Published : 12 May 2025, 04:33 PM
ভারতের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় চারে থেকে টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন ভিরাট কোহলি। ৪৬.৮৫ গড়ে থামলেন ৯ হাজার ২৩০ রানে। তার ৩০ সেঞ্চুরিও ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত সংস্করণে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ। একটা জায়গায় তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে, তার সাত ডাবল সেঞ্চুরির চেয়ে বেশি নেই আর কোনো ভারতীয় ক্রিকেটারের। কোহলির অভিষেকের পর সব দেশ মিলিয়েই আর কেউই পারেননি তার চেয়ে বেশি ডাবল সেঞ্চুরি করতে। তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি টানা দুই মৌসুমে টেস্টে ৭৫ বা এর বেশি ব্যাটিং গড়ে করেছেন হাজারের বেশি রান।
টেস্ট ক্রিকেটে কোহলির সেরা সময়ের শুরু ২০১৪-১৫ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফর দিয়ে। সেবার চার সেঞ্চুরিতে ৮৬.৫০ গড়ে তিনি করেন ৬৯২ রান। এরপর থেকে ২০১৯-২০ মৌসুমের বাংলাদেশ সফর পর্যন্ত ৬৩.৬৫ গড়ে তিনি করেন ৫ হাজার ৩৪৭ রান। তার ৩০ সেঞ্চুরির ২১টি আসে কেবল ৯০ ইনিংসের মধ্যে।
রান বন্যার এই সময়টা তাকে বসায় সময়ের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যানদের তালিকায়। তবে ২০২০ সাল থেকে আর সেরা চেহারায় দেখা যায়নি কোহলিকে। ছন্দ হারিয়ে এই সময়ে ৩৯ টেস্টে কেবল ৩০.৭২ গড়ে করতে পারেন দুই হাজারের বেশি রান। এই সময়ে ৫০ বা এর বেশি ইনিংস খেলেছেন এমন ৩২ জন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের মধ্যে কোহলির গড় চতুর্থ সর্বনিম্ন। পারফরম্যান্সে পতনের ধারা আরও তীব্র হয়েছে শেষ ১০ টেস্টে। এই সময়ে ১৯ ইনিংসে কেবল ২২.৪৭ গড়ে ৩৮২ রান করতে পারেন কোহলি। এক চতুর্থাংশের বেশি রান আসে এক ইনিংসেই, পার্থ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলেন অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংস।
কোহলির টেস্ট ক্যারিয়ারের উত্থান-পতন
সময়কাল |
টেস্ট |
ইনিংস |
রান |
গড় |
শতক |
পঞ্চাশ |
অভিষেক থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৪ |
২৯ |
৫১ |
১৮৫৫ |
৩৯.৪৬ |
৬ |
৯ |
অক্টোবর ২০১৪ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯ |
৫৫ |
৯০ |
৫৩৪৭ |
৬৩.৬৫ |
২১ |
১৩ |
জানুয়ারি ২০২০ থেকে |
৩৯ |
৬৯ |
২০২৮ |
৩০.৭২ |
৩ |
৯ |
কোহলির টেস্টে ক্যারিয়ারের শুরুটা সাদামাটা হলেও খারাপ ছিল না, গ্রহণযোগ্য ছিল। ২০১৪ সালে ইংল্যান্ড সফরের আগে ২৪ টেস্টে ৪৬.৫১ গড়ে তিনি করেন ১ হাজার ৭২১ রান। ছয় সেঞ্চুরির সবচেয়ে বড়টিতে করেন ১১৯ রান। ইংল্যান্ডে সুইং সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ১০ ইনিংসে তিনি করেন কেবল ১৩৪ রান। তবে এরপরও মার্টিন ক্রো তাকে ভবিষ্যতের সেরা ক্রিকেটারদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করেন, জায়গা দেন ‘ফেব ফোরে।’
