Published : 12 Aug 2023, 09:11 PM
ব্যস্ত সড়কের পাশেই মূল ফটক, খানিকটা ফাঁকা আঙিনার পরই কয়েকতলা ভবন, আর গায়ে সাঁটানো সাইনবোর্ডে লেখা ‘ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল’।
আগে থেকে না জানলে বোঝার উপায় নেই ‘করোনা হাসপাতাল’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা হয়। হাসপাতালের সামনের ফাঁকা আঙিনায় মানুষের তেমন জটলা নেই, ভিড় নেই হাসাপাতালের ভেতরেও।
ডেঙ্গুতে এবার ঢাকার হাসপাতালগুলো যখন রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে, তখন এই কোভিড হাসপাতালে বেশিরভাগ শয্যা আর আইসিইউ খালি। যদিও ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এই হাসপাতালকে গত ১৭ জুলাই ‘ডেঙ্গু ডেডিকেটেড’ ঘোষণা করেছে সরকার।
চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনরা বলছেন, মহাখালী টার্মিনাল ঘেঁষা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বিশেষায়িত এই হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই আসছেন অন্য হাসপাতাল ঘুরে। আরও যারা আসছেন, তারা স্থানীয় হাসপাতাল, ক্লিনিক, চিকিৎসক, ওষুধ বিক্রেতা কিংবা পরিচিতি জনদের কাছ থেকে খবর পেয়ে।
হাসপাতালটিতে শয্যা রয়েছে ১ হাজার ৫৪টি। তবে শনিবার সেখানে ২২৮ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। অন্য হাসপাতালগুলোতে আইসিইউয়ের চরম সংকট থাকলেও এই হাসপাতালের ২১২টি আইসিইউয়ের এদিন ফাঁকা পড়ে ছিল ১৮৬টি।
রাজধানীর ডেঙ্গু ডেডিকেডেট হাসপাতালগুলো রোগীর চাপে হিমশিম খেলেও ডিএনসিসি হাসপাতালের ৭৮ শতাংশেরও বেশি শয্যা ফাঁকাই রয়েছে। প্রয়োজনে হলে মিলছে আইসিইউ। অপরদিকে ভর্তি রোগীরাও চিকিৎসা নিয়ে নিজেদের সন্তুষ্টির কথা জানাচ্ছেন।
হাসপাতালটিতে শয্যা ফাঁকা থাকার পরও এর অবস্থানগত কারণে রোগী কম আসছে বলে মনে করছেন পরিচালক কর্নেল এ কে এম জহিরুল হোসাইন খান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “লোকেশনের কারণে আমাদের রোগী কম। হাসপাতালটি এমন এমটি জায়গায় সেখানে অনেকেই সহজে আসতে পারেন না। এখানে আসতে হলে সিএনজি বা অন্য গাড়ি লাগে।”
“অন্য হাসপাতালগুলোতে জায়গা না পাওয়া সব ডেঙ্গু রোগীকেই এখানে ভর্তি করা হবে, সেই সক্ষমতাও আমাদের রয়েছে”, বলেন তিনি।
গত ১৯ এপ্রিল থেকে ডিএনসিসি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ১৭ জুলাই হাসপাতালটিকে ‘ডেঙ্গু ডেডিকেটেড’ ঘোষণা করা হয়। ১৯ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৬৫২ জন রোগী চিকিৎসা নিতে এখানে এসেছেন। এর মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ১০ হাজার ৮৮৫ জন।
অন্য হাসপাতাল ঘুরে ডিএনসিসিতে
ডেঙ্গু জ্বর সন্দেহে কয়েকদিন আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের মো. রাসেল ভুইয়া। ওই দিন রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় তাকে সেখানে ভর্তি হতে হয়নি।
