Published : 20 May 2025, 01:21 AM
২০২১ সালের ৫ অক্টোবর মুহাম্মাদ ওয়াসিমের অভিষেক আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত এই সংস্করণে বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান তারই! সেই ব্যাটের তেজ তীব্রভাবেই টের পেল বাংলাদেশ। শুধু কী ওয়াসিম! দলের অন্যরাও সঙ্গী হলেন অধিনায়কের। অনভিজ্ঞতার কারণে শেষ দিকে বারবার হোঁচট খেয়েও দৃঢ় পায়ে ছুটে গেল লক্ষ্যে। শেষ পর্যন্ত শেষ ওভারের চরম নাটকীয়তায় পৌঁছে গেল তারা অবিস্মরণীয় এক জয়ের ঠিকানায়।
২০৫ রানের পুঁজি নিয়েও পারল না বাংলাদেশ। রেকর্ড রান তাড়ায় ২ উইকেটের জয়ে সিরিজে সমতা ফেরাল সংযুক্ত আরব আমিরাত।
আগের ম্যাচে চোখরাঙানি দিয়েও শেষ পর্যন্ত পারেনি আমিরাত। এবার ঠিকই তারা আদায় করে নিল রূপকধার মতো জয়। বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদের প্রথম জয় এটি।
দুই ম্যাচের সিরিজটি তিন ম্যাচে রূপ নিয়েছে এই ম্যাচের আগে। বুধবার শেষ ম্যাচেই হবে সিরিজর ফয়সালা।
৯ চার ও ৫ ছক্কায় ৪২ বলে ৮২ রানের ইনিংস খেলে আমিরাতের জয়ের নায়ক ওয়াসিম। তবে শেষের নায়ক হায়দার আলি ও ধ্রুব পারাশার। হায়দারের ৬ বলে ১৫ ও ধ্রুবের ৭ বলে ১১ রানের ইনিংস দুটি ছিল মহামূল্য।
শেষ কয়েক ওভারে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচ নাটকীয় মোড় নেয় শেষের আগের ওভারে। দুই ওভারে যখন প্রয়োজন ২৯ রান, প্রথম বলেই আলিশান শারাফুকে ফেরান শরিফুল ইসলাম। তখনও পর্যন্ত দারুণ বোলিং করা এই বাঁহাতি পেসার পরে খেই হারান। তৃতীয় বলে বাউন্ডারি মারেন ধ্রুব পারাশার, পঞ্চম বল ছক্কায় উড়িয়ে দেন হায়দার।
শরিফুল গড়বড় করেন ওভারের শেষ বলেও। ওভার থ্রো করে দিয়ে বসেন ৫ রান!
শেষ ওভারে ১২ রানের সমীকরণে তানজিম হাসান শুরু করেন ওয়াইড দিয়ে। পরের বলে সিঙ্গল নেন হায়দার, এরপর ফুল টস পেয়ে বল গ্যালারিতে পাঠান ধ্রুব।
চার বলে যখন প্রয়োজন চার, তানজিমের স্লোয়ার ডেলিভারিতে বোল্ড হয়ে যান ধ্রুব। পরের ডেলিভারিতে আসে সিঙ্গল। কিন্তু এক বল পর 'নো' করে বসেন তানজিম।
দুই বলে যখন প্রয়োজন দুই রান, হায়দার বল পাঠিয়ে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট সীমানার দিকে। দুই রান হওয়ার কথা সহজেই। কিন্তু এক রান নিয়ে দুই ব্যাটসম্যান একটু ইতস্তত করেন। ফিল্ডার তাওহিদ হৃদয় বল ধরে থ্রো করতে দেরি করেন একটু। তাতেই শেষ সুযোগ হারায় বাংলাদেশ। দুই রান নিয়ে ফেলেন দুই ব্যাটসম্যান।
যদিও নাটকের বাকি ছিল তখনও। হৃদয়ের থ্রো ধরে স্টাম্প ভাঙেন কিপার জাকের আলি। রিপ্লেতে দেখা যায় ক্রিজে পৌঁছেই ব্যাট রাখতে একটু দেরি করেন হায়দার। তবে শেষ পর্যন্ত খেসারত দিতে হয়নি তাকে। বারবার রিপ্লে দেখে টিভি আম্পায়ার রায় দেন 'নট আউট'। উল্লাসে ফেটে পড়ে আমিরাতের ক্রিকেটাররা।
এই সংস্করণে আগে কখনোই ১৭৯ রানের বেশি তাড়া করে জয় ছিল না আমিরাতের। রেকর্ড রান তাড়ায় যেমন দরকার, আরব আমিরাতকে তেমন সূচনাই এনে দেন ওয়াসিম ও জোহেইব খান। যদিও বাংলাদেশ উইকেট পেতে পারত ইনিংসের প্রথম বলেই। একাদশে ফেরা শরিফুল ইসলামের বলে স্লিপে জোহেইব খানের ক্যাচ নিতে পারেননি শান্ত।
খেসারত দিতে হয় বাংলাদেশকে। ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেলেন ওয়াসিম, তার সহযোগী জোহেইব। স্পেন কিংবা স্পিন, বাংলাদেশের সব প্রচেষ্টাই মুখ থুবড়ে পড়ল দুজনের ব্যাটের দাপটে।
প্রথম চার ওভারে ৩৮ রানের পর বল হাতে পেলেন নাহিদ রানা। কিন্তু অভিষিক্ত গতি তারকার প্রথম ওভার থেকেই এলো ১৮!
