Published : 31 May 2025, 09:47 AM
বিসিবি সভাপতি হিসেবে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের স্বাগত বক্তব্য ততক্ষণে শেষ। এবার প্রশ্নোত্তরের পালা। নতুন সভাপতি হিসেবে কিছু ‘আলগা ডেলিভারি’ তিনি আশা করতেই পারেন। কিন্তু শুরু থেকেই তার দিকে ছুটে গেল একের পর এক বাউন্সার। বিব্রতকর সব প্রশ্ন। প্রশ্নগুলোর মূল চরিত্ররা তখন তার দুই পাশেই বসে আছেন!
এই মানুষগুলোকে পাশে নিয়েই গত ২১ অগাস্ট এই কক্ষে একই মঞ্চে নতুন বিসিবি সভাপতি হিসেবে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন ফারুক আহমেদ। মোটে ৯ মাস পেরুতেই তিনি হয়ে পড়েছেন একা। তার পাশে তো কেউ ছিলই না, বরং শুরুতে পাশে থাকা ওই মানুষগুলিই এখন তাকে দাঁড় করিয়েছে কাঠগড়ায়। সেখানে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং শাস্তি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার বছর না ঘুরতেই তাকে সভাপতির পদ হারাতে হয়েছে।
ঠিক একই প্রক্রিয়ায় এখন সভাপতি করা হয়েছে আরেক সাবেক অধিনায়ক আমিনুলকে। তার পাশে বসে একইভাবে হাসিমুখে দেখা গেল সেই মানুষগুলোকেই। তাহলে তাদের সঙ্গে এই বন্ধন আমিনুলকে নিয়ে যাবে কোন পথে?
এই মানুষগুলি মানে বিসিবির কয়েকজন পরিচালক। মাহবুব আনাম বিসিবি পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন দুই যুগের বেশি সময় ধরে। বিভিন্ন সময়ে সরকার পরিবর্তনে গোটা বোর্ডের চেহারা বদলে গেছে। কিন্তু তিনি কোনো না কোনোভাবে রয়েই গেছেন। আকরাম খান, কাজী ইনাম আহমেদের মতো কেউ কেউ নাজমুল হাসান সভাপতি থাকার তিন মেয়াদেই বা দুই মেয়াদে বোর্ড পরিচালক ছিলেন ও আছেন। ফাহিম সিনহা, ইফতেখার রহমানরা পরিচালক হয়েছেন পরে, তবেও তারা ছিলেন নাজমুলের নেতৃত্বে বোর্ডে।
বছরের পর বছর ধরে তারা বিসিবিতে নানা ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু তাদের ঘিরে বিতর্ক-অভিযোগের শেষ নেই। পুরোনো ‘জঞ্জাল’ সঙ্গী করে নতুন পথে ছুটতে চাইলে তো এই পথও একই পঙ্কিলতায় ডুবে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। ফারুক আহমেদ এখন যেমন বুঝতে পারছেন!
ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন বিসিবির ৯ পরিচালকের ৮ জনই। কেবল আকরাম খান সেখানে স্বাক্ষর করেননি। মজার ব্যাপার হলো, চিঠিতে যেসব অভিযোগ তারা করেছেন, প্রায় সবকটি অভিযোগ নানা সময়ে উঠেছে আকরামসহ তাদের সবার বিরুদ্ধেই! বছরের পর বছর ধরে তাদেরকে নিয়ে চলে আসছে অসংখ্য বিতর্ক। সংবাদ সম্মেলনে তাদেরকে নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন, সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে, তুলে ধরা হয়েছে।
কিন্তু তারা বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন।
এই ৯ মাসে ফারুক ভুল বা বাড়াবাড়ি করেননি, এমন নয়। অভিযোগের জায়গাও অনেক আছে। কিন্তু যেভাবে তাকে সরানো হলো, সেখানে 'প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের' ছাপ একরকম প্রকাশ্যই। বিশেষ করে অনাস্থা চিঠিতে পরিচালকরা যা তুলে ধরেছেন, সেটিই আরও নগ্নভাবে ফুটিয়ে তুলছে তাদের গোপন কোনো উদ্দেশ্য।
চিঠিতে এমন কিছু অভিযোগ তারা করেছেন, যেগুলো তিন দফায় দায়িত্বে থাকা নাজমুল হাসানকে নিয়েও ছিল এবং প্রবলভাবেই সেসবের প্রকাশ দেখা গেছে। যথারীতি সংবাদমাধ্যম তখনও প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু এই পরিচালকদের কেউ অনাস্থা জ্ঞাপন করা তো দূরের কথা, কোনোরকম প্রতিবাদ বা বাধা দেওয়া কিংবা নিদেনপক্ষে অসমর্থন করেছেন, এমন কোনো নমুনা কখনও দেখা যায়নি, শোনাও যায়নি।
কাজেই দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে বা ভালো কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে তারা জোট বেঁধে ফারুককে বিদায় করেছেন, এমন কিছু কল্পনা করাও কঠিন। বরং এখানে স্বার্থের সংঘাত বা নিজ নিজ উদ্দেশ্য পূরণের পথে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার ব্যাপারটিই বেশি উপযুক্ত মনে হয়।
আমিনুলের সঙ্গেও যে কিছুদিন পর এসবের সূত্রপাত হবে না, সেই নিশ্চয়তা কিংবা আস্থার জায়গাটি কোথায়!
