Published : 25 Jul 2024, 12:01 AM
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাতের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ফিরছে স্বস্তির পরিবেশ; তবে কোটা সুবিধা থেকে বাদ পড়ে যাওয়ায় নারীসহ সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী আরও পিছিয়ে পড়বে বলে মনে করছেন অধিকার কর্মীরা।
আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী সরকার কোটা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন করেছে; যাতে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে মোট ৭ শতাংশ কোটা থাকবে, মেধারভিত্তিতে নিয়োগ হবে ৯৩ শতাংশ। কোটার মধ্যে ৫ শতাংশ থাকবে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকরা ১ শতাংশ কোটায় চাকরি পাবেন।
অধিকার কর্মীরা বলছেন, নতুন এ বিন্যাসে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশকে যথাযথভাবে বিবেচনায় আনা হয়নি। এতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অনেকের সুযোগে কমেছে, বাদও পড়েছে উল্লেখযোগ্য অংশ। নারীর অগ্রযাত্রাও কমে যাবে।
তবে আশা দেখছেন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী। প্রথমবারের মত অবহেলিত এসব নাগরিকদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা বরাদ্দ রাখায় বৈষম্য কমার সম্ভাবনা দেখছেন তারা।
মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির মনে করেন, নতুন বিন্যাসে পিছিয়ে পড়া অনেকে বঞ্চিত হবেন। হরিজন সম্প্রদায়ের মত যারা অনেক পিছিয়ে রয়েছে, তাদের জন্যও একটা কোটা থাকার প্রয়োজন রয়েছে।
“যদি এমন হত যে, ৭ শতাংশ কোটা থাকবে এবং এর মধ্যে যারা পিছিয়ে পড়া-তাদের এই সুযোগটা দেওয়া হবে, তাহলে ব্যাপারটা ঠিক হত।”
কোটায় যেসব পরিবর্তন এসেছে
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা তুলে দিয়েছিল সরকার। সেই পরিপত্র বাতিল করে গত জুনে কোটা ফিরিয়ে আনার রায় আসে হাই কোর্ট থেকে।
এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে দেশজুড়ে সহিংসতায় প্রাণহানি ও সরকারি স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। নজিরবিহীন নৈরাজ্যের মধ্যে জারি করা হয় কারফিউ।
রোববার হাই কোর্টের রায় বাতিল করে ৭ শতাংশ কোটা রেখে এর নতুন বিন্যাসও ঠিক করে দেয় আপিল বিভাগ।
রায়ে বলা হয়, “এই নির্দেশনা ও আদেশ প্রদান সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজন ও সার্বিক বিবেচনায় এই আদালত কর্তৃক নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।”
এর দুদিন পর মঙ্গলবার সরকার আদালতের রায় মেনে কোটার নতুন বিন্যাস প্রকাশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
সব সরকারি নিয়োগে অগ্রাধিকার সুবিধা ৫৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনায় বাদ পড়েছে নারী ও জেলা কোটা। ২০১৮ সালের আগে এই দুই কোটার জন্য ১০ শতাংশ করে ২০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল।
বাদ পড়েছে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরাও; এই কোটা ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে কেবল মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ কোটা কমিয়ে আনা হয়েছে। এখন থেকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের আগের ১ শতাংশ কোটায় যুক্ত হয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীরা।
প্রতিবন্ধীরা ‘ক্ষতিগ্রস্ত হবে’
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সালমা মাহবুব বলছেন, ১ শতাংশ কোটায় তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদেরও যুক্ত করায় প্রতিবন্ধী মানুষদের সুযোগ আরও কমে গেল।
“অপ্রতিবন্ধী মানুষের সাথে প্রতিবন্ধীদের যুক্ত করে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বাধাটা সামাজিক। তারা তো সবই করতে পারছেন, যে কোনো জায়গায় যেতে পারছেন। নিজেদের কথাটা বলতে পারছেন। আর প্রতিবন্ধীদের বাধাটা শারীরিক। আমাদের সুযোগটা এখানে কমে যাবে। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।”
বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাসের (বি-স্ক্যান) এই সাধারণ সম্পাদক, কোটার ক্ষেত্রে অন্য কোনো অনগ্রসর গোষ্ঠীকে প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে না মেলানোর দাবি জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “২ শতাংশ কোটা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ২ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ১ শতাংশ তৃতীয় লিঙ্গ এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটা ২ শতাংশ করার দাবি ছিল আমাদের।”
‘পিছিয়ে পড়বে’ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করায় সমাজে অসমতা সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ বলছেন, বাংলাদেশে যে বাস্তবতায় এই জনগোষ্ঠীর জীবন এগিয়ে চলেছে, তাতে কোটা সুবিধা কমায় তাদের ‘উঠে আসার পথটা ভেঙে পড়েছে’।
তিনি বলেন, এর ফলে টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা অর্থাৎ সমতা, ন্যায্যতা, দক্ষতাভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক সমাজ গঠনে আদিবাসীরা পিছিয়ে পড়বে।
“আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কোটা হ্রাস করার এখনই উপযুক্ত সময় নয়। বরং যৌক্তিক ও সাংবিধানিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় আদিবাসীদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের দাবি জানাচ্ছি আমরা।”
তার যুক্তি, “আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে তেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। আমাদের বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হতে হয়। আমাদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে থাকে। প্রায় সময়ই ভিটা-মাটি রক্ষায় সংগ্রাম করতে হয়।
“আমাদের মাতৃভাষা থেকে বাংলায় পড়াশোনা করে একটা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অনেক কঠিন।”
নারীর অগ্রযাত্রা ‘থমকে যাবে’
কোটা সংস্কার আন্দোলনে বড় সংখ্যক নারী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের অংশগ্রহণ দেখা গেলেও সার্বিক বিচারে সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ আরও কমে যাবে বলে মনে করছেন নারী অধিকার কর্মীরা।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় নারী কোটা বাদ দেওয়ার উপযুক্ত সময় এখনও আসেনি।
মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানুর মতে, নারীর অগ্রযাত্রায় যেসব পদক্ষেপ ভূমিকা রেখেছিল, তার একটি কোটা সুবিধা।
“এখনও তো সব জায়গায় নারীর অবস্থান নিশ্চিত হয়নি। সেখানে নারী কোটা না থাকলে এতোদিন নারীর অগ্রযাত্রার যে ধারাবাহিকতা, সেটা অবশ্যই নষ্ট হবে এবং নারীরা পিছিয়ে পড়বে।”
নারী কোটা রাখতে সোমবার সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে মহিলা পরিষদ।
মালেকা বানু বলেন, “আমরা বুঝতে পারছি, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে এই রায়ে। কিন্তু রায়ে তো বলাও আছে যে, নির্বাহী বিভাগ চাইলে তার মত করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আমরা মনে করি, চাকরিতে নারী কোটা রাখতেই হবে।”
কোটা না থাকলে নারীরা চাকরিতে পিছিয়ে পড়বে মন্তব্য করে নিজেরা করি এর সমন্বয়কারী খুশি কবির বলেন, “যারা আন্দোলন করছিল, তারা বলেছে, নারী কোটার দরকার নেই। কিন্তু দেশে নারীরা এখনও পিছিয়ে। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা এখনও রয়েছে। সেখানে কোটা না থাকলে নারীরা সুযোগ পাবে না।”
নারী কোটা বাদ পড়ায় হতাশ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক হারুন হাবীব বলছেন, “কোটার কারণে সাম্প্রতিক কালে বিপুল সংখ্যক নারী বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা হয়েছেন। শিক্ষার্থীরা চাইলো কি না চাইলো, সেজন্য নয়- বরং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় নারী কোটা রাখার প্রয়োজন ছিল।”
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ইউরোপে ৪৪ শতাংশ কোটা রয়েছে, যার মধ্যে নারী কোটাও রয়েছে।
