Published : 02 Jun 2025, 12:41 AM
ম্যাচের আগে উইকেট দেখে ধারাভাষ্যকার আমির সোহেল বললেন, “কংক্রিটের স্লাবের মতো উইকেট।” খেলা শুরুর পর দেখা গেল, পিচ আসলেই ব্যাটিং স্বর্গ। বাংলাদেশ ১৯৬ রান করার পরও তাই মনে হচ্ছিল, যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে এত রান তারা আগে কখনও করেনি। কিন্তু এই ম্যাচের দাবিটা যে আরও বেশি ! রান তাড়ায় সেটিই সত্যি প্রমাণ করে ছাড়লেন মোহাম্মাদ হারিস, সাইম আইয়ুবরা।
আগের দুই ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাটিং করে ম্যাচ জিতেছিল পাকিস্তান। এবার টস জিতে আগে বোলিং নিয়ে অধিনায়ক সালমান আলি আগা বললেন, রান তাড়ার চ্যালেঞ্জ নিতে চান তারা। যেমন কথা তেমন কাজ। হারিসের বিধ্বংসী সেঞ্চুরিতে যেন তুড়ি বাজিয়েই জিতে নিলেন তারা সেই চ্যালেঞ্জ।
শেষ টি-টোয়েন্টিতে ৭ উইকেটের জয়ে তিন ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করে ছাড়ল পাকিস্তান।
লাহোরে রোববার পারভেজ হোসেন ইমনের ঝড়ো ফিফটির পথ ধরে ২০ ওভারে ১৯৬ রান তোলে বাংলাদেশ। গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের ৩০ হাজার দর্শককে উল্লাসে ভাসিয়ে স্ট্রোকের জোয়া বইয়ে দিয়ে পাকিস্তান জিতে যায় ১৬ বল বাকি রেখেই।
৮ চার ও ৭ ছক্কায় ৪৬ বলে ১০৭ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন হারিস। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এই প্রথম পাকিস্তানের কোনো ব্যাটসম্যান শতরানের স্বাদ পেলেন ইনিংস ওপেন না করে।
গত বিপিএলে দুর্বার রাজশাহীর হয়ে ১০ ম্যাচ খেলে হারিসের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৩২। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ১৬টি খেলে ছিল না কোনো ফিফটি। সেই ব্যাটসম্যান এবার কচুকাটা করলেন বাংলাদেশের বোলারদের।
প্রথম ওভারে উইকেট হারানো পাকিস্তানকে জয়ের পথে এগিয়ে নেন দ্বিতীয় উইকেটে সাইম আইয়ুব ও হারিসের জুটি। ৫৩ বলে ৯২ রান যোগ করেন দুই তরুণ।
মেহেদী হাসান মিরাজকে প্রথম ওভারে ছক্কায় রান তাড়া শুরু করেন সাইম। ওভারের শেষ বলে ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় ধরা পড়েন আগের ম্যাচের নায়ক সাহিবজাদা ফারহান। কিন্তু দলকে সামান্যতম চাপেও পড়তে দেননি হারিস। প্রথম দুই বলেই হাসান মাহমুদকে দুটি বাউন্ডারিতে ছুটতে শুরু করেন তিনি। তাকে থামাতে পারেনি কেউ।
অভিষিক্ত সৈয়দ খালেদ আহমেদ প্রথম চার ডেলিভারিতে ভালো কিছুর আভাস দিলেও পরের দুই বলে চার ও ছক্কায় তার আত্মবিশ্বাস নাড়িয়ে দেন হারিস। তিনি আর সাইম মিলে তুলাধুনা করতে থাকেন বাংলাদেশের সব বোলারকেই।
পেস-স্পিন সব গুঁড়িয়ে পাকিস্তানকে শতরানে পৌঁছে দেন তারা দশম ওভারেই। ওই ওভারেই তানজিমকে উইকেট উপহার দিয়ে ফেরেন চার ছক্কায় ২৯ বলে ৪৫ রান করা সাইম।
ক
কিন্তু এবারও ম্যাচে ফিরতে পারেননি বাংলাদেশ। নতুন ব্যাটসম্যান নাওয়াজ ক্রিজে যাওয়ার পরপরই ছক্কা মারেন রিশাদ হোসেনকে। পরে মিরাজের বলে চার ও ছক্কা মেরে আউট হয়ে যান (১৩ বলে ২৬) তিনি আরেকটি ছক্কার চেষ্টায়।
তবে হারিস ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবার পঞ্চাশে পা রাখেন তিনি ২৫ বলে। সেখান থেকে আরও দ্রুততায় তিনি ছুটে যান শতরানের দিকে।
২০ ওভারের স্বীকৃত ক্রিকেটে ১২৭ ম্যাচের ক্যারিয়ারে তার আগের সর্বোচ্চ ছিল ৮৭। সেটিকে পেরিয়ে যান তিনি অনায়াসেই। সেঞ্চুরি ছোঁয়ার পর ছুটে গিয়ে তাকে দুই হাতে জড়িয়ে উঁচুতে তুলে ধরেন অধিনায়ক সালমান।
