Published : 24 Aug 2022, 10:05 AM
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অফিস এবং ব্যাংকের নতুন সময়সূচির প্রথম দিন রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কে যানজটও শুরু হয়েছে আগেভাগে।
অফিস সময় এক ঘণ্টা এগিয়ে আসায় বুধবার সকাল ৭টা থেকেই ঢাকার প্রায় প্রতিটি রাস্তায় দেখা যায় ব্যাপক ভিড়।
তবে ওই সময় বাসের সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকায় এবং আগেভাগে বেশি মানুষ রাস্তায় নামায় মোড়ে মোড়ে দেখা যায় জটলা। বাসের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেককে।
নতুন নিয়মে সব সরকারি অফিস চলবে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। ব্যাংক চলবে সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত, এর মধ্যে ৩টা পর্যন্ত লেনদেন করা যাবে।
আগে সরকারি অফিস সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ চলত।
অফিসের কাজের সময় এগিয়ে আনার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুই দিন ছুটি দেওয়া হয়েছে সপ্তাহে। তবে ক্লাসের সময় রাখা হয়েছে আগের মতই।
ঢাকার অধিকাংশ স্কুলের প্রভাতী শাখায় ক্লাস শুরু হয় সকাল সাড়ে ৭টায়। ফলে অফিস ও স্কুলের ভিড় পড়েছে প্রায় একই সময়ে। তাতে বিভিন্ন পয়েন্টে অন্যান্য সময়ের চেয়ে ঘণ্টাখানেক আগেই যানজট দেখা দিয়েছে।
একজন যাত্রী জানালেন, বাসাবো থেকে সকাল ৭টায় বেরিয়ে আগে ৪০ মিনিটে মহাখালী পৌঁছানো গেলেও নতুন অফিস সূচির প্রথম দিন তিনি তা পারেননি। তার সময় লেগেছে সোয়া এক ঘণ্টা।
প্রতিদিন মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে রিকশায় করে নিউ বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মেয়েকে পৌঁছে দেন হাফিজা খাতুন। আগে তার সময় লাগত ৪৫ মিনিট। বুধবার সময় লেগেছে এক ঘণ্টার বেশি।
তিনি বললেন, “জ্যাম এত বেশি যে মৌচাকের কাছেই মেয়েকে নিয়ে রিকসা থেকে নেমে গলি দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়েছে। অফিসের নতুন সময়সূচির জন্য আজ সব গাড়ি-ঘোড়া এক সাথে রাস্তায় নেমেছে।”
মনু মিয়া নামের এক রিকশাচালক বললেন, আগে ৮টা পর্যন্ত রাস্তাঘাট মোটামুটি যানজটমুক্ত থাকত। কিন্তু বুধবার সকাল সাড়ে ৭টার সময়ই জট শুরু হয়ে গেছে।
“অলি-গলির রাস্তাগুলোতেও এত লম্বা লাইন, ভোরে উইঠাই মাথাটা খারাপ হয়া গেছে।”
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের এক শিক্ষার্থীর মা রেবেকা সুলতানা জানালেন, অফিসের নতুন সময়সূচির কারণে মেয়েকে নিয়ে তিনি এদিন আধা ঘণ্টা আগেই রওনা দিয়েছেন, কিন্তু যানজট এড়াতে পারেননি।
“সড়কে প্রাইভেটকারগুলো যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বাচ্চাদের স্কুল ও অফিসের সময়সূচি একসময় করা উচিত হয়নি।”
ভিকারুন্নিসা স্কুল কলেজকে কেন্দ্র করে আশেপাশের এলাকায় গাড়ির বেশ চাপ ছিল জানিয়ে রমনা বিভাগের সহকারী কমিশনার (রমনা) রেফাতুল ইসলাম বলেন, “সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত গাড়ি একসঙ্গে বের হওয়ায় চাপ পড়েছে বেশি।”