“কিন্তু আমাদের নারী কোটা নেই। ১০-১৫ বছর পর হয়ত দেখা যাবে, উচ্চ পর্যায়ে নারীদের সংখ্যা কমে যাবে। যারা আন্দোলন করেছে, তারা কি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের সংগ্রামের কথা জানে? ঢাকা শহরের স্কুলে তো তারা পড়ালেখা করতে পারেনি। তবে সরকার যৌক্তিকভাবে এই কোটার পরিমাণ পরিবর্তন, পরিমার্জন করতে পারে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, “দেশে সরকারি চাকরি করে ১৫ লাখের কিছু বেশি মানুষ। আর প্রতি বছর ২৬-২৭ লাখ গ্রাজুয়েট চাকরির বাজারে ঢোকে। সবাই তো সরকারি চাকরি করে না।”
সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান মনে করেন, কিছুদিন পরেই সমাজে নারী কোটা রাখার প্রয়োজন অনুভূত হবে, তখন হয়ত এটি আবার বিবেচনা করা হবে।
নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি বিসিএসের ভাইভায় যাই, আমি দেখেছি, কোটা বন্ধ হওয়ার পরে ৫-৬ শতাংশ নারী মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। নারী কোটা না থাকায় নারীরা যে পিছিয়ে পড়বে, সেটি আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।
অতিদরিদ্র ও অনগ্রসরমান জনগোষ্ঠীর জন্যও কোটা থাকার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন নজরুল ইসলাম খান।
’মুক্তিযোদ্ধারা কেউই কোটার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি’
সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবিবের ভাষ্য, মুক্তিযোদ্ধারা কেউই কোটার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। সময়ের প্রয়োজন ও দেশপ্রেম থেকে তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং জীবন উৎসর্গ করেছিল।
“আমি নিজেও চাচ্ছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা কোটা যুক্তিসঙ্গত হারে কমিয়ে আনতে হবে এবং সেটাই সরকার করেছে।”
পঁচাত্তর পরবর্তী বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, “দীর্ঘ ২১ বছর মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণ তো হয়ইনি বরং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সমাজে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, তাদের চাকরিতে যাওয়ার সময় চলে গেল।”
ক্ষুব্দ এই মুক্তিযোদ্ধা বলছেন, এবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যে আবহ তৈরি করা হয়েছে তা শুধু দুঃখজনকই নয়, অপমানজনকও।
হারুন হাবিব বলেন, “আমি মনে করি, যে রায় দেওয়া হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতাকে সম্মানিত করেছে। আমি মনে করি, মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ শতাংশ কোটা দেওয়ার কোনো প্রয়োজনও ছিল না।
“এবার আন্দোলনে বোঝানো হল যে, মুক্তিযোদ্ধারাই সব সুবিধা পেয়ে যাচ্ছেন। সেটা আমার কাছে খুবই অশনি সংকেত মনে হয়েছে। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কতটা ত্যাগে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেটা জানার জন্য তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা উচিত। তা না হলে যোগ্য মেধাবী বা যোগ্য নাগরিক গড়ে ওঠা সম্ভব না।”
এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “আমাকে সবচাইতে বেশি হতচকিত এবং আতঙ্কিত করেছে যে, আমাদের তরুণ সমাজের একটি অংশ যেভাবে নিজেদের রাজাকার বলে গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করেছে। তারা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে অভিশপ্ত একটি শব্দকে নিজের বলে দাবি করছে, সেটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগ্যজনক মনে হয়েছে।”
‘আশা দেখছেন’ তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা
প্রথমবারের মত তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা বরাদ্দ রাখায় বৈষম্য ঘোচানোর আশা দেখছে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী।
এই জনগোষ্ঠীদের সংগঠন ‘তেহাই: অ্যান ইন্টারডিসিপ্লিনারি আর্ট ইনিশিয়েটিভের’ পরিচালক একরামুল মোমেন বলেন, “তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য কোটা রাখায় এটি তাদের জন্য সম্মানজনক হয়েছে।
“তারা নিজেদের জেন্ডার আইডেনটিটিটা প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু কোটা রাখার ফলে তারা তাদের পরিচয় দিতে পারবে। তাদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হল।”