গত মার্চে ৪৪ বলে তিন অঙ্ক ছুঁয়ে পাকিস্তানের হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন হাসান নাওয়াজ। হারিস সম্ভাবনা জাগিয়েও ছুঁতে পারেননি এক বলের জন্য। তাতে আক্ষেপ খুব একটা থাকার কথা নয় তার। দলের জয় সঙ্গে নিয়েই যে ফিরেছেন।
ম্যাচের শুরুতে বাংলাদেশের জন্য স্বস্তি হয়ে আসে আগে ব্যাটিংয়ের সুযোগ। দুই ম্যাচে রান তাড়ায় ব্যর্থ হওয়া দলকে দারুণ শুরু এনে দেন পারভেজ হোসেন ইমন ও তানজিদ হাসান। উদ্বোধনী জুটিতে ১১০ রান তোলেন দুজন।
পাকিস্তান বোলিং শুরু করে অনিয়মিত স্পিনার সাইম আইয়ুবকে দিয়ে। প্রথম বলে বাউন্ডারিতে ম্যাচ শুরু করেন তানজিদ হাসান। তবে প্রথম ২ ওভারে রান আসে ৮।
এরপরই পারভেজের জ্বলে ওঠার শুরু। সাইমকে আরেক ওভার পেয়ে ফায়দা নেন তিনি দুটি ছক্কা একটি চার মেরে। এরপর ছুটতে থাকেন দারুণ সব শট খেলে। অন্য প্রান্তে তানজিদও একটু জেগে ওঠেন। পাওয়ার প্লেতে আসে ৫৩ রান।
২০২০ যুব বিশ্বকাপজয়ী বাংলাদেশের দুই ওপেনার এই প্রথমবার অর্ধশত রানের জুটি গড়লেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
পাওয়ার প্লে শেষেও পারভেজের ঝড় চলতে থাকে। গত ম্যাচে বাংলাদেশকে প্রবল ভোগানো আবরার আহমেদকে এবার পাত্তাই দেননি তিনি। এই লেগ স্পিনারের প্রথম ওভারে এক ছক্কার সঙ্গে তিনি মারেন দুটি চার।
তানজিদের রান এক পর্যায়ে ছিল ১৯ বলে ১৮। পরে তার ব্যাট থেকে আসে দ্রুত তিনটি ছক্কা। ফাহিম আশরাফের বলে পারভেজের ছক্কা ও চারে জুটি পেরিয়ে যায় শতরান।
ওই ওভারেই জুটি থামে ১১০ রানে। র্যাম্প শট খেলে শর্ট থার্ডম্যানে ক্যাচ দেন তানজিদ (৩২ বলে ৪২)।
এই সংস্করণে বাংলাদেশের হয়ে এর চেয়ে বড় জুটি আছে আর একটিই। ২০২২৩ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে লিটন দাস ও রনি তালুকদারের ১২৪।
সঙ্গীকে হারিয়ে পরের ওভারে শাদাব খানকে উইকেট দিয়ে ফেরেন পারভেজও।
বাংলাদেশের ইনিংস তখন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। পরে লিটন দাস ও তাওহিদ হৃদয় রান পেলেও পরিস্থিতির দাবি খুব ভালো মেটাতে পারেননি।
শাদাবকে একটি ছক্কা মারলেও লিটন ১৮ বল খেলে করতে পারেন কেবল ২২ রান। শাদাবকে চার ও আবরারকে ছক্কায় হৃদয় শুরুটা দারুণ করলেও পরে একটু আটকে গিয়ে আউট হন ১৮ বলে ২৫ করে।
এই দুই উইকেটের মাঝে দুটি চার মেরে বিদায় নেন শামীম হোসেন। ছাপ রাখতে পারেননি মেহেদী হাসান মিরাজ।পরে জাকের আলির ৯ বলে ১৫ ও শেষ ওভারে তানজিম হাসানের ছক্কায় দুইশর কাছে যেতে পারে দল।
তখনই বোঝা যাচ্ছিল, রান অন্তত ১০-১৫ কম হয়েছে। তবে হারিসরা যেভাবে ব্যাট করেছেন, তাতে ২২০ রানও হয়তো যথেষ্ট হতো না!
ম্যাচ-সেরার পাশাপাশি তিন ম্যাচে ১৭৯ রান করে সিরিজের সেরাও হারিস। বাংলাদেশ দেশে ফিরবে একদমই শূন্য হাতে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৯৬/৬ (তানজিদ ৪২, পারভেজ ৬৬, লিটন ২২, হৃদয় ২৫, শামীম ৮, জাকের ১৫*, মিরাজ ১, তানজিম ৮*; সাইম ২-০-২৪-০, হাসান ৪-০-৩৮-২, ফাহিম ৪-০-৪১-১, আব্বাস ৪-০-২৬-২, সালমান ১-০-১১-০, আবরার ২-০-২৭-০, শাদাব ৩-০-২৬-১)।
পাকিস্তান: ১৭.২ ওভারে ১৯৭/৩ (সাহিবজাদা ১, সাইম ৪৫, হারিস ১০৭*, নাওয়াজ ২৬, সালমান ১৫*; মিরাজ ৩-০-২৬-২, হাসান ৩-০-৪২-০, খালেদ ৪-০-৩৭-০, তানজিম ৩-০-৩৬-১, রিশাদ ৩-০-৩৯-০, শামীম ১-০-১১-০, হৃদয় ০.২-০-৫-০)।
ফল: পাকিস্তার ৭ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে পাকিস্তান ৩-০ ব্যবধানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ : মোহাম্মাদ হারিস।
ম্যান অব দা সিরিজ: মোহাম্মদ হারিস।