Published : 27 Nov 2023, 07:28 AM
পরিসংখ্যান বলছে, চার বছরের মধ্যে পাসের হারে এবার বেশ পিছিয়ে পড়েছে উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরা, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
আবার কোভিডের আগের তুলনায় এ বছর পাসের হার বেড়েছে অনেকটা, জিপিএ-৫ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার এইচএসসি ও সমমানের ফলাফলে ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ হয়েছে, ফলাফল ‘বিশ্বাসযোগ্য’ হয়েছে।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এ বছর পাস করেছে ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থী, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯২ হাজার ৫৯৫ জন।
আগের দুই বছর কোভিড মহামারীর কারণে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হয়। ফলে ২০২২ সালে ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ ও ২০২১ সালে ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে। জিপিএ-৫ পায় যথাক্রমে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন ও ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন।
২০২০ সালে মহামারীর কারণে পরীক্ষা না নিয়ে জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়নে সবাই পাস করে, জিপিএ-৫ পায় এক লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন।
কোভিড মহামারীর পর এ বছর প্রথম পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়েছে। তাতে গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ পয়েন্ট, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৮৩ হাজার ৬৮৭ জন।
অন্যদিকে মহামারী শুরুর আগে ২০১৯ সালে এইচএসসি ও সমমানে পরীক্ষায় পাস করে ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৪৭ হাজার ২৮৬ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়।
এ হিসেবে মহামারীর আগের বছরের তুলনায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ এ এবারের শিক্ষার্থীরা অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে।
এসএসসির পর এ বছর এইচএসসিতেও ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে সবার শীর্ষে রয়েছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৮০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
বরিশাল বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ কুমার গাইন মনে করেন, শিক্ষার্থীরা কোভিডের ধাক্কা সামলে ওঠায় ২০১৯ সালের তুলনায় ফল ‘অনেক ভালো’ হয়েছে। ভালো ফলের কারণ হিসেবে মানবিকের ফলাফলকে সামনে আনছেন তিনি।
“মানবিকের শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। মানবিকের প্রশ্ন সহজ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা লিখতে পেরেছে।”
শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের কৃতিত্ব দিয়ে অরুণ কুমার গাইন বলেন, “আমাদের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মনিটরিং আছে, যেটা হয়ত ফলাফল ভালো হওয়ার কারণ।”
১১ বোর্ডের মধ্যে এবার সবচেয়ে কম ৬৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ পাসের হার যশোর শিক্ষা বোর্ডে।
ফলাফলে পিছিয়ে থাকার জন্য ইংরেজির ফলকে দায়ী করে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বিশ্বাস শাহিন আহম্মদ বলেন, “এবার ইংরেজিতে আমাদের ৭৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। ইংরেজির প্রশ্ন কঠিন ছিল। আমরা তো প্রশ্ন করি না। লটারির মাধ্যমে অন্য বোর্ড থেকে প্রশ্ন আসে।
“একমাত্র ইংরেজিতে ২৩ শতাংশের মত শিক্ষার্থী পাস করতে না পারায় সামগ্রিক ফলাফল খারাপ এসেছে। আমরা এটা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেব।”
