Published : 18 Jun 2025, 08:40 AM
‘অনেক দিন পর উনি বড় ইনিংস খেলেছেন, দেখে খুব ভালো লেগেছে’- গল টেস্টের প্রথম দিন মুশফিকুর রহিমের সেঞ্চুরির পর বলছিলেন অমিত হাসান। নিজের আদর্শ ক্রিকেটারের দীর্ঘ রানখরা দূর হওয়ার আনন্দ স্পষ্টই ফুটে উঠছিল তরুণ ব্যাটসম্যানের কণ্ঠে। ক্যারিয়ার গোধূলিতে পৌঁছে যাওয়া মুশফিকের ব্যাটিং হয়তো আর বেশি দিন দেখার সুযোগ পাবেন না অমিত। অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের বিদায়ের পর সেই শূন্য জায়গা পূরণে বড় দাবিদার হতে পারেন তিনি নিজেই!
মুশফিকের মতো অমিতও কিপার-ব্যাটসম্যান। ব্যাটিং করেন মিডল-অর্ডারেই। ৩৯ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারে বাজতে শুরু করেছে বিদায়ের রাগিণী। অমিত সেখানে যাত্রা শুরুর অপেক্ষায়। তবে তাড়াহুড়ো নেই ২৩ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের। ঘরোয়া ক্রিকেট মাতানো অমিত বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করেই পা রাখতে চান আন্তর্জাতিক আঙিনায়।
‘এ’ দলের হয়ে সাদা পোশাকে ৪টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন অমিত। সবশেষ গত মাসে নিউ জিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে ২টি ও গত বছর অস্ট্রেলিয়া সফরে পাকিস্তান শাহিন্সের (পাকিস্তান ‘এ’) সঙ্গে খেলেন ২টি চার দিনের ম্যাচ।
দুই সিরিজেই একটি করে পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংস খেলেন তিনি। কিউইদের বিপক্ষে মিরপুরে বেশ কিছু দারুণ শটে ৮ চার ও ১ ছক্কায় করেন ১১০ বলে ৬৭ রান। শাহিন্সের বিপক্ষে খেলেছিলেন ৭১ রানের ইনিংস। সব মিলিয়ে ৮ ইনিংসে ৩২.৭১ গড়ে সংগ্রহ ২২৯ রান।
ঘরোয়া ক্রিকেটে অমিতের রেকর্ড দুর্দান্ত। এখন পর্যন্ত ৩৪ ম্যাচে ৯ সেঞ্চুরিতে ৫৩.৭৪ গড়ে করেছেন ২ হাজার ৬৩৩ রান। দুই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, ‘এ’ দলের সঙ্গে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মানের পার্থক্য।
অমিত নিজেও টের পান সেটি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, কিউইদের বিপক্ষে চ্যালেঞ্জ ছিল বেশি।
“ঘরোয়া ক্রিকেটের চেয়ে অবশ্যই একটু আলাদা ছিল ‘এ’ দলের ম্যাচগুলো। (নিউ জিল্যান্ড ‘এ’ দলের) সবাই ভালো ক্রিকেটার। একটু চ্যালেঞ্জিং ছিল। ওদের বোলারদের অ্যাকুরেসি খুব ভালো ছিল। নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় বোলিং করেছে। তাই চ্যালেঞ্জও একটু বেশি ছিল। ঘরোয়া ক্রিকেটের তুলনায় ভিন্ন।”
‘এ’ দলের জার্সিতে এখন পর্যন্ত না পারলেও জাতীয় ক্রিকেট লিগ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে (বিসিএলে) নিয়মিত দেখা যায় অমিতের বড় ইনিংস। সবশেষ জাতীয় লিগেই যেমন চতুর্থ রাউন্ডের ম্যাচে ৬৩৮ মিনিট ব্যাটিং করে ৪৫৫ বল খেলে ২১৩ রানের ইনিংস খেলে সাড়া ফেলে দেন সিলেট বিভাগের অধিনায়ক।
