Published : 11 May 2025, 11:17 PM
নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে কেউ একমত না হতে পারেন, সুপারিশ নিয়ে তর্কও হতে পারে; কিন্তু নারীদের অপমান করার মত ‘ইসলামের নৈতিকতা বিরোধী’ কাজ কেন ধর্মভিত্তিক দলগুলো করছে, সেই প্রশ্ন রেখেছেন চিন্তক ও কলামনিস্ট ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেছেন, “নারীরা তো ধর্ম সংস্কার করতে বসেননি। আপনি তাদের… সব কথাতো শোনার দরকার নাই আপনার। আপনি বলেন এতে আমরা একমত হইনি। কিন্তু তারা কি বলবে, খুব ছোট্ট কথা তারা বলবে। তারা বলবে, পারিবারিক আইন আছে এটা থাকবে। তারা তো বলেনি পারিবারিক আইন সংস্কার করো। একবারও বলেনি।”
নারী সংস্কার কমিশন এবং কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউটে’ নিজের বিশ্লেষণ তুলে ধরেন ফরহাদ মজহার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা অন্তবর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে বিভিন্ন খাতে ১১টি সংস্কার কমিশন করেছে। এর মধ্যে গত ১৯ এপ্রিল নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়, সেখানে ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। এরপরই নারী কমিশন ও সুপারিশ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
ফরহাদ মজহার বলেন, “এ পর্যন্ত যতগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে, অধিকাংশ কমিশনের রিপোর্টই খুব বেশি ইতিবাচক নয়। কিন্তু সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি, কোনো সমস্যা নেই। আমরা বলব- এ সমস্ত সুপারিশের মধ্যে সত্যিকারের গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট নেই। একটা মাত্র (নারী) কমিশনের রিপোর্ট ছাড়া। আরেকটি আছে শুনেছি, সেটা হচ্ছে শ্রম কমিশন।
“নারী কমিশনতো বিতর্ক থাকবে। নারী কমিশন যেহেতু গণঅভ্যুত্থান, জনগণের অভিপ্রায়কে রিপ্রেজেন্ট করে, ফলে বিতর্কিত হবেই।”
সংস্কার কমিশন মোটা দাগে সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার- এ তিন বিষয়ে সুপারিশ করেছে, যেখানে সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অগ্রগতির জন্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জাতীয় সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশও এসেছে।
তবে দেশের ইসলামপন্থীদের অন্যতম প্ল্যাটফরম হেফাজতে ইসলাম নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে, জামায়াতে ইসলামীও কমিশনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইসলামি উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামি পারিবারিক আইন নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ কমিশন দিয়েছে, হেফাজতের আপত্তি মূলত সেই জায়গায়।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নারীর ব্যক্তি অধিকারের কথা সংস্কার কমিশন তুলে ধরেছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, “সে ব্যক্তি অধিকারের বলে, সে যদি মনে করে যে তার সম্পত্তির বণ্টনটা রাষ্ট্রের আইনের দ্বারা ঠিক হবে, তবে এটা খারাপ কি কথা বলেছে? খারাপ তো কথা কিছু বলেনি। আমি যদি মনে করি যে পারিবারিক আইনের মধ্যে সম্পদ বন্টন আমার চাই না; আমি ব্যক্তি, আমি একজন নাগরিক, আমি কি চাইতে পারি না রাষ্ট্রের কাছে? এটার মধ্যে কী বিরোধ আছে? তারা কি বলেছে যে শরীয়াহ আইন বদলাও? তারা কি বলছে কোরানকে নতুন করে ইন্টারপ্রেট কর? আমি তো দেখিনি, তাদের কোনো লেখায় পড়িনি, কোথাও নেই।”
