Published : 22 May 2025, 01:10 AM
সংযুক্ত আরব আমিরাতের তখন পাঁচ ওভারে প্রয়োজন ৫৩ রান। রিশাদ হোসেনের বল উড়িয়ে মারলেন আলিশান শারাফু। ক্যাচের সুযোগ থাকলেও বল মুঠোয় জমাতে পারলেন না তানজিদ হাসান। তার হাত থেকে ছুটে বল উড়ে গেল সীমানার ওপারে। ম্যাচটাও যেন ফসকে গেল সেখানেই! জীবন পাওয়া আলিশান আর আসিফ খান মিলে দুর্দান্ত পেশাদারিত্বে পিষ্ট করলেন বাংলাদেশের সব আশা।
আরব আমিরাতের সঙ্গে একটি ক্যাচ নিতে না পারায় পুড়তে হচ্ছে, এটিই অবশ্য বলে দিচ্ছে সিরিজের বাস্তবতা। যে দলের কাছে একটি ম্যাচ হারাও ছিল অভাবনীয়, কল্পনার চূড়ান্ত সীমা ছাড়িয়ে সেই দলের কাছে সিরিজই হেরে গেল বাংলাদেশ! টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ের ১৫ নম্বরে থাকা দল, অনেক পরিবর্তনের পালায় অনভিজ্ঞ বেশ কজনকে নিয়ে সাজানো দলটিই স্বাদ পেল স্মরণীয় এক সিরিজ জয়ের।
শেষ টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে ৭ উইকেটে উড়িয়ে দিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। তিন ম্যাচের সিরিজ তারা জিতে নিল ২-১ ব্যবধানে।
টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে আমিরাতের সিরিজ জয় আগে ছিল একটিই। ২০২১ সালে হারিয়েছিল তারা আয়ারল্যান্ডকে।
শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বুধবার এক পর্যায়ে ৮৪ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে চরম বিপর্যয়ে পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর শেষ দুই উইকেটে রেকর্ড জুটিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে ১৬২ রান পর্যন্ত যেতে পারে তারা। কিন্তু সেই রান নিয়ে লড়াই করতেও পারেনি লিটন কুমার দাসের দল। পেশাদার ও নিয়ন্ত্রিত রান তাড়ায় আমিরাত জিতে যায় ৫ বল বাকি রেখেই।
আলিশান শারাফু ও আসিফ খানের ৫১ বলে ৮৭ রানের অপরাজিত জুটি দুমড়েমুচড়ে দেয় বাংলাদেশের সম্ভাবনা।
আগের দুই ম্যাচের উইকেটেই হয় এই ম্যাচ। আবারও টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। ম্যাচ শুরু হয় রানের বার্তা ছড়িয়ে। সিরিজের প্রথমবার খেলতে নামা আকিফ রাজাকে প্রথম ওভারেই চার ও ছক্কা মারেন তানজিদ হাসান।
পরের ওভারের প্রথম বলেই অফ স্পিনার ধ্রুব পারাশারকে উড়িয়ে সীমানায় ধরা পড়েন পারভেজ হোসেন ইমন। প্রথম ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান পরের ম্যাচে বাইরে থাকার পর এই ম্যাচে ফিরেই পেলেন ‘গোল্ডেন ডাক।’
তবে অধিনায়ক লিটন কুমার দাস ক্রিজে গিয়ে চার ও ছক্কা মারেন দ্রুত। মাতিউল্লাহ খানের ওই ওভারে তানজিদেরও একটি ছক্কায় মোট রান আসে ১৮।
এরপর থেকেই নাটকীয় পালাবদলের শুরু। বাঁহাতি স্পিনার হায়দার আলি আক্রমণে আসেন চতুর্থ ওভারে। প্রথম বলেই প্যাডল সুইপ করার চেষ্টায় এলবিডব্লিউ লিটন (১০ বলে ১৪)। এক বল পর ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ক্রস ব্যাটে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউ তাওহিদ হৃদয় (০)।
পাওয়ার প্লের ভেতরে ডাবল উইকেট মেডেন নেন এই সিরিজেই অভিষিক্ত হায়দার।
একাদশে ফেরার ম্যাচে আবার পাঁচে নেমে ব্যর্থ শেখ মেহেদি হাসানও (৯ বলে ২)। এর মধ্যেই আবার ধ্রুবের এক ওভারে দুই ছক্কা এক চারে তানজিদ নেন ১৬ রান।
পাওয়ার প্লে শেষে তানজিদের রান ১৪ বলে ৪২, বাংলাদেশের অন্য সব ব্যাটসম্যান মিলে করেন ২২ বলে ১৪!