লিগে তিনি সেঞ্চুরি করেন আরও ১টি। সব মিলিয়ে ১২ ইনিংসে ২ শতক আর ৫ ফিফটিতে ৭৮.৫০ গড়েন করেন আসরের সর্বোচ্চ ৭৮৫ রান। ২০১৫ সালে শাহরিয়ার নাফীসের পর জাতীয় লিগের এক আসরে তিনিই প্রথম স্পর্শ করেন ৭০০ রানের মাইলফলক।
ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন তিনি সাদা বলের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও (ডিপিএল)। প্রিমিয়ার লিগে ফেরা অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে ১ সেঞ্চুরির সঙ্গে ৩ ফিফটিতে করেন আসরের চতুর্থ সর্বোচ্চ ৬১৪ রান।
২০১৯ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ ধারাবাহিক অমিত। সিলেটের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচেই তিনি করেন সেঞ্চুরি। তবু প্রথম দুই আসরে নিয়মিত সুযোগ হয়নি তার।
২০২১-২২ মৌসুমে জাতীয় লিগ ও বিসিএলে নিয়মিত খেলার সুযোগ পেয়ে তিনি দেখান দুর্দান্ত ধারাবাহিকতা। দুই আসর মিলিয়ে ১০ ম্যাচে ৪ সেঞ্চুরি ও ২ ফিফটিতে ৬০.৮০ গড়ে তিনি করেন ৯১২ রান। পরের দুই মৌসুমে ১টি করে সেঞ্চুরি করেন অমিত।
সবশেষ এনসিএলের দারুণ পারফরম্যান্সে জাতীয় দলের খুব কাছে পৌঁছে যান তরুণ মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান। গত বছরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে নাজমুল হোসেন শান্ত চোটে পড়লে বদলি হিসেবে তার সুযোগ পাওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল জোরেশোরে।
শেষ পর্যন্ত ওই সফরে জায়গা হয়নি অমিতের। এসব নিয়ে তেমন ভাবতেও চান না। বরং ‘এ’ দলের হয়ে আরও ম্যাচ খেলে আন্তর্জাতিক মঞ্চের জন্য যত বেশি সম্ভব তৈরি হতে চান।
“আমি আসলে কখনও এত লম্বা (জাতীয় দলের) চিন্তা করি না। সবশেষ যেমন এনসিএলে মনোযোগ দিয়েছি। এরপর ‘এ’ দলের খেলাগুলো ছিল। চেষ্টা করি ধাপে ধাপে চিন্তা করতে। যখন যেই খেলা থাকে, সেটায়ই মূল মনোযোগ দিয়ে খেলার চেষ্টা করি।”
“আমার মনে হয়, জাতীয় দলের আগে যেহেতু ‘এ’ দল আছে। এরকম ‘এ’ দলের যদি আরও কিছু ম্যাচ খেলা যায়, তাহলে আমাদের ক্রিকেটারদের জন্য ভালো হবে। কারণ এতে আমরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য আরও ভালোভাবে তৈরি হতে পারব।”
চলতি বছরই ‘এ’ দলের হয়ে আরও অন্তত একটি সিরিজ খেলার সুযোগ পেতে পারেন অমিত। অগাস্টে অস্ট্রেলিয়ায় দুটি চার দিনের ম্যাচ খেলার কথা বাংলাদেশ ‘এ’ দলের। আপাতত ওই সিরিজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখছেন তিনি।
অমিতের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জে হলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে সিলেটের ঘরের ছেলে হয়ে গেছেন অমিত। সেটির পেছনে একটি গল্পও আছে। ২০১৯ সালে ব্যাটসম্যান সংকটে পড়ায় তখনকার বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক হান্নান সরকারের কাছে সমাধানের খোঁজ করেন সিলেটের অলক কাপালি ও রাজিন সালেহ।
হান্নানের পরামর্শেই ঢাকা বিভাগ ছেড়ে সিলেট বিভাগের হয়ে খেলা শুরু করেন অমিত। প্রথম ম্যাচেই ১২৫ রানের ইনিংস খেলে নিজের সামর্থ্যের ঝলক দেখান তিনি।