শঙ্কাটি আছে বলেই এই সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন আমিনুলের দিকে ছুটে গেল, যেটির উল্লেখ করা হয়েছে এই লেখার শুরুতে। সংক্ষেপে প্রশ্নগুলি এরকম:
“সদ্য বিদায়ী সভাপতির হয়তো ম্যান-ম্যানেজমেন্টে ঘাটতি ছিল। আপনাকেও এমন কিছু ক্যারেকটারকে পেতে হচ্ছে। এই ধরনের লোকদের ম্যানেজ করার একটি মুন্সিয়ানা দরকার আছে। সেটি আপনি কতটা জরুরি মনে করেন?”
“আপনি সবসময় বোর্ডের নানা কিছু নিয়ে উচ্চকিত ছিলেন। মিডিয়ার কাছে ভরসার একজন ছিলেন। ক্রিকেট বোর্ডে আপনাকে যারা নানা সময়ে হেয় করেছে, তারাই এখন আপনার পাশে, এটা কেমন লাগছে?
“আপনি এতদিন যাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, অনেকেই বিসিবিতে আছেন ১০-১২ বছর ধরে, মাহবুব আনাম আছেন ২০-২৫ বছর ধরে, তাদের বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ আছে। তাদেরকে নিয়ে আপনি কিভাবে কাজ করবেন? ফারুক আহমেদও একই স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাকে চলে যেতে হয়েছে। আপনি যাওয়ার সময় এখনকার সম্মানটা কি থাকবে?”
“ফারুক আহমেদ তো এনএসসি মনোনীত পরিচালক ছিলেন। সেই মনোনয়ন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আপনি যেহেতু তাদেরই মনোনীত, তাদের কথামতো হয়তো কাজ করতে হতে পারে। এটা কি একটা বোঝা মনে হয়?”
বাউন্সারগুলোর জবাবে পুল-হুক শট খেলেননি আমিনুল। বরং সবাইকে নিয়ে পথচলার বার্তাই দিলেন নতুন সভাপতি।
“আমরা তো একটা দল। আমার আজকে থেকে শুরু হলো। এই মুহূর্তে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমরা চেষ্টা করব সকলের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সবার প্রাণশক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা যেন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।”
বিসিবির বাইরে থেকে নানা অনিয়ম, ঘাটতি, অসঙ্গতির সমালোচনা যেভাবে করেছেন, বোর্ডের ভেতর থেকে একই ভাবনা নিয়ে সমাধানের চেষ্টা চালাবেন বলে জানালেন তিনি।
“আমি সবসময় বিশ্বাসী ছিলাম যে, আমাকে কে সমালোচনা করছে… কারণ, আমি খুবই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি। যা কিছু অর্জন করেছি, সব ক্রিকেট থেকেই। ক্রিকেটের সঙ্গে কখনও কোনো বোঝাপড়া তাই আমি কখনও করিনি, করবও না। এজন্য আমি সবসময় সত্য কথা বলার চেষ্টা করি। কারণ এটা শুধু আমার জীবিকাই নয়, এটাই আমাকে সবকিছু দিয়েছে। সকলকে নিয়েই আমরা চেষ্টা করব সেরাটা দিতে এবং প্রমাণ করতে।”
বিতর্কিত ও সমালোচিত সেই পরিচালকদের নিয়ে কতটা কাজ করতে পারবেন, এই প্রশ্নেও একতার কথাই বললেন আমিনুল।
“আজকে আমি শুরু করলাম, সামনেই বলে দেবে সবকিছু। তবে আমি এটা বিশ্বাস করি, একটা ক্রিকেট দল, বা একটা দেশ তখনই এগিয়ে যায়, যখন দল হিসেবে কাজ করে। একটা বোলার কিন্তু কখনও একা বল করতে পারে না, তার ফিল্ডার দরকার হয়, উইকেটকিপার দরকার হয়। আমরা একেক সময় একেকটা ভূমিকা পালন করব। চেষ্টা করব সেই জিনিসটা প্রতিষ্ঠিত করার।”
