Published : 05 Jul 2023, 01:01 AM
ঢাকায় গত পাঁচ বছর এইডিস মশার উপস্থিতি শনাক্তে বর্ষা পূর্ববর্তী যে জরিপ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, তাতে এবারের মতো উদ্বেগজনক ফল কখনও আসেনি।
মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক জরিপের ফলাফলে জানায়, এ বছর ঢাকার ৫৫টি ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি। অর্থাৎ এসব ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এইডিস মশার ঘনত্ব ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশে ষাটের দশকে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্তের পর পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালেই পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল।
সেবার ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, তাদের মধ্যে মৃত্যু ঘটে ১৭৯ জনের। আক্রান্ত এবং মৃতদের বেশিরভাগই ছিল রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা।
ওই বছর প্রাক-বর্ষা মৌসুম জরিপে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ২১টি ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ছিল ২০ এর বেশি।
আর মঙ্গলবার প্রাক-বর্ষা মৌসুম জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, এবার তার দ্বিগুণের বেশি ৫৫টি ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর উপরে।
দুই সিটির গড় ব্রুটো ইনডেক্সই ২০ এর বেশি, ডিএনসিসি এলাকায় ২৫ দশমিক ৫২ এবং ডিএসসিসি এলাকায় ২০ দশমিক ৯৮। দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯৮টিতে গত ১৮ থেকে ২৭ জুন এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।
এই জরিপের ফলকে উদ্বেগজনক বলছেন কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলছেন, “আমরা সকলেই কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি।”
মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি একশ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এইডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে মশার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বলা যায়। আর হাউজ ইনডেক্স পাঁচের বেশি হলে তাকে মশার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বিবেচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে,
২০১৯ সালের জরিপে ডিএনসিসির ৭টি, ডিএসসিসির ১৪টি ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি ছিল।
২০২০ সালের জরিপে দুই সিটির কোনো ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ ছাড়ায়নি।
২০২১ সালে দুই সিটি করপোরেশন এলাকার একটি করে ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০এর বেশি পাওয়া গিয়েছিল।
২০২২ সালের জরিপে উত্তর সিটির কোনো ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি ছিল না, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তিনটি ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ছিল ২০ এর বেশি।
২০২৩ সালের জরিপে অনুযায়ী, ঢাকার প্রায় অর্ধেক, ৪৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ ওয়ার্ডে এইডিস মশার লার্ভার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি রয়েছে।
২০২০ সালে ১৪০৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, কেউ মারা যায়নি।
২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯ জন হাসপাতালে ভর্তির পাশাপাশি মৃত্যু হয় ১০৫ জনের।
২০২২ সালে সারাদেশে ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, মৃত্যু হয়ে ১৮১ জনের।
২০২২ সালে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৩৯ হাজার ২২০ জন ঢাকার।
এ বছর ৪ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৯ হাজার ৮৭১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন, তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৬১ জনের।
এরমধ্যে মঙ্গলবার ৬৭৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হন, ৫ জন মারা যান। এ বছর এক দিনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা।
এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই শুরু হয়েছে। এইডিস মশার উপস্থিতি বেশি থাকায় এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে যুক্ত এই কীটতত্ত্ববিদ মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যাবে না, এ বছর প্রাক-বর্ষা মৌসুম জরিপ করা হয়েছে বর্ষা মৌসুম শুরুর সময়ে। এ কারণে আগের জরিপের সঙ্গে কিছুটা পার্থক্য আছে। কিন্তু জরিপের ফল ‘উদ্বেগজনক’।
আমরা আশঙ্কা করছি পরিস্থিতি বেশি খারাপ হবে।কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার
তার ভাষ্যে, “আগেরগুলোর সঙ্গে এবারের জরিপের তুলনা করা যাবে না। কারণ এবারের যে সার্ভে হয়েছে, সেটি আসলে মনসুনকে টাচ করে গেছে। প্রি-মনসুন সার্ভে মূলত মে মাসে হয়। এ বছর জুন মাসে হয়েছে।
“কিন্তু এই বছর এইডিস মশার ঘনত্ব অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে আমরা আশঙ্কা করছি পরিস্থিতি বেশি খারাপ হবে। ইতোমধ্যেই অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যু্ও হচ্ছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলামের কথায়ও উদ্বেগের সুর।
তিনি বলেন, “আমাদের পরিসংখ্যান বলে ব্রুটো ইনডেক্স এবং হাউজ ইনডেক্স দুই সিটি করপোরেশন এলাকায়ই বেশি। কাজেই উত্তর-দক্ষিণ যেভাবেই বিচার করি না কেন ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটিতে কিন্তু এইডিস মশার ব্যাপক উপস্থিতি। আমরা সকলেই কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুুঁকির মধ্যে রয়েছি।”
যেসব এলাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরিপের যে ফলাফল দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার প্রায় সব এলাকাই ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ঢাকা উত্তর সিটির ২, ৩, ৫, ৬, ১০, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৩, ৩৫, ৩৭ ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ।
মিরপুর, পল্লবী, মাজার রোড, পীরের বাগ. মনিপুর, শ্যাওড়াপাড়া, কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, খিলক্ষেত, কুড়িল, জোয়ার সাহারা, বনানী, গুলশান, বারিধারা, মহাখালী, রামপুরা, খিলগাঁও, মালিবাগ, কারওয়ানবাজার, তেজতুরী বাজার, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, বায়তুল আমান, মগবাজার, ইস্কাটন, বাড্ডা পড়েছে এসব ওয়ার্ডের আওতায়।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৫, ১৬, ১৮, ১৯, ২২, ২৩, ২৬, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৪১, ৪৪, ৪৬, ৪৮, ৫০, ৫১, ৫৪, ৫৫ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি।
গোড়ান, মেরাদিয়া, বাসাবো, সবুজবাগ, মুগদা, মাদারটেক, ফকিরাপুল, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, রাজারবাগ, পুরানা পল্টন, বায়তুল মোকাররম, ধানমণ্ডি, রায়েরবাজার, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফেন্ট রোড, মিন্টো রোড, কাকরাইল, হাজারীবাগ, লালবাগ, আজিমপুর, পলাশী, বংলাশ, সিদ্দিকবাজার, শাঁখারীবাজার, রায় সাহেববাজার, ওয়ারী, সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, সায়েদাবাদ, উত্তর যাত্রাবাড়ী, মীরহাজিরবাগ, ধোলাইপাড়, গেণ্ডারিয়া, জুরাইন এবং কামরাঙ্গীরচর এসব ওয়ার্ডের আওতায় পড়েছে।
ঢাকা উত্তরের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ১০০; ৩০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৭; ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৪৭ এবং ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৪১।
ঢাকা দক্ষিণের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের ব্রুটো ইনডেক্স ৬০; ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৪৭; ১৬ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৪০; ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ৪৩; ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৪১ পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ।