Published : 26 Jun 2024, 01:39 AM
যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনুদ্দীন মামলা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ ও হত্যাশা প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম-আইসিএসএফ।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ ও ন্যায় বিচারের পক্ষে কাজ করা আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত সংগঠনটি বলেছে, যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্ত গণহত্যার দায়ে চিহ্নিত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার মাধ্যমে তাদের ভোগ করা দায়মুক্তি অবসানের জন্য বাংলাদেশ এবং এর জনগণের কয়েক দশকের প্রচেষ্টাকে অবমূল্যায়ন করেছে।
একই সঙ্গে বিষয়টি অপরাধীদের হাতে গণহত্যার শিকার হয়ে জীবন দেওয়া এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল বলে মনে করছে সংগঠনটি।
আইসিএসএফ মনে করছে, একাত্তরের ঘাতক মুঈনুদ্দীনকে আইনি লড়াইয়ের সুযোগ দেওয়ার ঘটনা বিদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ন্যায় বিচার পাওয়া ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশ্বে যুক্তরাজ্যের বিচার বিভাগের অঙ্গীকার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৩ সালে মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় জন শিক্ষক, ছয় জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয় জামায়াতে ইসলামীর বদরবাহিনীর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে।
জামায়াতে ইসলামী তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পলাতক এ দুই কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে মুঈনুদ্দীন এখন যুক্তরাজ্যে এবং আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে আছেন।
এর ছয় বছর পর ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিশন ফর কাউন্টারিং এক্সট্রিমিজমের তৈরি ‘চ্যালেঞ্জিং হেইটফুল এক্সট্রিমিজম’ বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনের পাদটীকায় বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মুঈনুদ্দীনের দণ্ডিত হওয়া এবং একাত্তরে তার যুদ্ধাপরাধের বিবরণ তুলে ধরা হয়। তার নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনাও সেখানে যুক্ত করা হয়।
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টুইটার (বর্তমান এক্স) হ্যান্ডেল থেকে প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশ করা হয়। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল, বিবিসির সাংবাদিক মিশাল হুসেইন, মানবাধিকার কর্মী পিটার ট্যাটচেলসহ অনেকেই তা রিটুইট করেন।
এর প্রতিবাদ জানিয়ে অনলাইন থেকে প্রতিবেদনটি তুলে নেওয়ার দাবি তুলে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীন। তবে তাতে সাড়া দেয়নি ব্রিটিশ সরকার।
এরপর ২০২০ সালের ১৯ জুন মামলা করেন মুঈনুদ্দীন। ওই প্রতিবেদন প্রকাশ্যে এনে যুক্তরাজ্যের ডেটা সংরক্ষণ নীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং তাতে ব্যক্তিগত সুনাম ক্ষণ্ণ ও মানহানি হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন একাত্তরের এই আল-বদর নেতা। সেখানে ৬০ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়।
২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানি হয়। সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন আমলে নেওয়া হয়। মুঈনুদ্দীনের নামের সঙ্গে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়, যেমন যুদ্ধপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধী; একাত্তরের ঘাতক- তখন সেগুলো বাতিল করতে কোনো আদেশ দেয়নি হাই কোর্ট।
৬০ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলার শুনানিতে প্রীতি প্যাটেলের পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তি দেখায়, মুঈনুদ্দীনের অভিযোগের বিচার এগিয়ে নেওয়া হলে তা হবে যুক্তরাজ্যের ‘আদালতের কার্যপ্রণালির অপব্যহার’। সেই যুক্তি আমলে নিয়ে ওই বছরের ১৫ নভেম্বর হাই কোর্ট মামলাটি খারিজ করে দেয়।
মুঈনুদ্দীন তখন যান কোর্ট অব আপিলে। ২০২২ সালের ২৮ জুলাই সেখানেও তার আবেদন খারিজ হয়ে যায় এবং হাই কোর্টের সিদ্ধান্ত এবং পর্যবেক্ষণ বহাল থাকে।
এর বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি চেয়ে ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীন। ওই বছর নভেম্বরে এর শুনানি হয়।
