Published : 19 Dec 2022, 05:47 PM
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশেও যে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। উপকূলের বদলে যাওয়া পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার নারী ও শিশুরাও জানালেন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কথা।
জলবায়ুর বদলে স্থানীয় প্রভাব নিয়ে ভাবাচ্ছে চৌদ্দ বছর বয়সী সানজিদা ইসলামকে।
পরিবেশ নষ্ট না করার আহ্বান জানিয়ে এই কিশোরী বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জীবনে অনেক প্রভাব ফেলছে। আমাদের পাশেই রয়েছে মোংলা বন্দর।
”আমাদের এখানে প্রতি বছর গরমের সময় দিন দিন গরম যেন বাড়ছেই। আবার ভারী বৃষ্টিপাত হলে আমাদের বাসার নিচে পানি জমে যায় আমাদের দোকান তলিয়ে যায় যা আগে কখনই দেখিনি।“
উপকূলবাসী হিসাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা ইসলাম। তার কাছে মনে হচ্ছে, প্রাকৃতিক বদলের প্রভাব পড়ছে জীবন এবং কাজেও।
সানজিদা ইসলাম বলেন, ”আমাদের ঘের রয়েছে, সেখানে দেখেছি অতিরিক্ত গরমে মাছ মারা যাচ্ছিল, আবার ভারী বৃষ্টিপাতে ঘের তলিয়ে গিয়েছিল।
”আগে নভেম্বর-ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে অনেক ঠাণ্ডা পড়ত। স্কুলে পরীক্ষার সময় শীতের কারণে যেতে কষ্ট হত। এখন ডিসেম্বর মাসেও আগের মত ঠাণ্ডা এখন পড়ে না। অক্টোবর মাসে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং হয়েছিল, প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি এবং জলাবদ্ধতার কারণে বিদ্যালয়ে যেতে পারিনি। আমার মা-বাবা চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকেই বলছেন জলবায়ু বদলের কারণে এসব হচ্ছে।“
মোংলা উপজেলার চাদঁপাই ইউনিয়নের পাকখালী গ্রামের বাসিন্দা বিশ বছর বয়সী রিয়াজ শেখ। জলবায়ুর এই পরিবর্তনে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
চোখের সামনে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা রিয়াজ শেখ বলেন, “যখন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস হয় বাসস্থান হারানোর ঝুঁকি থাকে ।
”লবণাক্ত পানি ঢুকে যাওয়ার কারণে নিরাপদ পানি এবং খাদ্য সংকটে পড়েছে, ফসল চাষ ঝুঁকির মুখে পড়েছে।“
জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে মানুষ আবাস হারাচ্ছে এবং এক স্থান থেকে সরে আরেক স্থানে যেতে বাধ্য হচ্ছে। লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে শিক্ষার্থীদের।
রিয়াজ শেখের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল জলবায়ু পরিবর্তন এসব দিকও।
তিনি বলেন, ”ঝড়ে-বন্যায় পানি উঠলে বিদ্যালয়গুলো নদীর ভিতরে চলে যায়। ঘরবাড়ি, স্কুল তলিয়ে গেলে বাচ্চারা আর লেখাপড়া করতে পারে না।
”দুর্যোগকালীন সময়ে আমাদের বিদ্যালয়গুলো সাইক্লোন শেলটার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।”
”দুর্যোগকালীন সময়ে আমাদের বিদ্যালয়গুলো সাইক্লোন শেলটার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।তখনও লেখাপড়ার করার সুযোগ থাকে না। অনেকেই বাসস্থান হারিয়ে উন্নত জীবনের জন্য শহরমুখী হচ্ছে। অনেকের পরিবারে সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আর মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়েছে।”
সরকারের কাছে সংকট থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা জানিয়ে রিয়াজ শেখ বলেন, “নিরাপদ খাদ্য এবং পানির সুব্যবস্থা করা খুব জরুরি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝায় গর্ভবতী মা এবং বৃদ্ধ লোকেরা, প্রতিবন্ধীরা নানা ঝুঁকির মুখে পড়ছে।তাদের সেই সময়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকলের সাহায্য দরকার আমাদের।”
উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মোংলা এলাকার কয়েকজনও জানালেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে তাদের সন্তানদের উপর। উপায়হীন পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে উপার্জন করতে বাধ্য করছে।
স্থানীয়রা বলছেন, আগের চেয়ে নদী এবং পুকুরের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে।ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। আর এই লবানাক্ত পানি ব্যবহার করায় নানা রোগে ভুগছেন অনেকে।
ত্রিশ বয়সী শরণখোলার সুমাইয়া পারভীন ওয়াশ অ্যান্ড সিএসও মোবিলাইজার হিসেবে কাজ করছেন একটি এনজিওতে।।
তার ভাষ্যে, জলবায়ুর পরিবর্তনে নারী সহ সবার স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