মহামারীর আগে ২০১৯ সালে এই বোর্ডে পাসের হার ছিল ৭৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। সে তুলনায় এ বছরের ফলকে ‘বড় বিপর্যয়’ হিসেবে দেখছেন না বিশ্বাস শাহিন আহম্মদ।
বরাবর পিছিয়ে থাকা সিলেট বোর্ড এবার পাসের হারে কিছুটা এগিয়েছে, সেখানে ৭১ দশমিক ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। এই বোর্ডে শতভাগ পরীক্ষার্থী ফেলের প্রতিষ্ঠান নেই, শতভাগ পাস করেছে দুটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
এ বছর মেয়েদের পাসের হার ৮০ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ছেলেদের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ফল বিশ্লেষণের দেখা যায়, ছেলেরা সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে পড়েছে মানবিকে।
নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে মানবিকে মেয়েদের পাসের হার ৭৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ছেলেদের পাসের হার ৬৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
এক নজরে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল
বোর্ড | পাসের হার (%) | জিপিএ-৫ (জন) | পাসের হার (%) | জিপিএ-৫ (জন) | পাসের হার (%) | জিপিএ-৫ (জন) | পাসের হার (%) | জিপিএ-৫ (জন) | পাসের হার (%) | জিপিএ-৫ (জন) |
২০২৩ | ২০২২ | ২০২১ | ২০২০ | ২০১৯ | ||||||
ঢাকা | ৭৯.৪৪ | ৩১,৭৫২ | ৮৭.৮৩ | ৬২,৪২১ | ৯৬.২০ | ৫৯,২৩৩ | ১০০ | ৫৭,৯২৬ | ৭১.০৯ | ১৮,১৮৭ |
রাজশাহী | ৭৮.৪৬ | ১১,২৫৮ | ৮১.৬০ | ২১,৮৫৫ | ৯৭.২৯ | ৩২,৮০০ | ১০০ | ২৬,৫৬৮ | ৭৬.৩৮ | ৬,৭২৯ |
কুমিল্লা | ৭৫.৩৯ | ৫,৬৫৫ | ৯০.৭২ | ১৪,৯৯১ | ৯৭.৪৯ | ১৪,১৫৩ | ১০০ | ৯,৩৬৪ | ৭৭.৭৪ | ২,৩৭৫ |
যশোর | ৬৯.৮৮ | ৮,১২২ | ৮৩.৯৫ | ১৮,৭০৩ | ৯৮.১১ | ২০,৮৭৮ | ১০০ | ১২,৮৯২ | ৭৫.৬৫ | ৫,৩১২ |
চট্টগ্রাম | ৭৪.৪৫ | ৬,৩৩৯ | ৮০.৫০ | ১২,৬৭০ | ৮৯.৩৯ | ১৩,৭২০ | ১০০ | ১২,১৪৩ | ৬২.১৯ | ২,৮৬০ |
বরিশাল | ৮০.৬৫ | ৩,৯৯৩ | ৮৬.৯৫ | ৭,৩৮৬ | ৯৫.৭৬ | ৯,৯৭১ | ১০০ | ৫,৫৬৮ | ৭০.৬৫ | ১,২০১ |
সিলেট | ৭১.৬২ | ১,৬৯৯ | ৮১.৪০ | ৪,৮৭১ | ৯৪.৮০ | ৪,৭৩১ | ১০০ | ৪,২৪২ | ৬৭.০৫ | ১,০৯৪ |
দিনাজপুর | ৭৪.৪৮ | ৬,৪৫৯ | ৭৯.০৮ | ১১,৮৩০ | ৯২.৪৩ | ১৫,৩৪৯ | ১০০ | ১৪,৮৭১ | ৭১.৭৮ | ৪,০৪৯ |
ময়মনসিংহ | ৭০.৪৪ | ৩,২৪৪ | ৮০.৩২ | ৫,০২৮ | ৯৫.৭১ | ৭,৬৮৭ | ১০০ | ১০,০৪০ | ||
মাদ্রাসা | ৯০.৭৫ | ৭,০৯৭ | ৯২.৫৬ | ৯,৪২৩ | ৯৫.৪৯ | ৪,৮৭২ | ১০০ | ৪,০৪৮ | ৮৬.৫৬ | ২,২৪৩ |
কারিগরি | ৯১.২৫ | ৬,৯৭৭ | ৯৪.৪১ | ৭,১০৪ | ৯২.৮৫ | ৫,৭৭৫ | ১০০ | ৪,১৪৫ | ৮২.৬২ | ৩,২৩৬ |
মোট | ৭৮.৬৪ | ৯২,৫৯২ | ৮৫.৯৫ | ১,৭৬,২৮২ | ৯৫.২৬ | ১,৮৯,১৬৯ | ১০০ | ১,৬১,৮০৭ | ৭৩.৯৩ | ৪৭,২৮৬ |
তুলাদণ্ডের পাঠ
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, যে কোনো পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে উত্থান থাকবেই, এর পিছনে যুক্তিসঙ্গত কারণও থাকে। তবে এবার কোভিডের পরে প্রথম পুরো সিলেবাসে পূর্ণাঙ্গ নম্বরে পরীক্ষা হওয়াকেই এবারের ফলের নির্ধারক মানছেন তিনি।
এ বছরের ফলকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে বর্ণনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই সাবেক উপদেষ্টা বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে ৯০ শতাংশ পাসের হার ছিল। এটা তো বিশ্বাসযোগ্যও হয় না মানুষের কাছে। আমি মনে করি, এবার বিশ্বাসযোগ্যতাও ফিরেছে।”
জিপিএ-৫ দিয়ে শিক্ষার মানের মূল্যায়ন হয় না মন্তব্য করে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “এবার একটা ভালো দিক হচ্ছে, শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে। অর্থাৎ একটা স্থিতিশীলতা এসেছে। খেয়াল রাখতে হবে যে, পরীক্ষাটাই মূল জিনিস না। নানা ধরনের ব্যবহারিক জিনিস-কারিগরি দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও বলছেন, এ বছরের ফল এইচএসসির ফলকে একটি ‘ভারসাম্যের অবস্থানে’ নিয়ে এসেছে।