ক্রোর সেই ধারণা সত্যি বলেই প্রমাণিত হয়। ২০১৪-১৫ মৌসুমের শুরু থেকে ২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত কোহলি করেন ৫ হাজার ৩৪৭ রান। তার চেয়ে বেশি রান করতে পারেন কেবল স্টিভেন স্মিথ ও জো রুট- যারা সেই ‘ফেব ফোরের’ অংশ, অন্যজন কেন উইলিয়ামসন। এই সময়ে যে ৭২ জন ব্যাটসম্যান এক হাজারের বেশি রান করেছেন তাদের মধ্যে কেবল স্মিথের গড়ই কোহলির চেয়ে বেশি।
২০১৬ সাল থেকে ২০১৮-১৯ মৌসুম পর্যন্ত ১৮ মাসে কোহলি ছিলেন তার সেরা ছন্দে। ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পান তখনই, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। পরবর্তী ৩৩ ইনিংসে যোগ করেন আরও পাঁচটি ডাবল সেঞ্চুরি। ২০১৭ সাল শেষ হতে তার পাশে ছিল ছয়টি ডাবল সেঞ্চুরি। ৩৪ ইনিংসে ছয় ডাবল সেঞ্চুরি নিয়ে একটি তালিকায় তিনি বসেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পেছনে। অস্ট্রেলিয়ার এই কিংবদন্তি ৩৪ ইনিংসে করেছিলেন আটটি ডাবল সেঞ্চুরি! যার শুরুর হয়েছিল ১৯৩০ সালের লর্ডস টেস্টে ২৫৪ রানের ইনিংস দিয়ে।
সেই সময়ে তর্কসাপেক্ষে কোহলি ছিলেন সময়ের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান। সেই সময়ে তার চেয়ে বেশি রান কেউ করেননি। অন্তত আড়াইশ রান করেছেন, এমন কারও গড়ও তার চেয়ে বেশি ছিল না। ‘ফেব ফোরের’ অন্য তিন জনের চেয়ে বেশি রান করেন কোহলি, বেশি গড়ে।
কোহলির সর্বোচ্চ রান করা ৫০ টেস্ট ইনিংস তাকে নিয়ে আসে টেস্ট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানদের কাতারে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে কলকাতা টেস্ট থেকে শুরু করে ২০১৮-১৯ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্ট পর্যন্ত সময়ে কোহলি ৫০ ইনিংসে ৭১.৯৩ গড়ে করেন ৩ হাজার ৩০৪ রান। টানা ৫০ ইনিংসে কেবল ছয় জন ব্যাটসম্যান এর চেয়ে বেশি রান করতে পেরেছেন- ব্র্যাডম্যান, ভিভ রিচার্ডস, কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জায়াওয়ার্দেনে, ব্রায়ান লারা।
বাইরের চেয়ে দেশের মাটিতে বেশি সফল কোহলি। ভারতে ৫৫ টেস্টে ৫৫.৫৮ গড়ে ৪ হাজার ৩৩৬ রান করেন তিনি। বাইরে ৪১.৫১ গড়ে করেন ৪ হাজার ৭৭৪ রান। তবে মাঝারি মানের এই গড়ের মানে এই নয় যে, দেশের বাইরে তার তেমন সাফল্য নেই। ২০১৪-১৫ গাভাস্কার-বোর্ডার সিরিজে ৮৬.৫০ গড়ে তিনি করেন ৬৯২ রান। অস্ট্রেলিয়া সফরে যা সব দেশ মিলিয়ে কোনো ব্যাটসম্যানের পঞ্চম সর্বোচ্চ। দেশের বাইরে কোনো সিরিজে কোহলির চেয়ে বেশি রান করা একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যান হলেন সুনিল গাভাস্কার।
২০১৪ সালে ভরাডুবির ইংল্যান্ড সফরের পর ২০১৮ সালে ফিরে দারুণ সাফল্য পান কোহলি। ৫৯.৩০ গড়ে তিনি করেন ৫৯৩ রান। ১০ ইনিংসে দুই সেঞ্চুরির সঙ্গে করেন তিনটি পঞ্চাশ। ইংল্যান্ডে ভারতীয় কোনো ব্যাটসম্যানের এক সিরিজে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০০২ সালে মাত্র ৬ ইনিংসে রাহুল দ্রাবিড়ের ৬০২ রান এখনও সর্বোচ্চ। এই দুইজনই কেবল অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড সফরে ৫০ এর বেশি গড়ে কোনো সিরিজে রান করতে পেরেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও নিজের ছাপ রেখেছেন কোহলি। চারটি সফরে ৪৯.৫০ গড়ে তিনি সেখানে করেছেন ৮৯১ রান। ১৯৯২ সাল থেকে সফরকারী ক্রিকেটারদের মধ্যে যা চতুর্থ সর্বোচ্চ। তার সামনে আছেন কেবল সাচিন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিং ও স্টিভেন ফ্লেমিং। তবে এই তিন জনেরই গড় কোহলির চেয়ে কম।