চলতি বছর ২০ জুন ‘মুঈনুদ্দীন (বাদী) বনাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (বিবাদী)’ শিরোনামের রায়ে মুঈনুদ্দীনের মামলার বিচার চালিয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়।
এ রায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের নেটওয়ার্ক-আইসিএসএফ বলছে, “মুঈনুদ্দীনের অপরাধকে নিছক দেওয়ানি মামলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তবে তা মুঈনুদ্দীনের অপরাধের দায় বিষয়ে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) সিদ্ধান্ত বদলানোর ক্ষমতা রাখে না, যুক্তরাজ্যের আদালত থেকে তার অব্যাহতিও নির্দেশ করে না।
“এটি বেশ কয়েকটি আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সমস্যা তৈরি করতে পারে শুধু বিচারহীনতা ও ভিত্তিহীন দাবিকে যুক্তরাজ্যে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি। একই সঙ্গে আইসিটির রায়ের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে অনাকাঙ্ক্ষিত হিসেবে দেখা যায়, কারণ আইসিটির ওপর এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কর্তৃত্বও রাখে না তারা।”
‘প্রশ্নবিদ্ধ’ যুক্তরাজ্যের আদালত ও সরকার
বিবৃতিতে আইসিএসএফ বলছে, বাংলাদেশের আইসিটির আইন ও বিধান অনুযায়ী যে প্রক্রিয়ায় মুঈনুদ্দীনের বিচার হয়েছে, তার মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্ট। কারণ মুঈনুদ্দীনের আইনজীবীরা মামলাটি এমনভাবে সাজিয়েছেন, যাতে এর সত্যতা বুঝে ওঠা খুবই কঠিন হয়।
যুক্তরাজ্যে চলমান আদালতের প্রক্রিয়ার ওপর নিবিড় নজরদারি করা এবং বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের শিকার ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করার বছরের পর বছর ধরে চলা প্রক্রিয়া থেকে বিশেষজ্ঞরা যে তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করেছেন, তার ভিত্তিতে আইসিএসএফের বিশ্বাস, যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তটি ভুল পথে চালিত, ভ্রান্ত ও মিথ্যা তথ্যের ওপর নির্ভর করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে মুঈনুদ্দীনের দণ্ডিত হওয়ার কারণও ধরতে পারেনি তারা।
সংগঠনিটি বলেছে, এর আগেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আন্তর্জাতিক অপরাধের দায়ে হাজার হাজার অভিযুক্তকে আশ্রয় দেওয়ার ঘটনা নিয়ে মানবাধিকার গোষ্ঠীর সমালোচনার মুখে পড়ে যুক্তরাজ্য।
চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের আবেদনের বিষয়ে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের সবশেষ সিদ্ধান্তের ঘটনা বিশ্বের অপরাধীদের কাছে একটি ধারণা পোক্ত করবে যে, যুক্তরাজ্য তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়। শুধু তাই নয়, বিষয়টি বিদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের যুক্তরাজ্যে অভিবাসন পাওয়া ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে।
সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত নিজের পক্ষে আসার প্রতিক্রিয়ায় নিজেকে ‘নির্দোষ প্রমাণের ন্যায্য সুযোগ’ পেয়েছেন বলে মন্তব্য করেছিলেন যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীন।
বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছে আন্তর্জাতিক অপরাধ নিয়ে কাজ করা আইন বিশেষজ্ঞরা। বিবৃতিতে তারা বলেছেন, যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্তকে ‘রায় ছিনতাই’ বলা যায়। যেখানে একজন আন্তর্জাতিক অপরাধী এই ধারণা পেতে পারেন যে, অন্য দেশে অপরাধ করে দণ্ডিত হয়েও যুক্তরাজ্যে এসে তাদের বিচার ব্যবস্থা ব্যবহার করে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।
জেনোসাইড কনভেশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের আদালতের এমন সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অপরাধে দোষী সাব্যস্তদের বিচারের আওতায় আনতে এবং গণহত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতির ঘাটতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে মনে করে আইসিএসএফ।
এদিকে মুঈনুদ্দীনের মামলার বিষয়ে যুক্তরাজ্যে আইনি লড়াইয়ে যুক্ত না হওয়ার বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। একই সঙ্গে এই যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরাতে সরকারি উদ্যোগের ঘাটতি দেখছে তারা।
তবে আইসিএসএফ বলছে, যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের রায় হয়তো মুঈনুদ্দীনের বিচার কার্যকরে একটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তবে তা অপরাধকে আড়াল করতে পারবে না। ইতিহাসের একটি অন্ধকারতম অধ্যায়ে মুঈনুদ্দীনের কর্মকাণ্ডকেও ঢাকতে পারবে না।