“৯০ বা ৮০’র দশকে ৭০ ভাগ পাস করলেই সেটা দারুণ ছিল। ১০ শতাংশ লেটার পেয়েছে তো দারুণ। এটাতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু মাঝখানে শিক্ষাব্যবস্থার মান খারাপ হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে। একসময় নকল সাপ্লাই হত। সেটা এখন আর নেই। এখন প্রশ্ন ফাঁসও নেই। মুখস্তনির্ভর পরীক্ষা হলেই তো নকল হবে, সৃজনশীল পদ্ধতিতে তো নকল করে লাভ নেই। এই ভারসাম্যের প্রয়োজন ছিল।”
গত তিন বছর জিপিএ-৫ বেশি থাকার বিষয়ে ইংরেজি সাহিত্যের এই শিক্ষক বলেন, “কিছুদিন আগে জিপিএ-৫ এর একটি বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অকারণে কেন পাবে? আমি নিজে দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছে, কিন্তু তাদের ইংরেজি জ্ঞানটা ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির মত। তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছি; বলেছে, জিপিএ-৫ পেয়েছে।”
মানবিকের ফল খারাপ হওয়ার পিছনে ইংরেজির দুর্বলতাকে কারণ হিসেবে দেখছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
“এবার মানবিকের শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। এটা মুখস্ত করলে হবে না। মুখস্ত করলে ফল ভালো হবে না। ইংরেজিতে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে।
“কেন ইংরেজিতে বাচ্চারা খারাপ করছে? আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা রয়েছে। ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা তো খারাপ করবেই। কারণ শিক্ষকরা এখনও ব্যাচে পড়ান। যারা ব্যাচে পড়ান, তারা কীভাবে শিক্ষার্থীদের যত্ন নেবেন? আমাদের সার্বিকভাবে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। অবহেলিত, বঞ্চিত, যারা ঝরে পড়ছে, তাদের দিকে নজর দিতে হবে।”
যেসব শিক্ষার্থী খারাপ করছে, ঝরে পড়ছে- তাদের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
খারাপ ফল হলে শিক্ষার্থীদের চাপ না দিয়ে ভালোর দিকে এগিয়ে নিতে হবে মন্তব্য করে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “আমাদের অভিভাবকরা সবকিছুতেই মাত্রাতিরিক্ত চিন্তাভাবনা করেন। পরীক্ষা নিয়ে, জিপিএ-৫ নিয়ে তারা চিন্তিত থাকেন। কিন্তু এটা তো বুঝতে হবে যে জিপিএ-৫ পাওয়াটাই জীবনের মূল লক্ষ্য না।
“আমাদের দেশের যেসব ছেলে-মেয়েরা দেশের বাইরে ভালো করছে, তারা কিন্তু বিশাল বিশাল রেজাল্ট করে যায়নি। এটা বুঝতে হবে যে, আপ-ডাউন থাকবে। কখনও ভাল হবে, কখনও খারাপ হবে। এর মধ্য দিয়ে একটি ধারা সূচিত হয়।”
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “এখন গতবারের চেয়ে একটু খারাপ হয়েছে। আবার ভালো হবে। আমি মনে করি না এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ আছে। শিক্ষার্থীরা পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতিটা কেমন নিল- এটা ভাবনার বিষয় হতে পারে। আমরা তো দেখেছি, জিপিএ-৫ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়নি। অর্থাৎ জিপিএ-৫টাই প্রধান নির্ধারক না।”
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “সিলেট বোর্ড প্রতিবার খারাপ করে। এবার কিছুটা ভালো করেছে। তার মানে প্রয়াস রয়েছে। এই প্রয়াসটাই লক্ষণীয়। একবার খারাপ করলে ভালো করার ইচ্ছাটাই আসল। এই চ্যালেঞ্জটা নেওয়া দরকার।
“মেয়েরা দীর্ঘদিন ধরে ভাল করছে। এটারও কারণ আছে। তারা পড়াশোনায় মনোযোগী। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ছিল, উপবৃত্তি ছিল। নানা ইতিবাচক নীতি কর্মসূচি ছিল, এগুলো অব্যাহত রাখতে হবে।”