Published : 15 Oct 2022, 02:02 PM
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মানেই ঘটনার ঘনঘটা। বিশ্বমঞ্চেও হয়ে গেছে এমন অনেক নাটকীয়তা। কিছু কিছু ঘটনা স্থায়ী জায়গা পেয়ে গেছে ক্রিকেটের রূপকথায়, কিছু আবার আলাদা জায়গা নিয়ে আছে বিশ্বকাপ ইতিহাসে।
বিস্ফোরক শুরু
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ভালোভাবে জেঁকে বসার আগেই এই সংস্করণের বিশ্বকাপ শুরু করে দেয় আইসিসি। বিশ্বকাপের আগে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি হয়েছিল মোটে ১৯টি। তবে বিশ্বকাপের শুরুটাই হয় যাকে বলে ‘ব্লকবাস্টার।’ প্রথম ম্যাচেই একদম ধুন্দুমার ক্রিকেট!
জোহানেসবার্গে সেদিন ১০ ছক্কায় ৫৭ বলে ১১৭ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন ক্রিস গেইল। বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরি চলে আসে প্রথম ম্যাচেই। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিরও সেটি প্রথম শতরান। ২০ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করে ২০৫ রান।
তবে ঘরের মাঠে দর্শকে ঠাসা গ্যালারিকে উল্লাসে মাতিয়ে সেই পাহাড় টপকে জিতে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ৫৫ বলে অপরাজিত ৯০ রানের ইনিংস খেলেন হার্শেল গিবস। জাস্টিন কেম্প করেন ২২ বলে অপরাজিত ৪৬। দুজনের জুটিতে আসে ৫৭ বলে ১২০ রান।
ম্যাচ সেরা হন গেইল, ম্যাচ জিতে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু আসল জয়টা হয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের, বিশ্ব আসরের জন্য এমন উন্মাতাল শুরুই তো প্রয়োজন ছিল!
ভারত ৩ : ০ পাকিস্তান
ইতিহাসে ওই একবারই ক্রিকেট ম্যাচের ফল হয়েছিল ফুটবল ম্যাচের মতো। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে ৩-০তে হারিয়েছিল ভারত!
ওই ফলাফল হয়েছিল টাইব্রেকারে, যেটির কেতাবি নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বোল আউট।’ আইসিসি এই ব্যবস্থা নিয়েছিল ‘টাই’ ম্যাচের জন্য। অনেকটা ছিল ফুটবলের টাইব্রেকারের মতোই। দুই দল থেকে ৫ জন করে মনোনীত করতে হতো, ২২ গজে একে একে বোলিং করে বল লাগাতে হতো ফাঁকা স্টাম্পে। যে দল বেশিবার লাগবে, তারা জয়ী।
ডারবানে সেদিন ১৪২ রান তাড়ায় এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল ১৪ বলে ৪২ রান। মিসবাহ-উল-হক বিশ্বক্রিকেটে নিজেকে প্রথম জানান দেন সেদিনই। শেষ দিকে ঝড়ো ব্যাটিংয়ে দলকে তিনি নিয়ে যান জয়ের কিনারায়। শেষ ২ বলে প্রয়োজন পড়ে স্রেফ ১ রানের।
তখন আরেক দফা নাটকীয়তা। শ্রীশান্থের করা ওই ওভারে পঞ্চম বলে রান নিতে পারেননি মিসবাহ, শেষ ওভারে সিঙ্গেল নিতে গিয়ে হয়ে যান রান আউট। ম্যাচ ‘টাই।’
এরপর সেই বোল আউট। সেখানে পাকিস্তান ভরসা রাখে তাদের মূল বোলারদের ওপর। কিন্তু চমকপ্রদভাবে ভারত বেছে নেয় স্পিনারদের এবং পার্ট টাইমারদের। পাকিস্তানের পেসার ইয়াসির আরাফাত ও উমর গুল বড় রান আপ নিয়ে ছুটে এসে ব্যর্থ হন স্টাম্পে লাগাতে। ভারতের হয়ে বিরেন্দর শেবাগ ও হরভজন সিং হালকা দৌড়ে এসে আলতো করে বল ছুড়ে লাগান স্টাম্পে।