আমিনুলের এসব উত্তর অবশ্য অপ্রত্যাশিত নয়। এই পরিচালকদের ভোটে সভাপতি হয়ে একটু পরই তাদের শূলে চড়ানোর কথা নয় তার। তবে নতুন সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে যেসব লক্ষ্য পূরণের কথা তিনি বলেছেন, সেই পথে কাঁটা হতে পারেন তার এই সঙ্গীরাই।
একটা ব্যাপার অবশ্য আমিনুলের কাজ কিছুটা সহজ করে তুলতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্বে থাকার বা আগামী অক্টোবরের মধ্যে অনুষ্ঠেয় বিসিবি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো ইচ্ছে তার আপাতত নেই বলেই জানিয়েছেন। যেখানে ফারুক ছিলেন উল্টো। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন এবং সাম্প্রতিক সময়টায় তিনি পুরোপুরিই নির্বাচনমুখী হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা গেছে নানা সময়েই।
বিসিবি নির্বাচকদের আরেকটি পক্ষও নির্বাচনমুখী বেশ কিছুদিন ধরেই। ফারুকের সঙ্গে তাদের আগেই টুকটাক সঙ্কট ও টানাপোড়েন তো চলছিলই। নির্বাচনের মাঠ সাজানো, নিজেদের পক্ষে ক্লাব গোছানোর লড়াইয়ে সব বিরোধের বিস্ফোরণ হয় বলে আলোচনা আছে। সেই রাজনীতির খেলায় হেরেই এখন চেয়ারচ্যুত ফারুক।
আমিনুলের সামনে সরাসরি এই শঙ্কা হয়তো নেই। কিন্তু বছরের পর বছর ধরেই অনেক কিছু যারা ঠিকঠাক করেননি, যাদের সদিচ্ছা ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আসছে বরাবরই, তারা নিজেদের স্বার্থে আমিনুলের সামনেও বাধার দেওয়াল হবেন না বা ছুড়ে ফেলবেন না, সেই নিশ্চয়তা কে দিতে পারে!
এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল ও আইসিসিতে দীর্ঘদিন ডেভেলপমেন্ট সংক্রান্ত কাজ করে অবশ্যই আমিনুল অনেক অভিজ্ঞ। কিন্তু তিনি যতটা ভাবছেন, বিসিবি সভাপতির দায়িত্বে তার চ্যালেঞ্জের পরিধি হয়ে উঠতে পারে আরও ব্যাপক ও বিশদ।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারটি যেমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশের ক্রিকেটে কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট না থাকা ফারুকের দুয়ারে কড়া নেড়ে তারা গত অগাস্টে তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে চেয়ারে বসিয়েছে। সেসময় সরিয়ে দিয়েছে তারা বর্ষীয়ান ক্রিকেট সংগঠক আহমেদ সাজ্জাদুল আলমকে। সেই ফারুককেই এবার তারা বিতারিত করে দিয়েছে একইভাবে। ৯ মাসেই পুরো উল্টো অবস্থানে যাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে! আমিনুল যতই এড়িয়ে যেতে চান এই সংক্রান্ত প্রশ্ন, কিন্তু মন্ত্রণাললের দাবি মেটানোর ভাবনাও তার মাথায় নিশ্চিতভাবেই রাখতে হবে।
একটি দল হয়ে সবাইকে নিয়ে চেষ্টার কথা আমিনুল বলেছেন। কোনো দলের ভেতর সাধারণত সৌহার্দ্য ও একতার অনুভূতির পাশাপাশি থাকে মধুর লড়াই বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তা দলকেই আরও সমৃদ্ধ করে। কিন্তু নিজ দলেই যদি শত্রু-শত্রু খেলা শুরু হয়, সেটির পরিণতির প্রমাণ তো ফারুক আহমেদই!