বাড়ি ফিরেও জ্বর না কমায় দুদিন পর আবার পরীক্ষা করান, জানতে পারেন তার ডেঙ্গু হয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে রাসেল বলেন, “যেদিন ঢাকা মেডিকেলে যাই, ওইদিন অনেক ডেঙ্গু রোগীকে ফিরিয়ে দিতে দেখেছি। অনেককে তারা বলছিল, মহাখালীতে সিটি করপোরেশেনের হাসপাতালে যেতে, সেখানে নাকি সিট খালি আছে। আমার ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর সরাসরি এই হাসপাতালে চলে আসি, ভর্তি হতেও কোনো সমস্যা হয়নি।”
ডিএনসিসি হাসপাতালে নিজের মাকে ভর্তি করিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার ইউনিয়নের মো. বাহার হোসেন। তার আগে লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় একটি হাসপাতালে গেলে তারা ডিএনসিসি হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেয়।
বাহার বলেন, “চার দিন আগে মাকে ভর্তি করিয়েছি। থুথুর সঙ্গে রক্ত বের হত। এখন অবস্থা ভালো। পেটে একটু ব্যথা আছে, এজন্য ডাক্তার বলেছেন আল্ট্রা করার পর ছেড়ে দেবেন।”
গত চার দিনে বেশিরভাগ ওষুধ ডিএনসিসি হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে বাহার বলেন, “চার দিনে ৫০০ টাকার মত ওষুধ বাইরে থেকে কিনে দিতে হয়েছে। ডাক্তারদের সবাই ভালো।”
তিন দিন আগে শাশুড়িকে ডিএনসিসি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন ঝর্ণা। দক্ষিণ বাড্ডার এই বাসিন্দা বলেন, “বাড্ডায় এক ডাক্তারের দোকানে জ্বরের ওষুধ আনতে গেছিলাম। পরে রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ওই ডাক্তার আমাদের এই হাসপাতালে আসতে বলেন। আসার পরেই ভর্তি করে নিছে।”
হাসপাতালের পরিবেশেও সন্তুষ্ট ঝর্ণা। জানান, বেশিরভাগ ওষুধই হাসপাতাল থেকে দেয়। দু-একটা ওষুধ বাইরে থেকে কিনে দিতে হচ্ছে।
গত বছর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ঢাকার শাহিনবাগের ফেরদৌস আরা তুহিন ডিএনসিসি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। মার্কেট করার জন্য গড়ে তোলা এই ভবনটিকে এরপর থেকে হাসপাতাল হিসেবে চেনেন তিনি। তিন দিন আগে ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
তুহিনের ছেলে খালিদ হাসান মৃদুল বলেন, “এই হাসপাতালে চিকিৎসা খুব ভালো। হাসপাতালের পরিবেশও ভালো। সরকারি হাসপাতালে সাধারণত এমন পরিবেশ দেখা যায় না।”
এভাবে বেশিরভাগ রোগী এই হাসপাতালে আসছেন অন্য হাসপাতাল ও ক্লিনিক ঘুরে। অন্য হাসপাতাল এখানে যাদের রেফার্ড করেনি, তারা আসছেন অন্যদের কাছে খোঁজ-খবর নিয়ে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত নিজের বাবাকে রবিশালের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছিলেন ফিরোজ মিয়া। এরপর অবস্থার অবনতি হওয়ায় দুদিন আগে তার বাবাকে নিয়ে ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান।