ভারতের তৃতীয় বলটি করেন অনিয়মিত বোলার রবিন উথাপা। তিনিও সফল হন স্টাম্পে লাগাতে। পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদির বল চলে যায় লেগ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে। ৩-০তে জিতে বাঁধনহারা উদযাপনে মেতে ওঠে ভারত।
বাংলাদেশের চমক
প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুইশ ছাড়ায় যে দল, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েই বিস্ময় উপহার দেয় বাংলাদেশ। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান ক্রিস গেইল এবার শূন্য রানে বিদায় নেন সৈয়দ রাসেলের বলে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০ ওভারে তোলে ১৬৪ রান।
রান তাড়ায় বাংলাদেশ দুই ওপেনারকে দ্রুত হারালেও তা বুঝতেই দেননি আফতাব আহমেদ ও মোহাম্মদ আশরাফুল। চোখধাঁধানো সব স্ট্রোকের মহড়ায় অসাধারণ পাল্টা আক্রমণে তাক লাগিয়ে দেন দুজন। ২০ বলেই পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেলেন অধিনায়ক আশরাফুল, সেসময় যা ছিল টি-টোয়েন্টিতে দ্রুততম ফিফটির বিশ্বরেকর্ড।
২৭ বলে ৬১ করে আউট হন আশরাফুল। আফতাব অপরাজিত থাকেন ৪৯ বলে ৬২ রানে। বাংলাদেশ ৬ উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয় ২ ওভার বাকি রেখেই।
এই ম্যাচের আগের দিনই অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম অঘটনের জন্ম দেয় জিম্বাবুয়ে।
যুবরাজের ৬ ছক্কা
২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত ওভারে ছয় ছক্কার কীর্তি ছিল কেবল স্যার গ্যারি সোবার্স ও রবি শাস্ত্রীর। দুটিই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। ২০০৭ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে হার্শেল গিবস আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে উপহার দেন ওভারে ছয় ছক্কার প্রথম নজির।
গিবসের ৬ মাস পরই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মধ্যে এই তাণ্ডব চালান যুবরাজ সিং। ডারবানে ভারতীয় ইনিংসের ১৯তম ওভার সেটি। ব্রডের প্রথম বলে স্লগ করে ওয়াইড লং অন দিয়ে বল মাঠের বাইরে পাঠান যুবরাজ। পরের বলটি গ্যালারিতে ফেলেন তিনি কবজির মোচড়ে নান্দনিক ফ্লিকে।
তৃতীয় বলটি ব্রড করেন অফ স্টাম্পের বাইরে হাফ ভলি। যুবরাজ উড়িয়ে দেন লং অফ দিয়ে। এবার অ্যাঙ্গেল বদলে রাউন্ড দা উইকেটে আসেন ব্রড। কিন্তু বলটি করেন আলগা, অফ স্টাম্পের বাইরে ফুল টস। যুবরাজ দারুণ টাইমিংয়ে ভাসিয়ে দেন পয়েন্টের ওপর দিয়ে।
ব্রড আবার ফিরে আসেন ওভার দা উইকেট। এবার বল করেন মিডল স্টাম্পে। হাঁটু গেড়ে আবার উড়িয়ে দেন যুবরাজ, এবার মিড উইকেট দিয়ে। ধারাভাষ্যকক্ষে রবি শাস্ত্রী বলে ওঠেন, “ফাইভ… ইয়েস….!”