সফরকারী ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কোহলির চেয়ে বেশি গড় আছে। তবে ভারতীয় ব্যাটসম্যানকে বেশিরভাগ সময়ই কঠিন উইকেটে খেলতে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ২০১৭-১৮ মৌসুমের জোহানেসবার্গ টেস্টের উইকেট বা ২০২৩-২৪ মৌসুমের সেঞ্চুরিয়ন টেস্টের উইকেট। সেখানে প্রায় অন্য ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কোনো সহায়তা ছাড়াই প্রোটিয়া পেসারদের আগুনে বোলিং সামলাতে হয়েছে কোহলিকে। সেখানে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সম্মিলিত গড় ১৮.৩০। যার ২.৭০ গুণ বেশি গড়ে রান করেছেন কোহলি। ১৯৯২ সাল থেকে সফরকারী ব্যাটসম্যানদের দিক থেকে যা সর্বোচ্চ। পরের চারটি স্থানে আছে আছেন মার্লন স্যামুয়েলস (২.৫৪ গুণ), ডেভিড ওয়ার্নার (২.৪৪ গুণ), ফ্লেমিং (২.২৮ গুণ), লারা (২.১১ গুণ)।
টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে দারুণ সফল কোহলি। ৫৪.৮০ গড়ে এই সময়ে তিনি করেছেন ৫ হাজার ৮৬৪ রান। এই সংস্করণে নিজের সেরা ছন্দে থাকার সময়টাতেই দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। অধিনায়কদের মধ্যে তার রান চতুর্থ সর্বোচ্চ। তার ২০ সেঞ্চুরির চেয়ে বেশি আছে কেবল গ্রায়েম স্মিথের (২৫)।
যে ম্যাচগুলোতে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন কোহলি, সেগুলোতে তার অবদান দলের রানের ১৬.৪৫ শতাংশ। দলকে ৫০ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন অধিনায়কদের মধ্যে কোহলির অবদান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এই ক্ষেত্রে তার চেয়ে এগিয়ে কেবল রুট (১৬.৬৭ শতাংশ)। আর কোনো অধিনায়ক দলের রানে ১৫ শতাংশ অবদান রাখতে পারেননি।
তর্কসাপেক্ষে অধিনায়ক হিসেবে কোহলির সবচেয়ে বড় অবদান টেস্টে সব ধরনের কন্ডিশনে প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট নেওয়ার মতো বোলিং আক্রমণ গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখা। এমন একটি পেস আক্রমণ গড়ে তুলেছিলেন, যারা নিজেরাই ম্যাচে জয় এনে দিতে পারে। ভারতের সবসময়ই অনেক স্পিনার ছিল, যারা সহায়ক কন্ডিশনে দলকে জয় এনে দিতে পারে। তবে কোহলির নেতৃত্ব পেসাররাও ছিল ক্ষুধার্থ। তার অধিনায়কত্বের সময়টায় ভারতীয় পেসাররা ২৬ গড়ে নিয়েছেন ৫৯১ উইকেট, স্ট্রাইক রেট ছিল ৫১.৮৪। এর চেয়ে ভালো স্ট্রাইক রেট কেবল ভিভ রিচার্ডসের আশির দশকের পেস আক্রমণের (৫১.৩৯)।
ভারতের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় কোহলি কোথায় থাকবেন, এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে ৬৮ টেস্টে ৪০ জয় নিয়ে তিনিই যে দেশটির সফলতম অধিনায়ক হিসেবে অবসর নিলেন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।