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে পারিবারিক সম্পত্তিতে সমান অধিকার, অভিভাবক হিসেবে নারীর সমান অধিকারসহ বিভিন্ন সুপারিশ রয়েছে। এছাড়া নারীদের অধিকার রক্ষায় স্বতন্ত্র স্থায়ী নারী বিষয়ক কমিশন তৈরি করা; অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ সংশোধন করে সন্তানের ওপর নারীর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা; যৌনপেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা; শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা এসব সুপারিশও রয়েছে।
যৌনকর্মীদের শ্রমিকের স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ নিয়েও অবমাননাকর ভাষায় কমিশনকে আক্রমণ করেছেন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কেউ কেউ। এমনকি হেফাজতে ইসলামের এক সমাবেশে নারী সংস্কার কমিশনকে ‘বেশ্যা কমিশনও’ বলা হয়েছে, যা নিয়ে পরে সংগঠনটি দুঃখ প্রকাশ করেছে।
সেই প্রসঙ্গ ধরে ফরহাদ মজহারের ভাষ্য, যৌনকর্মীর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর মানবিক এবং রাজনৈতিক বিষয়।
“ফিলোসফাররা বলে, বেয়ার লাইফ। বেয়ার লাইফ মানে তাদের জীবনের কোনো আইনে সুরক্ষা নেই। ফলে রাষ্ট্র তাদেরকে রক্ষা করে না নির্যাতন থেকে, বিভিন্ন রকম অত্যাচার হামলা, কোনো সুরক্ষা নেই। তার সবচেয়ে বড় সিম্বল হচ্ছে যাদেরকে বলি যৌনকর্মী।
“নারী কমিশনের রিপোর্টটা বাদ দেন, ফেলে দেন বঙ্গোপসাগরে। আপনি তাদের জন্য কী করতে চান? বলেন সে তো নাগরিক দেশের, একটা অধিকার আছে। হয় আপনি এটাকে এখান থেকে বন্ধ করে দিন, আপনি তাকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুন। আপনি তে কিছু একটা করবেন। তাহলে আইনি সংস্কারের কথা যদি ওঠে তাহলে অবশ্যই তাকে কোনো না কোনো নাগরিক অধিকার আপনাকে দিতে হবে।”
যৌনকর্মী হিসেবে কাজের জন্য যে বয়সের সার্টিফিকেট নিতে হয়, সে কথা তুলে ধরে ফরহাম মজহার বলেন, “তাহলে কেন আপনি নারী কমিশনের সমালোচনা করছেন? রাষ্ট্র ইতোমধ্যে হস্তক্ষেপ করছে (সার্টিফিকেট দিয়ে)। রাষ্ট্র যদি হস্তক্ষেপই করে থাকে তাহলে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতেই হবে। রাষ্ট্র তুমি যখন স্বীকৃতি দিচ্ছ সে যৌনকর্ম করতে পারে; রাষ্ট্র যখন সার্টিফিকেট দিচ্ছ সে যৌনকর্ম করতে পারে, তাহলে তার নাগরিক অধিকার স্বীকার করবেন না কেন।”
তিনি বলেন, “যেসব ইসলামিস্টরা সমালোচনা করছে, তাদের তো এতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোথাও মিছিল করতে দেখিনি যে ‘আমরা কোনো যৌনকর্মী চাই না’। কিন্তু ইসলামে একটা বিরাট ব্যাপার আছে। কোনো মেয়ে যদি তার পেটের তাগিদে এ ধরনের যৌনকর্মে লিপ্ত হয়, শাস্তি কার আগে হবে, সে এলাকার ইমামের। কারণ, ইসলাম তো সমাজকেন্দ্রিক।
“…তারা কেন পুনর্বাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে না? এটা তো ইসলামবিরোধী পথ। …যৌন কর্মকে বন্ধ করতে চান? তাহলে ইসলামের মানবিক দিক নিয়ে এগিয়ে আসেন। আপনি এখন কি করলেন? মেয়েদেরকে বেশ্যা বলে গালি দিলেন।”
মেয়ের ছবি ছাপিয়ে পেটানো, অপমান করার পর যখন ‘হাসিনা’ নাম দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েও সমালোচনা করেন ফরহাদ মজহার।
ইসলামের নামে নারীদের অপমান করার মতো ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি।
এ গবেষক বলেন, “…এগুলো চলবে না। মেয়েদের এত অপমান করছেন কেন? এটা ঘোরতর ইসলামবিরোধী, ইসলামের নীতি নৈতিকতা বিরোধী কাজ।…দেশের মানুষ কী শিখল এখানে? নারীদেরকে এভাবে অপমান করায় আমাদের মুখোজ্জ্বল হয়েছে কি? না আমরা নিচে নেমেছি? এটা তো ঠিক হয়নি। আসেন তর্ক করেন, অসুবিধা নেই।”
নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি হেফাজতের, প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান জামায়াতের
নারী বিষয়ক সংস্কার: সুপারিশ বাস্তবায়নে 'সদিচ্ছার' চ্যালেঞ্জ সরকারের