ওভারের শেষ বলটি আবার মিডল স্টাম্পে ফুল লেংথ। যুবরাজ তুলে মারেন লং অন দিয়ে। বল আবার গ্যালারিতে। ওভারে ষষ্ঠবারের মতো ছক্কা সঙ্কেত দেন আম্পায়ার সাইমন টফেল। মাঠে ভারতীয় দর্শকদের গগণবিদারী চিৎকার, ডাগ আউটে ভারতীয় দলের বাকিদের উল্লাস চলতে থাকে। যুবরাজ উদযাপন করেন উইকেটে সঙ্গী মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে।
১২ বলে ফিফটি করেন সেদিন যুবরাজ, যে রেকর্ড টিকে আছে এখনও।
এই ম্যাচের ঠিক দুই সপ্তাহ আগে ওভালে একটি ওয়ানডেতে যুবরাজের এক ওভারে ৫টি ছক্কা মারেন ইংল্যান্ডের দিমিত্রি মাসকারেনহাস। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচটিতেও মাঠে ছিলেন মাসকারেনহাস। তাকে স্বাক্ষী রেখেই ইতিহাসে নাম লেখান যুবরাজ।
মিসবাহর স্কুপ
সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) স্কুপ! মিসবাহ-উল-হকের স্কুপ বললে ক্রিকেট অনুসারীমাত্রই বুঝে যান, কোন শটের কথা বলা হচ্ছে।
প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল, দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তানের লড়াই। শুধু উপমহাদেশ নয়, উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছিল গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। ম্যাচটিও প্রত্যাশা পূরণ করে উপহার দেয় রোমাঞ্চের চূড়ান্ত।
গৌতম গম্ভীরের ৫৪ বলে ৭৫ রানের ইনিংসে ভারত তোলে ২০ ওভারে ১৫৭ রান। রান তাড়ায় পাকিস্তানের রান ১৬ ওভার শেষে দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ১০৪। মিসবাহ তখন উইকেটে ২৪ বলে ১৭ রান করে।
সেই মিসবাহ এরপর হরভজনের এক ওভারে মারেন তিন ছক্কা। পরের ওভারে শ্রীশান্থকে দুটি ছক্কায় ওড়ান সোহেল তানভির। ভারত তানভিরকে ফিরিয়ে আরও এক উইকেট নিয়ে লড়াই চালিয়ে যায়। শেষ ওভারে পাকিস্তানের প্রয়োজন পড়ে ১৩ রান, উইকেট বাকি ১টি।
ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি বল তুলে দেন আনকোরা যোগিন্দর শর্মার হাতে। মাত্র চতুর্থ টি-টোয়েন্টি খেলতে নামা মিডিয়াম পেসার প্রথম বলটি করেন ওয়াইড। তবে পুষিয়ে দেন প্রথম বৈধ বলে রান না দিয়ে। পরের বলে অফ স্টাম্পের বাইরে ফুল টস পেয়ে লং অফের ওপর দিয়ে ছক্কায় ভাসিয়ে দেন মিসবাহ।
৪ বলে প্রয়োজন ৬ রান। তখনই সেই মুহূর্ত। স্টাম্পে থাকা ফুল লেংথ বল স্কুপ করেন মিসবাহ। ফাইন লেগ ফিল্ডার ছিল বৃত্তের ভেতরে। মিসবাহর ভাবনা তাই খারাপ ছিল না। ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে পার করাতে পারলেই চার। কিন্তু যোগিন্দর শর্মার বলে এমনিতেই পেস কম। ওই বলটিতে মিসবাহ অনেকটা শাফল করে অফ স্টাম্পের বাইরে থেকে স্কুপ করতে গিয়ে টাইমিং করতে পারেননি। বল উঠে যায় স্রেফ ওপরে, শর্ট ফাইন লেগে সহজ ক্যাচ নেন শ্রীশান্থ।
বিশ্বজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে ভারত। হতাশায় ব্যাটে ভর দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে থাকেন মিসবাহ। দুই দলের গ্রুপ পর্বের লড়াইয়ের মতোই দলের নিভতে থাকা আশা জাগিয়ে দিয়েও আবার দপ করে নিভিয়ে দেন তিনি।
মিসবাহকে ওই শট নিয়ে অনেক কথা বলতে হয়েছে নানা সময়ে, বলতে হয় এখনও। কখনও ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক স্কুপ খেলে আত্মবিশ্বাস পাওয়ার কথা বলেছেন, কখনও অতি আত্মবিশ্বাসী হওয়ার দায় নিয়েছেন। আবার বলেছেন, আর একটি উইকেট বাকি থাকলেও তিনি স্কুপ না করে উইকেটের সামনে বড় শটের চেষ্টা করতেন।
ওই শট, ওই মুহূর্ত, ওই উপলক্ষই এমন যে আলোচনাটা চলতেই থাকবে যুগের পর যুগ।
নেদারল্যান্ডস ২ ইংল্যান্ড ০
টি-টোয়েন্টি বিপক্ষে দুইবার মুখোমুখি হয়েছে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। অবিশ্বাস্যভাবে, দুবারই জিতেছে নেদারল্যান্ডস!
