৩০ দিন বা আরও কম সময়ের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করব।”
এর আগে ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর গণশুনানি ছাড়াই বিশেষ পরিস্থিতিতে সরাসরি জ্বালানির দাম সমন্বয় করার বিধান করে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩’ সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল।
২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর গণশুনানি ছাড়াই জ্বালানির দাম সমন্বয়ের বিধান রেখে আইন সংশোধনের অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
তখন বলা হয়েছিল, জ্বালানির দাম নির্ধারণে বিইআরসিকে গণশুনানি করতে হয়। এই প্রক্রিয়া শেষ করে সিদ্ধান্ত নিতে ৯০ দিন সময় লাগে। তাই দ্রুত বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি বা হ্রাসের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকা উচিত।
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের প্রায় সাত সপ্তাহ পর বিরোধী সংসদ সদস্যদের তীব্র সমালোচনার মুখেই জাতীয় সংসদে পাস হয় 'বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) বিল।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল শেখ হাসিনার হাতে, আর তার প্রতিমন্ত্রী ছিলেন নসরুল আহমেদ বিপু।
বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে একে ‘কালো আইন’ বলে বর্ণনা করেছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য গণফোরামের মোকাব্বির খান। তিনি বলেছিলেন, বিদ্যুতের দুরবস্থার কারণ লুটপাট আর দুর্নীতি।
তখনকার সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্য ফখরুল ইমাম বলেছিলেন, পানির ট্যাংঙে নিচে ফুটো থাকলে কখনোই তা পূর্ণ করা যাবে না।
আইনটি নিয়ে সমালোচনা করে আসছিলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও। তবে শেখ হাসিনা সরকার সংশোধিত আইনের আলোকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায় করতে থাকে।
গণশুনানি না করেই আওয়ামী লীগ সরকার শিল্প-বাণিজ্যে গ্যাসের দাম বাড়ায় দুই বার; ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত।
গত বছরের জানুযারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে শুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গেছে শেখ হাসিনা সরকার। এই সময়ে পাইকারি পর্যায়েও (বাল্ক) বিদ্যুতের দাম তিনবার বাড়িয়ে গেছে তারা।
নির্বাহী আদেশ জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির এই ধারায় চলতি বছরের মার্চে এসে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, মাসে মাসে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম মূল্যায়ন করা হবে, অর্থাৎ নির্ধারণ করা হবে। এভাবেই চলে এসেছে জুলাই পর্যন্ত।
গত ৫ অগাস্ট তীব্র গণআন্দোলন ও জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বদলে যায় দৃশ্যপট, নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব গঠন হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
গত ৮ অগাস্ট শপথ নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের ধারায় মঙ্গলবার তাদের হাত পড়ে বিইআরসিতে, সংশোধন হলো সেই আইন।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গত ১৮ আগস্ট সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে আবারও বিইআরসি আয়োজিত গণশুনানির মাধ্যমে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হবে।
তিনি বলেছিলেন, “বারবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। তাই দুর্ভোগ বাড়বে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। বাধ্য না হলে আমরা দাম বাড়াব না। প্রয়োজনে কমিশন সবার সঙ্গে কথা বলে নীতিমালা অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত নেবে।”