“মুগদা হাসপাতালের ডাক্তার বাবাকে পরীক্ষা করে জানান, আইসিইউ লাগবে। কিন্তু তাদের হাসপাতালে ওই সময় আইসিইউ ফাঁকা নেই। পরে কয়েকজন আমাকে মহাখালীর এই হাসপাতালে নিয়ে আসার পরাশর্ম দেন। আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাবাকে ভর্তি করিয়ে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে। অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।”
কোভিড মহামারীর সময় মার্কেট বানানোর জন্য নির্মিত ভবনকে অস্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তর করে ডিএনসিসি। কোভিড সংক্রমণ কমে গেলে সেখানে সাধারণ চিকিৎসা কার্যক্রম চলছিল। আর এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় একে ‘ডেঙ্গু ডেডিকেটেড’ হাসপাতাল করা হয়েছে।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, বড় দোকানের জন্য যেসব কক্ষ বানানো হয়েছে সেখানে ১০টি করে শয্যা পাতা হয়েছে। আর ছোট দোকানের জন্য বানানো কক্ষগুলোকে কেবিন আকারে দুটি করে শয্যা দেওয়া হয়েছে। ছোট ছোট কক্ষে চিকিৎসক ও সেবিকাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কয়েকটি কক্ষে রাখা হয়েছে ওষুধসহ চিকিৎসার অন্যান্য সরঞ্জাম।
হাসপাতালে রোগীর তেমন ভিড় না থাকায় হাসপাতালের সামনেও কোনো জটলা নেই।
অবস্থানগত কারণে রোগী কম
মহাখালী বাস টার্মিনাল লাগোয়া ব্যস্ত সড়কের পাশেই এ হাসপাতাল। সাপ্তাহিক কর্মদিবসগুলোতে এই সড়কে যানজট নিত্যসঙ্গী।
হাসপাতালটির পরিচালক কর্নেল এ কে এম জহিরুল হোসাইন খান বলেন, “অবস্থানগত কারণেই রোগী কম আসছে। এটি এমন এক জায়গায়, যেখানে অনেকেই সহজে আসতে পারে না।”
তিনি বলেন, “লালবাগে এখন ডেঙ্গু রোগী বেশি। সেখানে কাছাকাছি মুগদা ও মিটফোর্ড হাসপাতালে মানুষ সহজেই যেতে পারে। রোগীরা যখন হাসপাতাল নির্ধারণ করে তখন বাড়ির কাছের হাসপাতালকে বেছে নেয়। কারণ বাসা থেকে আসা যাওয়ার জন্য সুবিধা হয়।”
ডিএনসিসি হাসপাতালে ঢাকার বাইরে থেকে বেশি রোগী আসে জানিয়ে পরিচালক বলেন, “ঢাকার অন্য হাসপাতালে যখন সিট পায় না, তখন আমাদের এখানে আসে। অন্য হাসপাতাল ভর্তি না নিলে বাধ্য হয়েই আমাদের এখানে আসে। সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া আছে অন্য হাসপাতাল থেকে কেউ ঘুরে এলে যেন অবশ্যই ভর্তি নেওয়া হয়।
“ক্রিটিক্যাল রোগীদের চিকিৎসার জন্য এটি ভালো জায়গা। কারণ অন্য হাসপাতালে যখন আইসিইউ পায় না, আমার এখানে এসেই আইসিইউ পেয়ে যায়। রেফার্ড রোগী এখানে ভর্তি হয় বেশি।”
জহিরুল হোসাইন জানান, ডিএনসিসি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ২০-২২ শতাংশের ভর্তির প্রয়োজন হচ্ছে। এই হাসপাতালে রোগী মৃত্যুহার এক শতাংশের নিচে।
“প্রতিদিনই গণমাধ্যমে আমাদের হাসপাতাল নিয়ে খবর হচ্ছে, সেসব খবর দেখে অনেকেই হাসপাতালটি সম্পর্কে জানতে পারছেন।”
ডিএনসিসি হাসপাতালে বর্তমানে ৮৫ জন চিকিৎসক এবং ১১৫ জন সেবিকা কাজ করছেন জানিয়ে পরিচালক বলেন, আরও ১০ জন সেবিকাকে পদায়নের আদেশ হয়েছে।
“রোগীর সংখ্যা বাড়লে আরও চিকিৎসক ও নার্সকে পদায়ন করা হবে। রোগীর সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে গেলে নতুন চিকিৎসক ও নার্স লাগবে।”