Published : 19 May 2025, 09:59 PM
রাষ্ট্র সংস্কারে প্রস্তাবে গণভোট বা গণপরিষদ সামনে আনলে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।
দলটির নেতারা বলছেন, সংস্কারের বাস্তবায়ন নির্বাচিত সরকার করবে, এটা প্রস্তাবের প্রথমেই থাকা দরকার ছিল। কিন্তু নিয়ে আসা হয়েছে গণপরিষদ, সাংবিধানিক পরিষদ, গণভোট — এসব আলোচনাকে ‘প্রধান’ বানানো হলে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হবে না।
সোমবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
গত ১৩ মে মুলতবি হওয়া সংলাপ সোমবার বিকাল ৩টা থেকে আবার শুরু হয়। রুহিন হোসেন প্রিন্সের নেতৃত্বে দলটির ৭ সদস্য এতে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, আমাদের সামনে একটা প্রধান কাজ হচ্ছে সুষ্ঠূ, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচন করা। তার জন্য যা যা সংস্কার করা দরকার, সেগুলো সামনে নিয়ে আসা দরকার। কিন্তু আমাদের আলোচনায় আসে নাই। উনাদের লিখিত বইয়ের মধ্যে কিন্তু কিছুটা হলেও আছে। আমরা বলেছি একটু আলোচনায় আনেন।”
উদহারণ দিয়ে প্রিন্স বলেন, “ধরেন টাকার খেলা কীভাবে বন্ধ করা যাবে; নির্বাচনে পেশি শক্তির দাপট কীভাবে বন্ধ হবে? নির্বাচনের সাম্প্রদায়িক, আঞ্চলিক এবং অপপ্রচার বন্ধ কীভাবে হবে? প্রশাসনিক কারসাজি থাকবেই না, এ নিয়ে কী করা যায়? ভয়ের রাজত্ব থাকবে না; ভোটে দাঁড়ানো, ভোট দেওয়ার সম-অধিকার নিশ্চিত হবে। সেই আলোচনাগুলোর জন্য কী কী করা দরকার, সেইটা আলোচনায় আনেন।
“তাহলে জনগণ মনে করবে যে একটা ভালো নির্বাচন হবে। এর আগের সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। সেই আলোচনায় দেখবেন এই যে যে ১৬৬টা প্রশ্ন চোখের সামনে আসছে, তার মধ্যে কিন্তু নাই।”
প্রিন্স বলেন, “ওনারা যেভাবে প্রশ্ন (স্প্রেডশিটে) করেছেন, শুরুতেই একটা সংকট তৈরি করে ফেলেছেন। যদি ওনারা এটা বলতেন যে, আচ্ছা এটা আমাদের মত, এ ব্যাপারে আপনাদের একমত আছে কিনা, বা মত নেই, আংশিক মত। কীভাবে বাস্তবায়ন করব? প্রথমে কথাটা রাখা উচিত ছিল (সংস্কার) নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে। কিন্তু আপনি দেখবেন, ওই ধরনের কথাটা লেখা নাই।
“এমন এমন কথা নিয়ে আসা হয়েছে, গণপরিষদ, সাংবিধানিক পরিষদ, গণভোট। আমরা মনে করি, যেমন এই প্রশ্নগুলোতে আমরা আমাদের দ্বিমত পরিষ্কার করে বলেছি। তা আপনি যদি এই আলোচনাগুলোকে প্রধান হিসেবে আনেন, তাহলে তো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। ১০০টা পয়েন্টের মধ্যে ২০টা পয়েন্টে এতগুলো দল একমত। ৩০টা পয়েন্টে শতকরা ৮০ ভাগ বা ৯০ ভাগ দল একমত। আগামী সংসদ এইটা করবে। তাহলে কিন্তু আমাদের ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম পরিচালনা করা খুবই সহজ হতো।”
রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির বিষয় আলোচনার ঘোরতরভাবে বিরোধিতা করেছেন মন্তব্য করে প্রিন্স বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধ— এইটার জায়গায় ওনারা বলেছেন যে মামলা হলেই অযোগ্য। আমরা বলেছি, যে এইটা তো আইন পারমিট করবে না। এইখানে বলতে হবে অভিযুক্ত হলে।”
বিদেশি শক্তি সুযোগ- সুবিধা পেয়ে যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা দ্রুত হস্তান্তরের কাজটা করতে হবে। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে। কথা দিয়ে যদি কেউ কথা না রাখে, আমাদের ধারণা, আমরা কমিউনিস্ট পার্টি মনে করি, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মসহ দেশের মানুষের মধ্যে যে জাগরণ তৈরি হয়েছে, সেই জাগরণে কেউ যদি কথা না রাখে, জনগণের কাজ না করে, তাহলে কিন্তু তার বিরুদ্ধে জনগণ আরেকবার রুখে দাঁড়াবে। কিন্তু আমরা যদি নির্বাচনের কাজ ডিলে করি এবং এইখানে অনেকগুলো ইস্যু যদি চলে আসে, তখন দেখবেন বহু দেশি-বিদেশি অপশক্তি সুযোগ পেয়ে যাবে।”