প্রথমটি ২০০৯ আসরে, ইংলিশদের আভিজাত্যের আঙিনা ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে। ১৬৩ রান তাড়ায় নেদারল্যান্ডসের শুরুটায় চমকের আভাস ছিল না। ৪ ওভারের মধ্যে তারা দুই উইকেট হারায়। তবে ইনিংসের মাঝমাঝি থেকে চিত্র বদলাতে শুরু করে। পাঁচে নেমে টম ডে গ্রুথ করেন ৩০ বলে ৪৯, ছয়ে নেমে পিটার বোরেন ২৫ বলে ৩০।
নাটকীয়তার চূড়ান্ত জমে শেষ ওভারে। ডাচদের প্রয়োজন পড়ে ৭ রানের। স্টুয়ার্ট ব্রডের করা ওভারের প্রথম ৫ বলে আসে ৫ রান। শেষ বলে ২ রানের সমীকরণে শেষ বলটি ব্রড করেন রাউন্ড দা উইকেটে। আটে নামা ব্যাটসম্যান এজগার শিফার্লি কোনোরকমে ব্যাটে-বলে করেই ছুট লাগান। বল রয়ে যায় উইকেটের কাছেই। বোলার ব্রড ফলো থ্রুতে শুয়ে ছুটে গিয়ে ডাইভ দিয়ে বল থামান। ব্যাটসম্যান তখনও মাঝ উইকেটে।
রান আউটের সুবর্ণ সুযোগ, স্টাম্পে লাগাতে পারলেই ১ রানে জিতে যায় ইংল্যান্ড। আধশোয়া অবস্থায়ই বল থ্রো করেন ব্রড। কিন্তু ব্যর্থ হন স্টাম্পে লাগাতে। সেই বলে ‘ব্যাক আপ’ করার জন্যও ছিল না কেউ। বল চলে যায় দূরে। যেখানে একটি রানও হয় না, সেখানেই ২ রান নিয়ে ৪ উইকেটে ম্যাচ জিতে বিশ্বজয়ের আনন্দে মাতে ডাচরা। ব্রড ও ইংলিশরা তখন স্তম্ভিত!
নেদারল্যান্ডসের পরের জয়টি ২০১৪ সালে। এবারের জয় তেমন নাটকীয় নয়, তবে চমকপ্রদ। স্টুয়ার্ট ব্রডের নাম চলে আসে এখানেও। তিনি তখন ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক।
চট্টগ্রামে ম্যাচের প্রথম ভাগ ছিল অনুমিতই। ডাচরা ২০ ওভারে করতে পারে ১৩৩ রান। এরপরই তারা চমকে দেয় বল হাতে। স্রেফ ৮৮ রানেই গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। দুই পেসার মুদাসসর বুখারি ও লোগান ফন বিক নেন তিনটি করে উইকেট। ইংলিশদের স্রেফ তিন ব্যাটসম্যান দুই অঙ্ক স্পর্শ করেন, তাদের কেউই আবার পারেননি ২০ রানও করতে।
৫ উইকেটের ওভার
ভিডিও গেমে এরকম দেখা যায়। কিংবা পাড়ার ক্রিকেটে। কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চেও দেখা গেছে এক ওভারে ৫ উইকেট!
