Published : 24 Nov 2022, 08:06 PM
নিজের ও পরিবারের ভাগ্য বদলাতে প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদে জড়ানোর প্রবণতা নেই বলে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
এই প্রবাসীদের বেশির ভাগ এটাও বিশ্বাস করেন, রাজনীতিক, তরুণ নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজের মাধ্যমে সমাজ ও দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
বৃহস্পতিবার ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘উগ্রবাদ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে এর বাস্তবতা’ শীর্ষক এ গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। ব্র্যাকের সহযোগিতায় গবেষণাটি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে গবেষক ড. সাহাব বলেন, “গবেষণার ফলাফলে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রপন্থার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। “বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা এমন যে মানুষ উগ্রবাদিতার দিকে ঝুঁকে না। বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের উগ্রবাদে না জড়ানোর আরেকটি বড় কারণ দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের আর্থিক দুরবস্থা দূর করতে এবং জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে যায়। ফলে যে অর্থ ও সম্পদের জন্য তারা বিদেশে কাজ করে, অর্জন করে- তা হারানোর ভয় তার মধ্যে থাকে; ফলে তারা উগ্রপন্থার দিকে যান না।”
প্রবাসে ধর্মীয় পরিচয়ের চাইতে দেশের পরিচয় দিতেই বাংলাদেশি শ্রমিকরা বেশি স্বস্তিবোধ করেন জানিয়ে এ গবেষক বলেন, “বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশকেই আমরা দেখেছি, তারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়ের আগে বাঙালি পরিচয়টিকেই প্রাধান্য দেন।
“পাশাপাশি সমাজ ও দেশে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও ৯৪ দশমিক ২ শতাংশ কোনো উগ্রপন্থাকে সমর্থন না করে রাজনীতিবিদ, তরুণ নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজের মাধ্যমে পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন। মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ মনে করেন, ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।”
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার, লিবিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে ফেরা ৪০০ প্রবাসীর ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। গেল এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জে পরিচালিত হয়েছে গবেষণাটি।
বিভিন্ন সময়ে প্রবাসীদের অর্থ উগ্রপন্থায় ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগটিও এই গবেষণায় যাচাই করা হয়েছে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, পরিবারের কাছে অর্থ পাঠানোর বাইরে দাতব্য কাজে অর্থ ব্যয় করেন ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবাসী। গবেষণায় উত্তরদাতাদের ২ দশমিক ৩ শতাংশ তাদের অর্থ ধর্মীয় কাজে দান করেন।
প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে উগ্রবাদের প্রবণতা না থাকলেও কিছু ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন অধ্যাপক সাহাব। উগ্রবাদ ও ধর্মচর্চা- এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্য যে শিক্ষা ও দক্ষতার দরকার, তার যথেষ্ট অভাব আছে বলে মনে করেন তিনি। সেই সাথে সামাজিক বৈষম্য, বঞ্চনা, অর্থনৈতিক আগ্রাসন, নিরাপত্তাহীনতা, কম বেতন ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট হতাশাজনক পরিস্থিতির কথাও বলেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণের যে প্রয়োজনীয়তা আছে, সেই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাহাব বলেন, “গবেষণাটিতে আমরা দেখেছি উত্তরদাতাদের মধ্যে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ সামাজিক মাধ্যমে ধর্মীয় জ্ঞান শেয়ার করছেন। আশঙ্কার বিষয় হলো- আমাদের প্রবাসীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা কম। ফলে অনেক ভুল ও উস্কানিমূলক তথ্য তাদের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে। এতে কেউ কেউ ভুল করে ফেলতে পারেন।”
গবেষণায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে, যার মধ্যে আছে- শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর আগেই গন্তব্য দেশের আইন ও নিয়মকানুন জানানো, রেমিটেন্সের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, দূতাবাসের মাধ্যমে ক অভিবাসীদের নিয়মিত খোঁজ রাখা, তাদের অভিযোগের দ্রুত সমাধান করা এবং সামাজিক মাধ্যমে উগ্রবাদী মতবাদ শনাক্তকরণে অনলাইনে জোর নজরদারি করা।
২০১৬ সালের শুরুতে সিঙ্গাপুরে জঙ্গি সন্দেহে আট বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে, যারা স্বদেশে ফিরে হামলার ছক এঁটেছিলেন বলে দাবি করেছিল দেশটির সরকার।
সেই প্রসঙ্গ টেনে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি বিভাগের প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, “এটি খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। সিঙ্গাপুর উগ্রবাদের অভিযোগে অভিবাসী ফিরিয়ে দিলে আমাদের অনেক জায়গা থেকে শুনতে হয়েছে আসলেই বাংলাদেশি প্রবাসীরা এমন কাজে জড়িত কি না। ফলে এই গবেষণাটি করা খুব দরকার ছিল। কেননা প্রবাসীদের আয় আমাদের দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।“
সিঙ্গাপুরে ৮ বাংলাদেশি ‘জঙ্গি’ আটক, দেশে হামলার ছক
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশে নিযুক্ত সিঙ্গাপুরের কনসাল শিলা পিল্লাই বলেন, “বাংলাদেশে থেকে আমাদের শ্রমিক নেওয়া অব্যাহত থাকবে। তবে তাদেরকে যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে অবাধ ব্যবহার ও ধর্মীয় পরিচয় তাদের যে কোনো সময় বিপথে নিতে পারে।“
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উপপরিচালক জহুরা মনসুর বলেন, “অভিবাসী কেউ উগ্রবাদে জড়ানো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও অনাকাঙ্ক্ষিত, কারণ তা আমাদের শ্রমবাজারকে হুমকির মুখে ফেলে। আমরা চাই না, আমাদের একজন প্রবাসী ভাই-বোনও অন্য দেশে গিয়ে সেখানকার আইন ভাঙুক বা উগ্রবাদে জড়াক।
“একজন বিদেশগামী উগ্রবাদের জড়ানোর সম্ভাবনা আছে কি না, তা পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন থেকেই শুরু হয়ে যায়। এর বাইরেও প্রবাসীরা যেন ভুল পথে পা না বাড়ান, সেজন্য আমরা আমাদের প্রশিক্ষণ শাখাকে আরও শক্তিশালী করতে পারি, মডিউলগুলোতেও পরিবর্তন আনতে পারি।”
উগ্রবাদ ঠেকাতে ধর্মীয় নেতারা যাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন, সেই আহ্বান জানিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ ষষ্ঠ বড় জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশ। তাই দেশের বাইরে প্রবাসীদের ছোট নেতিবাচক ঘটনাও দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে পারে এবং জনশক্তি রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
তিনি বলেন, “ধর্মের নামে উগ্রপন্থা আমরা মোটেই সহ্য করবো না। সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটে ধর্মপ্রচার ও উগ্রবাদী বার্তার মাঝে আমরা স্পষ্ট লাইন টেনে দিতে চাই। এক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতাদেরকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার জন্য আমরা উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছি।”
ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার হাবিবুর নবী আনিসুর রশীদসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।