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের কথাবার্তা সংকট তৈরি করছে মন্তব্য করে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক বলেন, “অনেক সময় দেখছি সরকার এবং অনেক জায়গায় অনেকের কথাবার্তার মধ্য দিয়েই নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। যেমন ধরুন সংস্কারের তো কোনো আলোচনার এজেন্ডাই ছিল না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাতের বেলায় সেটাকে কী বলে- ভেঙে দেওয়া হলো; আলোচনা না করে।”
তিনি বলেন, “করিডরের প্রশ্ন; বন্দরের প্রশ্ন; সংস্কার আলোচনায় তো এটা নাই। জনৈক ব্যক্তি, আমি নাম উচ্চারণ করতে চাই না, তিনি এমন এমন কথা নিয়ে এলেন যে, আমরা সংস্কার করেই যাব। সবকিছু আমাদের ম্যান্ডেট আছে।
“আমি বললাম যে, এখানে আপনারা সংস্কার আলোচনা করছেন, আর বাইরে যখন এ ধরনের আলোচনা হয়, তাহলে তো পুরো কাজকেই সংকটপূর্ণ করে তোলে। তাহলে এসব কাজ যাতে সংকটপূর্ণ না করে। তার জন্য আপনারাই তো সরকারের পার্ট। সরকারকে বলা উচিত। দ্রুততম সময়ে যাতে নির্বাচন হয়, তার সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করুক।”
করিডর এবং বন্দর নিয়ে সিপিবির অবস্থান জানতে চাইলে প্রিন্স বলেন, “আমাদের তো বন্দর বেশি নাই। এটা স্ট্র্যাটেজিক্যাল বিষয়। এইটা কোনোভাবে বেসরকারিকরণ করা উচিত না। বিদেশিকে দেওয়া তো উচিতই না।
“আমাদের যদি বন্দরের সক্ষমতায় ত্রুটি থাকে, আমরাই দূর করব। আর বন্দরটি সক্ষমতার থেকে বেশি কাজ করছে। …সুতরাং এই বন্দর দেওয়াটা আমাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর, রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর, আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর।”
করিডর এবং বন্দর ইস্যুতে সরকার পিছু না হটলে লং মার্চসহ প্রতিরোধ গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রিন্স বলেন, “করিডর, ওরা একটা চমৎকার শব্দ বের করছে- মানবিক করিডর। মানবিক করিডরের নামে জাতিসংঘের পরামর্শে এ ধরনের কাজ পৃথিবীর যে সমস্ত জায়গায় হয়েছে, সেটা হচ্ছে এই সাম্রাজ্যবাদী প্রক্সি ওয়ারের মধ্যে দেশকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
“আর আমাদের ভূরাজনৈতিক কারণে রাখাইনকে করিডর দেওয়ার মানে হলো, এই অঞ্চলে আধিপত্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নানা ধরনের আগ্রাসনের প্রচেষ্টা নেবে। সুতরাং এইটা আলোচনার মধ্যেই আনা উচিত না। আর এই সরকারের তো দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে না। সুতরাং এইটাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। পরিষ্কার বলেছি, সরকার এ ব্যাপারে কী করেছে, শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক এবং সেই কাজ থেকে বিরত থাকবে ঘোষণা দিক। ঘোষণা যদি না দেয়, আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলব।”
তিনি বলেন, “এই ঘটনাগুলো আমাদের দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে সংকটে ফেলে দিতে পারে। সুতরাং কোনোভাবেই এটা গ্রহণ করব না। সরকার যদি পিছু না হটে আমরা অতীতে যেটা করেছি, জনগণকে নিয়ে লং মার্চসহ প্রতিরোধ গড়ে তুলে এটা আমরা রক্ষা করব।”
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর একীভূত সুপারিশ চূড়ান্ত করার পাশাপাশি এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা তৈরিতে কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চেয়েছিল কমিশন। এরপর সে মতামত ধরে সংশ্লিষ্ট দলের সঙ্গে কমিশন সংলাপ করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু করে। ২০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সংলাপে ৩৩টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা হয়।