Published : 06 Feb 2025, 08:26 PM
দুজনই সাবেক পেসার। এছাড়া আর কোনো মিল নেই মিজানুর রহমান ও শন টেইটের। এমনকি সেই ‘সাবেক পেসার’ পরিচয়ের মধ্যেও ফারাক অনেক। মিজানুর আইসিসি ট্রফি খেলেছেন বাংলাদেশের হয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন অনেক দিন। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ধারেকাছে যেতে পারেননি। টেইট অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী ফাস্ট বোলার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার খুব সমৃদ্ধ নয় তার। তবে ক্রিকেট তাকে মনে রেখেছে ইতিহাসের সবচেয়ে গতিময় বোলারদের একজন হিসেবে। দুই মেরুর দুজনকে মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে এবারের বিপিএলের ফাইনাল।
এবারের আসরের ফাইনালের দুই দলের কোচ এই দুজন। মিজানুরের কোচিংয়ে প্রবল প্রতাপেই ফাইনালে পৌঁছেছে ফরচুন বরিশাল। চিটাগং কিংসের পথচলা অতটা মসৃণ ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত বরিশালকে হারিয়েই প্রথম কোয়ালিফায়ারে জায়গা করে নেয় তারা। সেখানে বরিশালের কাছে বিধ্বস্ত হয়ে দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে রোমাঞ্চ-উত্তেজনার স্রোতে সাঁতরে দলটি ফাইনালে পৌঁছেছে টেইটের কোচিংয়ে।
এবারের আগে চিটাগং কিংস বিপিএলে সবশেষ খেলেছে ২০১৩ সালে। এক যুগ পর ফিরেই আবার শেষের মঞ্চে পা রেখেছে তারা। মজার ব্যাপার হলো, দুবারই ফ্র্যাঞ্চাইজিটির সঙ্গী টেইট। তবে দুই ভূমিকায়।
২০১৩ আসরে টেইট ছিলেন এই দলের ক্রিকেটার। সেবার সাত ম্যাচ খেলে ১০ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান তারকা বড় ভূমিকা রেখেছিলেন চিটাগং কিংসের এগিয়ে চলায়। সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে তিনি অবশ্য খেলতে পারেননি। তবে ফাইনালে চিটাগংয়ের পরাজয়ে দূর থেকেও পোড়ার কথা তার। ১২ বছর পর ভিন্ন ভূমিকায় তার সুযোগ থাকছে ট্রফি জয়ের স্বাদ পাওয়ার।
এরকম ফ্র্যাঞ্চাইজি আসরে প্রধান কোচের দায়িত্ব নিয়ে কোনো দলের খোলনলচে পাল্টে ফেলা কঠিন। তবে ছোট ছোট কিছু কাজ অবশ্যই করা যায়, যা শেষ পর্যন্ত বড় পার্থক্য গড়ে দেয়। টেইট নিশ্চয়ই অনেক কিছু ঠিকঠাক করেছেন বলেই মাঝারি মানের দল নিয়েও ফাইনালে উঠেছে তার দল। এবারের মৌসুমে চট্টগ্রামের সেরা পারফরমারদের একজন গ্রাহাম ক্লার্ককে ডারহাম থেকে বিপিএলে আনায় বড় ভূমিকা ছিল তার।
প্লেয়ার্স ড্রাফটে খুব শক্তিশালী দল গড়তে পারেনি চিটাগং। পরেও বিদেশি ক্রিকেটার সংগ্রহে খুব তৎপর তারা ছিল না। সীমিত শক্তি ও সামর্থ্য নিয়েও প্রাথমিক পর্বে দুইয়ে থাকা ও পরে ফাইনালে ওঠার পেছনে ইতিবাচক অনেক প্রভাব নিশ্চয়ই কোচ রেখেছেন দলে।
বিশেষ করে, চিটাগংয়ের বোলিং আক্রমণ যে এবার টুর্নামেন্টের সেরাগুলির একটি, সেখানে টেইটের বড় ভূমিকা না থেকে পারেই না। চট্টগ্রাম পর্বের সময় টিভি সাক্ষাৎকারে টেইট বলেছিলেন, সৈয়দ খালেদ আহমেদের সঙ্গে কাজ করতে তিনি মুখিয়ে ছিলেন এবং কাজ করেছেনও। খালেদ কতটা উপকৃত হয়েছে, প্রমাণ মিলেছে পারফরম্যান্সেই।