২০১০ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক ওভারে ৫ উইকেট নেয় পাকিস্তান। বোলার ছিলেন মোহাম্মদ আমির। তবে তার নিজের উইকেট ছিল ৩টি। বাকি দুটি রান আউট।
সেন্ট লুসিয়ায় সেদিন পাকিস্তানি বোলারদের ভুগিয়ে ১৯ ওভারে ৫ উইকেটে ১৯১ রান তুলে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। ওপেনিংয়ে শেন ওয়াটসন করেন ৪৯ বলে ৮১, চারে নেমে ডেভিড হাসি ২৯ বলে ৫৩। এরপর শেষ ওভারে হঠাৎ উল্টো হাওয়া।
ওই ওভারের প্রথম বলে শর্ট থার্ড ম্যানে ক্যাচ দিয়ে আউট হন ব্র্যাড হাডিন। পরের বলে ইয়র্কারে বোল্ড মিচেল জনসন। পরের বলে আরেকটি ইয়র্কার, ব্যাটসম্যান স্টিভেন স্মিথ পারেননি ব্যাটে-বলে করতে। তবে স্টাম্পের বাইরে থাকায় বোল্ড হননি। কিপারের হাতে বল রেখেই দুই ব্যাটসম্যান চেষ্টা করেন রান চুরি করতে। কিপার কামরান আকমল সরাসরি বল লাগান স্টাম্পে। রান আউট হয়ে যান মাইক হাসি। আমিরের হ্যাটট্রিক না হলেও পাকিস্তান দলের হ্যাটট্রিক হয়ে যায়।
পরের বলে আবারও কিপারের কাছে বল রেখে রান নেওয়ার চেষ্টায় রান আউট স্মিথ। পঞ্চম বলে রান নিতে পারেননি শট টেইট। শেষ বলে টেইটকে বোল্ড করে দেন আমির।
সব মিলিয়ে ৫ উইকেটের ওভার। আমিরের বোলিং বিশ্লেষণ শেষ পর্যন্ত ৪-১-২৩-৩।
ম্যাচটি অবশ্য অস্ট্রেলিয়া পরে জিতে নেয় ৩৪ রানে।
হাসির ব্যাটের হাসিতে আজমলের দুঃখ
আমিরের ৫ উইকেটের ওই ওভারের ১২ দিন পর একই ভেন্যুতে আবার মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তান। এবার বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে।
পাকিস্তান ১৯১ রানের পুঁজি গড়ার পর বোলিংয়েও শুরুটা দারুণ করে। ১০ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার রান ৪ উইকেটে ৬৭। পরে ডেভিড হাসির বিদায়ে তার বড় ভাই মাইক হাসি যখন উইকেটে যান, অস্ট্রেলিয়ার তখনও লাগে ৪৫ বলে ৯০ রান।
শেষ তিন ওভারে সেই সমীকরণ দাঁড়ায় ৪৮ রানে। হাসির দারুণ ব্যাটিংয়ে ১৮তম ওভার থেকে আসে ১৪ রান, ১৯তম ওভার থেকে ১৬। তার পরও শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ১৮ রানে। বোলিংয়ে আসেন সাঈদ আজমল, সেই সময় সীমিত ওভারে বিশ্বের সেরা বোলারদের একজন।
প্রথম বলে সিঙ্গেল নেন মিচেল জনসন। দ্বিতীয় ডেলিভারি একটু জোরের ওপর লেংথ বল করেন আজমল। চকিতে পুল করে বল গ্যালারিতে পাঠান হাসি। পরের বলটি আজমল করেন ফুল লেংথ, এবার হাঁটু গেড়ে লং অন দিয়ে ৯৪ মিটার লম্বা ছক্কায় ওড়ান হাসি।
চতুর্থ বলে লাইন একটু বদলে অফ স্টাম্পের বাইরে করেন আজমল। হাসি আবারও ব্যাট চালিয়ে দেন। পয়েন্ট ফিল্ডারের একটু ওপর দিয়ে বল গড়িয়ে চলে যায় বাউন্ডারিতে। ৪ বলে ১৭ রান!