পরের ওভারে শেষ হয়ে যায় তানজিদের রোমাঞ্চকর অভিযানও। আকিফের বলে দুটি চার মারার পর অ্যাঙ্গেল বদলে রাউন্ড দা উইকেটে আসেন এই পেসার। প্রথম বলেই বোল্ড বাঁহাতি ব্যাটসম্যান (১৮ বলে ৪০)।
এরপর মাতিউল্লাহ এক ওভারেই ফেরান শামীম হোসেন (১২ বলে ৯) ও রিশাদ হোসেনকে (০)। ১১ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান ৭ উইকেটে ৭১।
একটু পর তানজিম হাসান (১২ বলে ৬) বিদায় নেন ছক্কার চেষ্টায়, একশর নিচে বাংলাদেশের গুটিয়ে যাওয়া মনে হচ্ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার। কে জানত, ইনিংসের সেরা সময়টাই তখন আসছে!
তানজিমের বিদায়ের পর প্রথম বলেই ছক্কা মেরে জকের বুঝিয়ে দেন তার মনোভাব। দুই দফায় অবশ্য পানিশূন্যতায় ভুগে ক্র্যাম্প করে মাঠেই শুশ্রূষা নিতে হয় তাকে। তবে হাল না ছেড়ে দলকে এগিয়ে নেন। হাসান মাহমুদের সঙ্গে ৪৪ রানের মহামূল্য জুটি গড়েন ২৬ বলে।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে নবম উইকেটে বাংলাদেশের রেকর্ড জুটি এটিই। পেছনে পড়ে যায় ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মেহেদী হাসান মিরাজ ও আবু হায়দারের ৩৩ রানের জুটি।
তিন ছক্কায় ৩৪ বলে ৪১ রান করে জাকের যখন ফিরলেন, বাংলাদেশের রান তখন ১২২। দেড়শ তো দৃষ্টিসীমায় ছিল না বলা যায়।
কিন্তু চমক দেখান হাসান ও শরিফুল। আরব আমিরাতের বোলাররাও সহায়তা করেন আলগা বোলিং করে। শরিফুল ক্রিজে গিয়েই ছক্কা মারেন হুক করে।
শেষ ওভার বোলিং করতে আসেন আমিরাতের অধিনায়ক মুহাম্মাদ ওয়াসিম। তার এলোমেলো স্লো মিডিয়াম পেসকে তুলাধুনা করে দুটি ছক্কা মারেন হাসান, একটি চার শরিফুল। দুটি বিমার করে ওভার শেষও করতে পারেননি বোলার। ওভারটি শেষ করে আলিশান শারাফু।
শেষ ওভার থেকে রান আসে ২৬, শেষ চার ওভারে ওঠে ৬৪ রান!