দেশের ক্রিকেটে মূলত বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটের পেসার হিসেবে পরিচিতি থাকলেও বিপিএলে এবার ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম কাটাচ্ছেন ৩২ বছর বয়সী পেসার। ২০ উইকেট নিয়ে এখনও পর্যন্ত যৌথভাবে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি তিনি।
দুর্বার রাজশাহীর মতো অতটা বিতর্ক না ছড়ালেও পারিশ্রমিক বিতর্ক ও নানা নেতিবাচক ইস্যুতে খবরের শিরোনামে এসেছে চিটাগং কিংসও। কিন্তু সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে দলের ফাইনালে ওঠার কৃতিত্বও কোচকে দিতেই হবে, যতটা প্রাপ্য।
মিজানুরের সামনে এবার টানা দ্বিতীয় শিরোপা হাতছানি। বিপিএলের সফলতম কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের মতো তারকা কোচের তকমা তার নেই। পাদপ্রদীপের আলোও তার ওপর অতটা পড়ে না। তবে আড়াল থেকে নিজের কাজটা করে যান তিনি নিজের মতো করেই। ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তার কোচিংয়ে তৃতীয় হয়েছিল বাংলাদেশ, তখনও পর্যন্ত যা ছিল সেরা সাফল্য।
ঘরোয়া ক্রিকেটেও তার সাফল্য আছে বেশ। চলতি মৌসুমেই জাতীয় ক্রিকেট লিগের চার দিনের সংস্করণ ও টি-টোয়েন্টিতে তার কোচিংয়ে রানার্সআপ হয় ঢাকা মেট্রো। এছাড়াও দেশের অনেক ক্রিকেটারের ব্যক্তিগত অবদানে বড় ভূমিকা আছে তার।
দেশের ক্রিকেটে কোচ হিসেবে যে তিনি অনেকটা ‘আন্ডাররেটেড’, এটা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই তার, বলেছেন বুধবার দলের অনুশীলন শেষে।
“আন্ডাররেট... কারা রেট করে, কীভাবে রেট করে, সেটা তো আসলে যারা করে তারা বুঝবে। আমার কাজ হলো কোচিং করানো, ভালো কিছু করা। আমি চেষ্টা করি আমার তরফ থেকে। যারা বিচার করবে, আরেকটা জায়গা থেকে। তারা তাদের দৃষ্টিতে... ওটা তো আমার হাতে নেই।”
“আমার হাতে যেটা, আমি চেষ্টা করি একটা দলকে কীভাবে সমন্বয় করা যায়। এই বছর ভালো হচ্ছে। জাতীয় লিগে চার দিনের সংস্করণ ও টি-টোয়েন্টিতে আমার দল ফাইনাল খেলেছে। গত বছর বিপিএলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এবছরও ফাইনালে উঠেছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।”
নিজ দলে ঠিকই তাকে উপযুক্ত মূল্যায়ন করা হয়। অধিনায়ক তামিম ইকবাল যেমন ফাইনালের আগের দিন বললেন, বরিশালের সাফল্যে মিজানুরের অবদান অনেক।
“বাবুল ভাই (মিজানুর) দারুণ অভিজ্ঞ কোচ। উনি জানেন, উনার সীমাবদ্ধতা কী। বরিশালের মত দলে, যেখানে চার-পাঁচ জন সিনিয়র ক্রিকেটার আছে, জাতীয় দলের অধিনায়ক আছে…এখানে জানতে হবে, কী করতে পারবেন আর কী পারবেন না। এটা উনি ভালোভাবে করেছেন। আমাদের ফলের পেছনে অনেক অবদান আছে উনার।”
“মাঝে মাঝে এসব দলে কোচিং করানো কঠিন। সব ধরনের দাবি মেটানো, এই নেটে ব্যাটিং অই নেটে ব্যাটিং…। আমাদের দলের কোচ দেখলে বাইরে থেকে মনে হতে পারে, এই দলের সাথে যে কেউ কোচ হতে পারে। তবে আসলে কাজটা অনেক কঠিন। আমাদের দলের সংস্কৃতি অনেক ভালো। ফলে এখানে ইস্যু কখনও হয় না।”
শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন না হতে না পারলে মিজানুরের ভাবমূর্তি খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তবে আরেকবার ট্রফি জিতলে তার আবেদন ও ওজন নিশ্চিতভাবেই বেড়ে যাবে আরও অনেক। টেইটের জন্য ব্যাপারটি এখানে প্রধান কোচ হিসেবে ভাবমূর্তি গড়ার। ফাইনালের দুই দলের লড়াই তাই এই দুজনের লড়াইও।