পাওয়ার প্লেতে ৬৮ রান তুলেই থামেননি দুজন। বল ছুটতে থাকে উড়তে থাকে মাঠের নানা প্রান্তে। ২৫ বলে ফিফটি ছুঁয়ে তাণ্ডব চালিয়ে এগিয়ে যান ওয়াসিম।
১০ ওভারে ১০৭ রান তুলে ফেলে আমিরাত। এই প্রথম কোনো সহযোগী দেশ বাংলাদেশের বিপক্ষে শতরানের উদ্বোধনী জুটি পেল।
পানি পানের বিরতি স্বস্তি হয়ে আসে বাংলাদেশের জন্য। বিরতির পর প্রথম বলেই তানভির ইসলামকে উড়িয়ে মারার চেষ্টায় উইকেট হারান জোহেইব (৩৪ বলে ৩৮)।
আমিরাতে বড় ভরসা রাহুল চোপড়া তিনে নেমে রিশাদ হোসেনকে উইকেট উপহার দেন ২ রান করেই।
কাঙ্ক্ষিত উইকেটটিও বাংলাদেশ পেতে পারত ওই ওভারেই। কিন্তু ৬৪ রানে লং অফে ওয়াসিমের সহজ ক্যাচ ছাড়েন হৃদয়।
জীবন পেয়ে ওয়াসিম ছুটতে থাকেন আগ্রাসী আসিফ খানকে সঙ্গী করে। তানজিম হাসানকে যখন টানা দুই বলে ছক্কায় ওড়ালেন আসিফ, ৩৬ বলে তখন ৬০ রান প্রয়োজন আমিরাতের। উইকেট বাকি ৮টি!
মরিয়া অধিনায়ক লিটন আক্রমণে ফেরান শরিফুলকে। ওই ওভারেই ওয়াসিমের বিদায়। স্লোয়ার ডেলিভারিতে কিপার জাকের আলির ডাইভিং ক্যাচে থামে বিরোচিত ইনিংসটি।
পরের ওভারে নাহিদ রানার গতি ও বাউন্সে যখন বিদায় নিলেন আসিফ (১২ বলে ১৯), তখন মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের শেষ বাধাও দূর হয়ে গেল।
কে জানে, আরও চমক বাকি রেখেছে আমিরাত!
হার না মানা মানসিকতায় পরের ব্যাটসম্যানরা ছোট ছোট অবদান রাখলেন সবাই। বেদম মার খেয়ে নাহিদ ও তানজিমরা যদিও শেষ দিকে উইকেট নিয়ে ম্যাচ জমিয়ে তলিলেন বটে। তবে উজ্জীবিত পারফরম্যান্সে জিতে গেল আমিরাত।
বাংলাদেশের গতি তারকা নাহিদ রানার টি-টোয়েন্টি অভিষেকটি হয় ভুলে যাওয়ার মতো। তার ৪ ওভারে আসে ৫০ রান। তাকেও অবশ্য ছাড়িয়ে যান তানজিম (৩.৫ ওভারে ৫৫)। কেবল লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেনই যা একটু রাশ টানতে পেরেছিলেন।
ম্যাচের প্রথম ভাগে আগের দিনের উইকেটেই আবার টস জিতে আবার বোলিংয়ে নামে আরব আমিরাত। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান পারভেজ হোসেন ইমন এ দিন একাদশে ছিলেন না কুঁচকিকে টান লাগার পর সতর্কতা হিসেবে। তানজিদ হাসানের সঙ্গে ইনিংস শুরু করেন লিটন কুমার দাস। ৫৫ বলে ৯০ রানের জুটিতে দলকে বড় স্কোরের ভিত গড়ে দেন দুজন।
ম্যাচের প্রথম বলটিই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে তেড়েফুঁড়ে মারার চেষ্টায় অল্পের জন্য আউট হননি তানজিদ। তাতে অবশ্য সহজাত ব্যাটিং থেকে দমে যাননি তিনি। ওভার শেষ করেন টানা তিন বলে এক ছক্কা ও দুই চারে।
পরের ওভারগুলোতেও বাউন্ডারির স্রোত বয়ে যায়। তাদেরকে থামাতে আক্রমণে আনা হয় আমিরাতের সেরা বোলার মুহাম্মাদ জাওয়াদউল্লাহকে। আগের ম্যাচে চার উইকেট শিকারি বাঁহাতি পেসারকে প্রথম ওভারে দুই চার এক ছক্কায় স্বাগত জানান তানজিদ।