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী হয়ে চলাচলকারী গণপরিবহন গুলিস্তান, মতিঝিল, নিউ মার্কেট, মিরপুর ও গাবতলীর বিভিন্ন রুটে যায়। এই পথে সকালে যাত্রীর ভিড় বেশি থাকে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত।
তবে নতুন অফিস সূচির শুরুর দিন সকাল ৭টার আগ থেকেই বাসস্ট্যান্ডে জামায়েত হতে দেখা গেছে যাত্রীদের। কিন্তু সেই চাপ সামলানোর মত বাস রাস্তায় নেই বলে অভিযোগ করলেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের মতিঝিল শাখার কর্মী রুখসানা জামান।
৩৫ বছর বয়সী এই ব্যাংকার বলেন, ‘‘৯টায় ব্যাংক খুললেও আমাদের আধা ঘণ্টা আগেই হাজির হতে হয় শাখায়। প্রথম দিন হওয়ায় আগভাগেই সাড়ে ৭টার দিকে আসলাম। কিন্তু ৪০ মিনিটের মত অপেক্ষা করছি… কোনো বাসেই উঠতে পারিনি। বাস আসলেই সবাই হুড়মুড় করে ওঠার চেষ্টা করছেন।”
পরে ঢাকামুখী দূর পাল্লার একটি বাস যাত্রী তোলায় তাতে চড়ে বসার সুযোগ পান রুখসানা।
সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মাতুয়াইল, শনির আখাড়া, কাজলা বাস স্ট্যান্ডে দেখা গেছে যাত্রীতে ঠাসা। গণপরিবহণ কম থাকায় যাত্রী ওঠানামার নির্দিষ্ট জায়গার পরিবর্তে অনেক এগিয়ে সড়কের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে জটলা বাঁধতে দেখা গিয়েছে তাদের।
অনেকে জায়গায় বাসস্ট্যান্ডের আগেই বাস দাঁড় করিয়ে উঠতে দেখা গেছে যাত্রীদের। সকাল ৮টার সময়ও কাজলায় দেখা গেছে সরকারি কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কর্মীদের নিয়ে বাস। সেগুলো মতিঝিল হয়ে সচিবালয়ে যেতে আরো আধা ঘণ্টা লাগার কথা।
মো. জসিম উদ্দিন (৬০) চোখের চিকিৎসা করাতে যাবেন শ্যামলীতে, সকাল ৭টার দিকে যাত্রাবাড়ীর কাজলা বাস স্ট্যান্ডে এসে সোয়া ৮টা পর্যন্ত কোনো বাসে উঠতে পারেননি ভিড়ের চাপে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘নিরিবিলি পৌঁছানোর আশায় এত সকালে আসলাম। দেখি মানুষ আর মানুষ, কিন্তু বাস নেই সেভাবে।’’
বিমানবন্দর সড়কেও সকাল ৭টার পর থেকে যানবাহনের বেশ চাপ দেখা গেছে। বনানী, মহাখালী, কাকলী, প্রতিটি সিগন্যালেই ছিল দীর্ঘ লাইন, গাড়ি চলেছে ধীর গতিতে। বনানী সিগন্যালের যানাবাহনের লাইন আর্মি স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে বনানী ফ্লাইওভার পর্যন্ত চলে যেতে দেখা গেছে।
চেয়ারম্যানবাড়ি মোড়ে দায়িত্বপালনকারী ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মোহাম্মদ সজিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন অফিস সূচির সঙ্গে স্কুল শুরুর সময় কাছাকাছি হয়ে গেছে। ফলে একইসঙ্গে প্রচুর যানবাহন রাস্তায় আসার যানবাহনের চাপ বেড়েছে।
“অন্যদিন ৮টার পর থেকে রাস্তায় গাড়ির চাপ বাড়ে। কিন্তু আজ সাড়ে ৭টা থেকেই প্রচণ্ড চাপ গাড়ির।”
মিরপুর থেকে কালসি হয়ে যাত্রাবাড়ী রুটের বিজয় পরিবহনের চালক শামসুল হক জানালেন, সকালে মিরপুর ১ নম্বর থেকে বনানী পৌঁছাতে তার ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় লেগেছে।
“আজকে অফিসের সময় আগাইয়া আনছে। এইজন্য গাড়ি আগে বাইর করছি। রাস্তায়ও দেখলাম গাড়ির অনেক চাপ।”
আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশের সদস্য আব্দুর রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার সময় যে চিত্র থাকত সড়কে, এখন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে সেই চিত্র দেখা যাচ্ছে।”
বুধবার সকাল ৭টার আগে থেকেই মিরপুর ১২ নম্বর থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত সড়কে যানজট দেখা যায়। সড়কের মোড়ে মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন যাত্রীরা।
বেসরকারি চাকরিজীবী দেলোয়ার হোসেন বলেন, তার মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যেতে যানজটে পড়তে হয়েছে, যেটা অন্যদিন হয় না।
“আজকে আধা ঘণ্টা আগে বের হয়েছিলাম, নইলে সময়মত ক্লাসে পৌঁছানো যেত না। ওর স্কুলে পৌঁছাতে ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে। আজকে ৪০ মিনিট লেগেছে।”
মিরপুরের ইসিবি ক্যান্টিন থেকে কালশি মোড় পর্যন্ত গাড়ির চাপ বেশি থাকায় যানজট দেখা যায়। মহাখালীতে একটি সিএ ফার্মের কর্মকর্তা রাশেখ উর রহমান জানান, অন্যান্য দিনের তুলনায় তাকে বেশি যানজটে পড়তে হয়েছে।
“আজকে রাস্তায় গাড়ি বেশি। আর যানজটও দেখছি, যেটা গত কিছুদিন দেখিনি। গাড়ি পেতেও আজকে সময় বেশি লেগেছে। রাস্তায় মানুষও বেশি, অনেক মানুষ গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।”
আগারগাঁও থেকে শ্যামলী এবং ৬০ ফিট সড়কের প্রবেশমুখেও যানজট দেখা গেছে সকাল ৮টার দিকে। মোটরবাইক সেবা পাঠাওয়ের চালক শাহীন মিয়া বলেন, “আমি সকাল ৭টায় বাসাবোর বাসা থেকে বের হয়ে আগারগাঁও এসেছি। আজ অনেক সকালেই রাস্তাঘাটে যানজট শুরু হয়ে গেছে।”
অবশ্য আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল ডকুমেন্টেশন সেন্টার-ব্যান্সডক এর কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমানের মনে হয়েছে, নতুন অফিস সূচিতে যানজট কিছুটা হলেও কমেছে।
"সকাল ৭টার মধ্যে সরকারি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা রাস্তায় বের হচ্ছেন। তার এক ঘণ্টা পর বেসরকারি অফিস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের লোকজন রাস্তায় বের হচ্ছে। সেই দিক থেকে জ্যাম কিছুটা কমেছে বলে মনে হয়। সকাল ৮টায় মিরপুর ৬৯ ফুট সড়কের চিত্র দেখেও তাই মনে হয়েছে।"
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক গুলশান বিভাগের সহকারী কমিশনার আশফাক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্কুল এবং অফিস একই সময় হওয়ায় মহাখালী, জোয়ার সাহারা, র্যাডিসন হোটেল পর্যন্ত এই চাপটা বেশ ছিল। সাড়ে ৯টার পর ঠিক হয়ে যায়। আস্তে আস্তে কমে আসে।"
অফিসের নতুন সময়সূচি শুরুর প্রথম দিন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে ঠিক সময়ে এসেছেন। আবার ৮টার পরেও অনেককে অফিসে ঢুকতে দেখা গেছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ঠিক সময়েই সচিবালয়ে আসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “কর্মঘণ্টা কমলেও জনগণকে সেবা কমবে না। অপরদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয় হবে।”