নিজে ’গাইনি’ স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন জানিয়ে সুমাইয়া পারভীন বলেন, “ আমি চিন্তিত ছিলাম ,পরে চিকিৎসা পরামর্শ নেওয়ার পর জানতে পারলাম লবণাক্ত পানির কারণে এমন হচ্ছে। শুধু আমার না অনেকই নারীরই এমন সমস্যা।
”এদিকে মাসিকে অনেকেই কাপড় ব্যবহার করে এখনও। কিন্তু সেই কাপড় লবণাক্ত পানিতে ধুয়ে ব্যবহার করার মত পরিবেশ থাকে না। ফলে জরায়ু সমস্যাসহ নানারকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নারীরা।”
”তাছাড়া শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, অনেকেরই অ্যাজমা-এলার্জি দেখা যায়। লবণাক্ততা বেশি হওয়ায় তাপমাত্রা বেশি থাকে। শরীর কড়া হয়ে যায়।”
মা ও শিশু পুষ্টি নিয়ে কাজ করা এনজিওকর্মী সুমাইয়া পারভীন বলেন, "আমি বিগত তিন চার বছর ধরে এখানে থাকছি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো উপকূলীয় এলাকায় বেশি বোঝা যায়।“
বাগেরহাটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান বললেন, “ উপকূলীয় এলাকায় এলাকায় লবণাক্ত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ত পানি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মা-বোনেরা লবণাক্ত পানি পান এবং ব্যবহারের কারণে গর্ভপাত, চুল পড়া, জরায়ু সমস্যা, জরায়ু সংক্রমণ, সাদাস্রাব সমস্যায় ভূগছে। বর্তমানে এলার্জি, চর্মরোগ, ভাইরাস ও ছত্রাক জনিত রোগে নারী ও শিশু উভয়ই আক্রান্ত হচ্ছে।”
দূর্যোগকালে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও চিকিৎসা সেবা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাগেরহাট সদর হাসপাতাল ছাড়া আর কোনো হাসপাতালে গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। তবে আমরা বিষয়টি জানার পর থেকে বাগেরহাটের স্বাস্থ্য বিভাগ, জেলা প্রশাসন বিষয়টি দ্রুত সমাধানের জন্য কাজ করছি।
“আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে দূর্যোগের সময় সতর্ক থাকতে বলি। লবণাক্ত পানি না ব্যবহার করার জন্য আমরা পরামর্শ দিই। নারী ও শিশুদের এলার্জি, চর্মরোগ, পানিবাহিত রোগ, জরায়ু সমস্যা হলে দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরমর্শ নিতে হবে।"
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. তুহিন রায় বলেন, "গ্রিন হাউজের প্রভাব ও সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল খুবই ঝুকিঁপূর্ণ এলাকা। গ্রিন হাউজের প্রভাবে আমরা এটা জানি যে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার এক সময় এলাকাগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে। যেটির নমুনা আমরা এখন চোখের সামনে দেখতে পাই।
”জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন দূ্র্যোগের কারণে নারী এবং শিশু সন্তানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কারণ সমাজের দূর্যোগের সময় তারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। দুর্যোগের পূর্বে, দূর্যোগের সময়, দূর্যোগের পরে সব বয়সের মানুষই অরক্ষিত থাকে। বিশেষ করে নারীরা সাইক্লোন সেন্টারে গেলে নিরাপদ থাকে না, শিশুরা খেতে পারে না, পুষ্টিহীনতায় ভোগে। দূর্যোগের সময় শিশুরা পানিবাহিত রোগের শিকার হয়। কখনও কখনও লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।“
এর কি কোনো সমাধান রয়েছে?
ড. তুহিন রায় বলেন, ”আসলে প্রতিটা সমস্যার সাথে প্রতিটা সমস্যা যুক্ত । যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন জলবায়ু পরিবর্তন হবে। দূর্যোগ নির্মূল না করা গেলেও ক্ষতি কমানো সম্ভব।
”এখন বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবেলায় রোল মডেল।সরকারি ,বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং উপকূলীয় অঞ্চলের সম্মলিত প্রচেষ্টায় সচেতনতার মাধ্যমে উপকূলীয় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব।”
”গাছপালা কর্তন, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার, কার্বন নিঃসরণ এভাবে করতে থাকলে ভবিষ্যতে হয়ত প্রকৃতি আমাদের পক্ষেথাকবে না। পরিবেশকে নষ্ট করে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনা যাবে না। যার দায়িত্ব তার পালন করতে হবে। তাহলেই উপকূলবাসী ক্ষয়ক্ষতির তাহলেই উপকূলবাসী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে এনে একটি দূর্যোগ সহিষ্ণু অঞ্চল গড়ে তুলতে পারবে।"
আপনার নিবন্ধিত ইমেইল থেকে অপ্রকাশিত লেখা/ছবি/ভিডিও আকারে নাগরিক সংবাদ পাঠান [email protected] ঠিকানায়।
নিবন্ধিত নাগরিক সাংবাদিক হতে আপনার নাম (বাংলায়), ঠিকানা, ফোন নম্বর, ইমেইল আইডি এবং ছবি সহকারে [email protected] ঠিকানায় ইমেইল করুন।