হান্নানের কাছে অবশ্য সেটি তেমন চমক ছিল না। কারণ বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে অমিতের যাত্রা শুরুর সময় থেকেই দেখছেন জাতীয় দলের সাবেক এই নির্বাচক। হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) ইউনিটের ক্যাম্পে তার কোচিং দুই সপ্তাহ কাজও করেছেন অমিত।
দীর্ঘ দিন কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে হান্নান বললেন, জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার আগে ‘এ’ দলে খেলে আরও শক্তপোক্ত হওয়াই অমিতের জন্য হবে মঙ্গলজনক।
“অনূর্ধ্ব-১৪ থেকে আমি অমিতকে দেখছি। একটা বিষয় ভালো লাগে যে, সবসময় বড় ইনিংস খেলার ক্ষুধাটা কাজ করে ওর মধ্যে। ঘরোয়া ক্রিকেটে এজন্যই নিয়মিত অনেক রান করতে পারে। তবে জাতীয় দলের মঞ্চটা পুরোপুরি আলাদা।”
“আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সফল হতে টেকনিক্যালি একটু বেশি মজবুত হতে হয়। অমিতের কিছু ঘাটতির জায়গা আছে। আমি যত দূর জানি, সেসব নিয়ে কাজ চলছে। এর সঙ্গে ‘এ’ দলের ম্যাচগুলো যত খেলবে, ততই প্রতিদ্বন্দ্বিতাটাও বুঝতে পারবে।”
নিউ জিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে এরই মধ্যে সেই চ্যালেঞ্জ টের পাওয়ার কথা বলেছেন অমিত। ওই সিরিজের পর জাতীয় দলের নির্বাচকদের কাছ থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার বার্তা পেয়েছেন তিনি।
“এ দলের খেলার পর (নির্বাচকদের সঙ্গে) ওরকম আলাদা কোনো কথা হয়নি। সবসময় যেমন কথা বলেন, ‘ভালো খেলেছি। ভালো খেলাটা ধরে রাখতে হবে’- এসবই বলেছেন। ভিন্ন কিছু নয়। নিজের কাজটা করে সবসময় ধারাবাহিকভাবে করে যেতে বলেছেন।”
সমসাময়িক অন্য অনেকের মতো যুব বিশ্বকাপে খেলা হয়নি অমিতের। যদিও ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের প্রাথমিক ভাবনায় ছিলেন তিনি। তবে মিডল-অর্ডারে তাওহিদ হৃদয়, শাহাদাত হোসেন, মাহমুদুল হাসান জয়রা থাকায় সুযোগ দিতে পারেননি তখনকার বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক হান্নান।
গত বছর জাতীয় দলের নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরও অমিতকে দলে নেওয়ার খুব কাছে ছিলেন হান্নান। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে তিনি বলেছিলেন, প্রতিটি ধাপে অমিতকে পরীক্ষা করে নিতে চান তারা।
সেই প্রক্রিয়ায় আরও কিছুটা পথ এগিয়েছেন অমিত। জাতীয় দলের নির্বাচকের দায়িত্ব ছেড়ে কোচিংয়ে মন দেওয়া হান্নানের মতে, ৩৮ পেরোনো মুশফিকের অবসরের পর শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেন এই ছেলেটিই।
“অমিত জাতীয় দলের কাছাকাছিই আছে। টেস্ট দলের ব্যাটিং অর্ডার এখন মোটামুটি স্থির আছে। তবে মুশফিক ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে। তার বিদায়ের পর ৪-৫ নম্বরে অমিত অবশ্যই বড় দাবিদার হবে। পূর্বশর্ত একটাই, ঘরোয়া বা ‘এ’ দলের হয়ে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে হবে।”