বাকি দুই বলে দরকার ছিল এক রান। কিন্তু হাসিকে পেয়ে বসেছে বড় শটের নেশা। পঞ্চম বলে আবার ছক্কা মেরে অবিস্মরণীয় জয়ে দলকে ফাইনালে তোলেন ‘মি. ক্রিকেট’ নামে পরিচিত এই ব্যাটসম্যান। তিনি অপরাজিত থাকেন ২৪ বলে ৬০ রান করে।
ক্রিকেটে গ্যাংনাম স্টাইল
‘গ্যাংনাম স্টাইল’ গান ও ভিডিও তখন গোটা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। দক্ষিণ কোরিয়ান পপ তারকা সাই-এর ব্লকবাস্টার হিট মিউজিক ভিডিওকে ক্রিকেট মাঠে বয়ে আনেন ক্রিস গেইল। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যাট-বলের পারফরম্যান্সের পাশাপাশি গ্যাংনাম নাচ দিয়েও বিশ্বকাপ মাতিয়ে তোলেন গেইল ও ক্যারিবিয়ানরা।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে উইকেট পাওয়ার পর গ্যাংনাম নাচ দিয়ে উদযাপন করেন গেইল। পরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও জনি বেয়ারস্টোর উইকেট নিয়ে তিনি মেতে ওঠেন এই উদযাপনে। ক্রমে যোগ দিতে থাকেন অন্যরাও, এই উদযাপন হয়ে ওঠে ক্যারিবিয়ানদের ট্রেডমার্ক। গ্যালারিতে আর টিভি পর্দার সামনে দর্শকেরাও মজে যান গেইলদের গ্যাংনাম নাচে। ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে শিরোপা জয়ের পর ক্যারিবিয়ানদের উৎসবের আকর্ষণীয় অংশ ছিল যথারীতি গ্যাংনাম নাচ।
নেদারল্যান্ডসের চমকপ্রদ রান তাড়া
বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের ম্যাচ, তথাকথিত ছোট দুই দলের লড়াই। এই ম্যাচকে ঘিরে আগ্রহ খুব বেশি লোকের থাকার কারণ নেই। তবে এই ম্যাচই তোলপাড় ফেলে দেয় বিস্ফোরক ব্যাটিং দিয়ে।
সিলেটে টস হেরে আয়ারল্যান্ড ২০ ওভারে তোলে ১৮৯ রান। ওপেনিংয়ে উইলিয়াম পোর্টারফিল্ড করেন ৩২ বলে ৪৭, চারে নেমে অ্যান্ড্রু পয়েন্টার ৩৮ বলে ৫৭। শেষ দিকে কেভিন ও’ব্রায়েন অপরাজিত ৪২ করেন ১৬ বলে।
মূল পর্বে যেতে হলে নেদারল্যান্ডসকে টপকাতে হতো ১৪.২ ওভারে। প্রায় অসম্ভব সেই লক্ষ্যের পেছনে ছুটে শুরু থেকেই তাক লাগিয়ে দেয় তারা। দুই ওপেনার স্টেফান মাইবার্গ ও পিটার বোরেন ৬ ওভারে তুলে ফেলেন ৯১ রান!