হাসান ও শরিফুলের জুটিতে ৩৪ রান হয়ে যায় স্রেফ ১২ বলেই। শেষ জুটিতে যা বাংলাদেশের রেকর্ড।
বাঁহাতি স্পিনারের দেশকে ভুগিয়ে ৪ ওভারে মাত্র ৭ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন হায়দার।
ব্যাটিংয়ে শেষের ওই ঝড়ের পর বোলিংয়ে জরুরি ছিল ওয়াসিমকে দ্রুত বিদায় করা। প্রথম ম্যাচে ৫২, দ্বিতীয় ম্যাচে ৮২ রান করা ব্যাটসম্যানকে অবশেষে শুরুতে ফেরাতে পারে বাংলাদেশ। শরিফুলের বলে ওয়াইড স্লিপে ধরা পড়েন আমিরাতের বড় ভরসা (৯)।
তবে ব্যাটিং স্তম্ভকে হারিয়েও ইনিংস নড়বড়ে হয়নি তাদের। দ্বিতীয় উইকেটে ৪৪ রানের জুটি গড়েন জোহেইব খান ও আলিশান শারাফু।
হাসান মাহমুদকে টানা দুই বলে উইকেটের দুই পাশে ছক্কায় ওড়ান জোহেইব। পাওয়ার প্লেতে ৫০ তোলে আমিরাত।
রিশাদ আক্রমণে এসে প্রথম বলেই ভাঙেন এই জুটি। বলের লাইন মিস করে ব্যাট-প্যাডর ফাঁক গলে বোল্ড হন জোহেইব (২৩ বলে ২৯)।
এরপর রাহুল চোপড়া (১৩) সুবিধা করতে না পারলেও দলকে এগিয়ে নেন আলিশান। শুরুতে একটু সময় নিয়ে খেলে পরে নিজের চেনা চেহারায় আবির্ভুত হন আগ্রাসী আসিফ।
তাদেরকে একটু দমিয়ে রাখতে পেরেছিলেন রিশাদ। তার প্রথম তিন ওভার থেকে রান আসে ১৩। কিন্তু ম্যাচের পাঁচ ওভার বাকি থাকতে তানজিদ ওই ক্যাচ ছেড়ে ছক্কা বানিয়ে দেওয়ার পর আর আটকে রাখা যায়নি দুই ব্যাটসম্যানকে। ওই ওভারে আরও দুটি ছক্কা মারেন আসিফ।
দুই পাশ থেকেই রান আসতে থাকে। ১৯তম ওভারে তানজিমকে দুটি ছক্কায় বাংলাদেশের সামান্য আশাটুকুও শেষ করে দেন আসিফ। শেষ ওভারের প্রথম বল বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে ম্যাচ শেষ করে দেন আলিশান।
৫ চার ও ৩ ছক্কায় ৪৭ বলে ৬৮ রানে অপরাজিত থাকেন ২২ বছর বয়সী আলিশান। আসিফের ২৬ বলে ৪১ রানের অপরাজিত ইনিংসে কোনো চার নেই, ছক্কা ৫টি।
ম্যাচ শেষ হতেই বাঁধনহারা উল্লাসে মেতে ওঠেন আমিরাতের ক্রিকেটাররা। পরে তারা উচ্ছ্বাসে ভেসে যান ট্রফি নিয়ে। আমিরাতের ক্রিকেট ইতিহাসের স্মরণীয়তম রাত সম্ভবত এটিই!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৬২/৯ (তানজিদ ৪০, পারভেজ ০, লিটন ১৪, হৃদয় ০, শেখ মেহেদি ২, জাকের ৪১, শামীম ৯, রিশাদ ০, তানজিম ৬, হাসান ২৬*, শরিফুল ১৬*; আকিফ ৪-০-২৭-১, ধ্রুব ৩-০-২৪-১, মাতিউল্লাহ ৪-০-৪১-২, হায়দার ৪-১-৭-৩, সাগির ৪-০-৩৬-২, ওয়াসিম ০.৫-০-২৩-০, আলিশান ০.১-০-৩-০)
সংযুক্ত আরব আমিরাত: ১৯.১ ওভারে ১৬৬/৩ (ওয়াসিম ৯, জোহেইব ২৯, আলিশান ৬৮*, রাহুল ১৩, আসিফ ৪১*; শেখ মেহেদি ৪-০-৩৬-০, শরিফুল ৪-০-২৪-১, হাসান ৩.১-০-৩৩-০, তানজিম ৪-০-৪০-১, রিশাদ ৪-০-৩২-১)
ফল: সংযুক্ত আরব আমিরাত ৭ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে সংযুক্ত আরব আমিরাত ২-১ ব্যবধানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ : আলিশান শারাফু।
ম্যান অব দা সিরিজ: মুহাম্মাদ ওয়াসিম।