পরের ওভারে হায়দার আলিকে টানা দুই বলে চার ও ছক্কায় ফিফটিতে পৌঁছে যান তানজিদ। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তার চতুর্থ ফিফটি আসে ২৫ বলে।
ক্যারিয়ারের প্রথম সাত ম্যাচে তিনটি ফিফটির পর টানা ১২ ইনিংসে আর সেই মুখ দেখতে পাননি তিনি। এর মধ্যে আট ইনিংসেই কাটা পড়েছেন দুই অঙ্ক ছোঁয়ার আগে। অবশেষে আবার সেই স্বাদ পেলেন তিনি।
পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশ তোলে ৬৬ রান। তাতে তানজিদের রানই ৫২।
তৃতীয় ওভারে দুটি বাউন্ডারির পর লিটনের ম্যাচ ছিল ঝিমিয়ে। সাত ওভার শেষে তার রান ছিল ১৪ বলে ১৬। এরপর অভিষিক্ত সাগির খানের স্লোয়ার শর্ট বল ছক্কায় উড়িয়ে জেগে ওঠার ইঙ্গিত দেন অধিনায়ক।
সাগিরের পরের ওভারেই ভাঙে উদ্বোধনী জুটি। ৮ চার ও ৩ ছক্কায় ৩৩ বলে ৫৯ করে তানজিদ স্কয়ার লেগে ক্যাচ দেন প্রিয় পুল শটে।
এরপর ইনিংস এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল লিটনের। সেখানে খুব একটা সফল তাকে বলা যাবে না। রানে ফিরেছেন বটে, তবে ৩২ বলে ৪০ রানের ইনিংসটাকে এমন দিনে খুব আদর্শ টি-টোয়েন্টি ইনিংস বলা যাবে না।
পারভেজ না থাকায় সুযোগ পাওয়া শান্তর সামনে হাতছানি ছিল টি-টোয়েন্টির বিবর্ণ রেকর্ডকে একটু ভদ্রস্থ করার। শুরুটাও ভালো করেন এই সংস্করণের সাবেক অধিনায়ক। ফুল টসে একটি ছক্কার পর টানা দুটি বাউন্ডারি যখন মারেন, তখন তার রান ৮ বলে ১৯। কিন্তু এরপর না পেরেছেন ইনিংস বড় করতে, না পেরেছেন গতি দিতে। ৫০তম টি-টোয়েন্টিতে তিনি ফেরেছেন ১৯ বলে ২৭ রান করে।
ওই সময়টায় টানা ২০ বলে আসেনি বাউন্ডারি। মিইয়ে আসা ইনিংসে প্রাণের সঞ্চার করেন তাওহিদ হৃদয়। শুরুতে ৯ বলে ১০ রানে থাকা ব্যাটসম্যান পরে দারুণ কিছু শটে বাড়াতে থাকেন রান। কার্যকর একটি ক্যামিও খেলেন জাকের আলি। দল ছুটতে থাকে দুইশর পানে।
জাকের ১৮ করেন স্রেফ ৬ বলে। শেষ ওভারের প্রথম বলে থামেন হৃদয় (২৪ বলে ৪৫)।
শেষ ওভারে রান আসে স্রেফ চার। তার পরও ২০৫ রানের পুঁজি পায় বাংলাদেশ। কিন্তু সেটিও যথেষ্ট হলো না শেষ পর্যন্ত।
গ্যালারির দর্শকদের প্রায় সবই ছিল বাংলাদেশের সমর্থক। তাদেরকে স্তব্ধ করে দিয়ে জয়োল্লাস করে আমিরাত।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ২০৫/৫ (তানজিদ ৫৯, লিটন ৪০, শান্ত ২৭, হৃদয় ৪৫, জাকের ১৮, শামীম ৬*, রিশাদ ২*; মাতিউল্লাহ ২-০-৩০-০, হায়দার ৪-০-৩১-১, ধ্রুব ৪-০-৪০-০, জাওয়াদউল্লাহ ৪-০-৪৫-৩, সাগির ৪-০-৩৬-২, ওয়াসিম ২-০-২২-০)।
সংযুক্ত আরব আমিরাত: ১৯.৫ ওভারে ২০৬/৮ (জোহেইব ৩৮, ওয়াসিম ৮২, রাহুল ২, আসিফ ১৯, শারাফু ১৩, সাগির ৮, আরিয়ানশ ৭, ধ্রুব ১১, হায়দার ১৫*, মাতিউল্লাহ ১*; শরিফুল ৪-০-৩৪-২, তানভির ৪-০-৩৭-১, তানজিম ৩.৫-০-৫৫-১, নাহিদ ৪-০-৫০-২, রিশাদ ৪-০-২৮-২)।
ফল: সংযুক্ত আরব আমিরাত ২ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে ১-১ সমতা।
ম্যান অব দা ম্যাচ : মুহাম্মাদ ওয়াসিম।