স্রেফ ২৩ বলে ৬৩ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন মাইবার্গ, বোরেন ফেরেন ১৫ বলে ৩১ করে। এই দুজনসহ ৯ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারিয়ে ডাচরা একটু বিপদে পড়ে বটে। তবে ওয়েসলি বারেসি ও টম কুপার আবার শুরু করেন তাণ্ডব। ৬ ছক্কায় ১৫ বলেই ৪৫ করে ফেলেন কুপার, ২২ বলে ৪০ রানে অপরাজিত থাকেন বারেসি। ১৩.৫ ওভারেই লক্ষ্য ছুঁয়ে স্মরণীয় জয়ে পরের ধাপে পা রাখেন নেদারল্যান্ডস।
শ্রীলঙ্কার ফাইনাল জয়
বিশ্ব আসরের ফাইনাল খেলতে পারাও অনেক বড় প্রাপ্তি। তবে এই ফাইনালই শ্রীলঙ্কার জন্য হয়ে উঠেছিল বিভীষিকা। একের পর এক ফাইনাল হেরে ট্রফির সঙ্গে আড়ি চলতে থাকে তাদের।
২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে এই ধারার শুরু। এরপর ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হার, ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের কাছে হার, দেশের মাঠে ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে যায় তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে।
অবশেষে সেই খরা কাটে ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। মিরপুরে ফাইনালে তারা ভারতকে হারিয়ে ছোঁয়া পায় ট্রফির। এরপরই এই সংস্করণকে বিদায় জানান দুই লঙ্কান কিংবদন্তি মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকারা।
বাংলাদেশের বেঙ্গালুরু বিপর্যয়
চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের ঠাসা গ্যালারি তখন প্রায় নিস্তব্ধ। কেবল কিছু বাংলাদেশি সমর্থকের আওয়াজ ভেসে আসছে। ২২ গজে এক দফা উদযাপন সেরে নিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। ম্যাচ তখন মুঠোয়, স্মরণীয় জয় কেবল কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। কিন্তু ক্রিকেটের সব অনিশ্চয়তাকে আলিঙ্গন করে বাংলাদেশের রোমাঞ্চ বদলে গেল বিষাদে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের চিরন্তন দুঃখগাঁথায় জায়গা পেয়ে গেছে এই বেঙ্গালুরু দুঃস্বপ্ন।
বিস্তারিত জানা প্রায় সবারই। ১৪৭ রান তাড়ায় শেষ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন ১১ রান। হার্দিক পান্ডিয়ার প্রথম বলে মাহমুদউল্লাহর সিঙ্গেল, পরের দুই বলে বাউন্ডারি মেরে মুশফিকের উদযাপন। যেন জয় এসেই গেছে! ৩ বলে যখন প্রয়োজন ২ রান, পরপর দুই বলে উড়িয়ে মেরে আউট মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ। শেষ বলে ব্যাটে-বলে করতে পারলেন না শুভাগত হোম। দৌড়ে একটি রান নিয়ে ‘টাই’ করাও হলো না। ১ রানের অবিশ্বাস্য জয় পেল ভারত।
ঘটনার আকস্মিকতায় বাংলাদেশের ড্রেসিং রুম তখন স্তম্ভিত। একটু আগে মিইয়ে থাকা ভারতীয় দর্শকদের গগণবিদারী চিৎকারে প্রকম্পিত চারপাশ।
রিমেম্বার দা নেইম
নিশ্চয়ই নামটি মনে আছে! ২২ গজে চার বলে চার ছক্কা আর ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে সেই উচ্চারণ- সব মিলিয়ে কার্লোস ব্র্যাথওয়েটকে মনে রাখবেই ক্রিকেট।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষ ওভার। পেছন থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ লড়াইয়ে ফিরলেও শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ১৯ রানের। ব্যস, এরপর ব্র্যাথওয়েটের রূপকথা।
বল হাতে ছুটে যান বেন স্টোকস। একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার। প্রতিবারই ব্র্যাথওয়েটের ব্যাটের দাপটে ইডেন গার্ডেনসের রাতের আকাশের বুক চিড়ে বল পেরিয়ে যায় সীমানা।
চতুর্থ শটটি খেলেই ব্র্যাথওয়েট বুঝে যান, আরেকটি ছক্কা হচ্ছে। যুদ্ধজয়ী গ্ল্যাডিয়েটরের মতো দুহাত প্রসারিত করে তিনি আনন্দ চিৎকারে ফেটে পড়েন। ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে তখন ইয়ান বিশপের কণ্ঠের ধ্বনিতে মোহিত গোটা ক্রিকেট বিশ্ব… ‘কার্লোস ব্র্যাথওয়েট, কা…র্লো…স ব্র্যাথওয়েট, রিমেম্বার দা নেইম…!’
ব্র্যাথওয়েটের ক্যারিয়ার মনে রাখার মতো কিছু নয়। সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দিতে পারেননি তিনি। কিন্তু ওই ওভার, সেই ম্যাচ, বিশপের জাদুকরী উচ্চারণ আর আবহ, সবকিছু মিলিয়ে ক্রিকেটে ব্র্যাথওয়েট অমর হয়ে রইবেন ঐন্দ্রজালিক ওই সময়টুকুর জন্য।
অবশেষে পাকিস্তানের ভারত জয়
তিন সংস্করণ মিলিয়ে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি লড়াইয়ে পাকিস্তান এগিয়ে থাকলেও বিশ্বমঞ্চের চিত্র ছিল উল্টো। বিশ্বকাপে ভারত ছিল পাকিস্তানের জন্য বড় এক রহস্য, যেটির কোনো কূল-কিনারা তারা করতে পারছিল না। ওয়ানডে হোক বা টি-টোয়েন্টি, বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচ মানেই ছিল ভারতের জয়। ‘ছিল’, কারণ এখন আর নেই!
২৯ বছর আর ১৩ বারের চেষ্টায় অবশেষে ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতকে হারায় পাকিস্তান। সেটিও শুধু হারানো নয়, জয় ধরা দেয় ব্যাটে-বলে ভারতকে বিধ্বস্ত করে।
শাহিন শাহ আফ্রিদির আগুনে প্রথম স্পেলেই মূলত লেখা হয়ে যায় ভারতের ধ্বংস। দুর্দান্ত দুটি ডেলিভারিতে নিজের প্রথম দুই ওভারে তিনি ফেরান রোহিত শর্মা ও লোকেশ রাহুলকে। পরে শেষ দিকে ফিরে বাঁহাতি এই ফাস্ট বোলার শিকার করেন ফিফটি করা বিরাট কোহলির উইকেটও।
ভারতকে ১৫১ রানে আটকে রান তাড়ায় কোনো উইকেট না হারিয়েই স্মরণীয় জয় পায় পাকিস্তান। মোহাম্মদ রিজওয়ান অপরাজিত থাকেন ৭৯ রানে, অধিনায়ক বাবর আজম ৬৮ রানে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রথম
অস্ট্রেলিয়া রত্ন ভাণ্ডারে স্রেফ এই একটি মাণিক্যর অভাব ছিল। তাদের ট্রফির সমৃদ্ধ সম্ভারে ছিল না টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুদৃশ্য এই ট্রফি। ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা সাফল্যে সবচেয়ে বেশি বার অবগাহন করা দল, টেস্টের জগতে বছরের পর বছর রাজত্ব করা দল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেরা হতে পারছিল না কোনোভাবেই।
২০১০ আসরে ফাইনালে গিয়ে তারা হারে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ব্যস, আর ফাইনালের মুখ দেখাদেখি নেই।
অবশেষে তাদের অপেক্ষার অবসান ২০২১ আসরে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ফেভারিটদের কাতারে তাদেরকে রাখেনি খুব বেশি কেউ। প্রথম দুই ম্যাচে জয়ের পর ইংল্যান্ডের কাছে হেরেও যায় তারা বাজেভাবে। এরপরই তাদের ছুটে চলা শুরু।
বড় পরীক্ষায় পড়তে হয় তাদের সেমি-ফাইনালে। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ৪ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ৫০ রানের। মার্কাস স্টয়নিস ও ম্যাথু ওয়েডের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে সেই চ্যালেঞ্জ তারা জিতে নেয় দারুণভাবে। ১৯ তম ওভারে শাহিন শাহ আফ্রিদির বলে ওয়েডের ক্যাচ ছাড়েন হাসান আলি। পরের তিন বলে আফ্রিদিকে টানা তিন ছক্কায় এক ওভার আগেই খেলা শেষ করে দেন ওয়েড।